সবাই-ই তো মনে মনে চায়, কেউ এসে বলুক, তুমি একজন জাদুকর!

একটি বই-ই বিশ্বব্যাপী বিক্রি হয়েছে প্রায় ১২ কোটি কপি, ভাবা যায়! বইটির নাম হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোসফারস স্টোন। ব্রিটিশ লেখক জে কে রোলিংয়ের ‘হ্যারি পটার’ সিরিজে বই আছে মোট ৭টি; সব মিলিয়ে বিক্রীত বইয়ের সংখ্যা ৫০ কোটির বেশি। এত এত পাঠকের কাছে যিনি পৌঁছে গেছেন, তাঁর লেখালেখির শুরুটা কীভাবে? দ্য সানডে টাইমস–এ ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর প্রকাশিত একটি নিবন্ধে সে কথাই লিখেছেন জে কে রোলিং। পড়ুন নির্বাচিত অংশ।

জে কে রোলিং
ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

‘লম্বা করিডর, আলোকোজ্জ্বল শূন্য ঘর, ওপরের তলায় পিনপতন নীরবতা, নির্জন চিলেকোঠা, দূর থেকে ভেসে আসা পানির কলকল শব্দ, ছাদের টাইলসে বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ—এসবের মধ্যেই আমার বেড়ে ওঠা। আর হ্যাঁ, ছিল অজস্র বই।’—লিখেছেন সি এস লুইস। জেনারেশন এক্সের প্রতিনিধি হিসেবে একই দাবি আমি করতে পারি না। কারণ, আমাদের সময় ছিল টেলিভিশন, ছিল বুমবক্স। ছয় বর্গফুটের যে চিলেকোঠা ছেলেবেলায় আমি পেয়েছি, তাতে আবিষ্কার করার মতো বেশি কিছু ছিল না। তা ছাড়া আমার বাড়ির কাছে মাঠ ছিল, বন ছিল। খাবারের সময় হওয়ার আগপর্যন্ত সেখানে একা একা ঘোরার স্বাধীনতা ছিল। তবে হ্যাঁ, নির্জনতা আর অজস্র বইয়ের মাঝে বেড়ে ওঠার সুযোগ আমারও হয়েছে।

ঘুমাতে যাওয়ার আগে কল্পনার জগতে ডুব দেওয়াটা খুব উপভোগ করতাম। সে জন্যই হয়তো অন্য অনেক বাচ্চাদের তুলনায় রাতে আগে আগে শুয়ে পড়ার একটা আগ্রহ আমার ছিল। এমনকি ঘুমিয়ে পড়ার আগপর্যন্ত কিছু কিছু গল্প আওড়াতে থাকতাম। একটা গল্প শাখাপ্রশাখা মেলতে মেলতে যখন আর কিছু অবশিষ্ট থাকত না, তখন বুঝতাম, নতুন গল্প বোনার সময় হয়েছে।

আরও পড়ুন

লেখালেখি শুরু করি অনেক ছোটবেলায়। যদি এখনো ছোটই থাকতাম, তাহলে হয়তো কোনো অনলাইন লেখালেখির গ্রুপে গল্প লিখতাম। অবশ্য নিজের লেখা গল্প ক্লাসরুমের বাইরে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমি খুবই সতর্ক ছিলাম। শিশু-কিশোরদের জন্য কত ছোটগল্প যে লিখেছি, কত উপন্যাস যে কয়েক পাতার পর আর এগোয়নি, তা শুধু আমি আর আমার ঘরের ময়লার ঝুড়িই জানে। এটা বুঝতে অনেক সময় লেগে যায় যে নিজেকে আপনি যা মনে করেন, আদতে আপনি তা নন। এমনকি অন্যেরা আপনাকে যা মনে করেন, আপনি তা-ও নন। যদিও শত শত বছর ধরে মানুষ এমনটাই ভেবে আসছে।

আমার বয়স যখন ২০-এর ঘরে, তখন দ্য প্রাইভেট জোক নামে একটা উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলাম। একদমই বাজে উপন্যাস। মাঝেমধ্যে লিখতাম, আবার মাসের পর মাস ফেলে রাখতাম। আবার একটু লিখতাম। পাণ্ডুলিপির একাংশ দীর্ঘদিন পড়ে ছিল আমার লাগেজে। বয়স যখন ২৫, সেই লাগেজ নিয়েই একবার ম্যানচেস্টার থেকে লন্ডনে যাচ্ছিলাম। তখনই আমার মাথায় একদমই অন্য রকম একটা বইয়ের ভাবনা খেলে যায়—একটা ছেলে। যে জানে না, সে আসলে একজন জাদুকর। একদিন তাকে একটা জাদুর স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয়...।

ছোটদের জন্য লেখার কথা এর আগে কখনোই মাথায় আসেনি। এমন নয় যে ছোটদের জন্য লেখা ব্যাপারটাকে আমি ছোট করে দেখেছি। পড়ার ব্যাপারে ছেলেবেলা থেকেই আমার কোনো বাছবিচার ছিল না। যে বই হাতের কাছে পেয়েছি, সেটাই গোগ্রাসে গিলেছি। কিন্তু এখনো প্রিয় বইয়ের তালিকায় কিছু শিশুসাহিত্যও আছে। আমার ছেলেবেলাটা খুব সুন্দর ছিল না। যাঁরা ছেলেবেলায় ফিরতে চান, আমি তাঁদের দলে নই। আমার কাছে ছেলেবেলা মানে দুশ্চিন্তা আর একধরনের নিরাপত্তাহীনতার বোধ।

যখন ‘হ্যারি পটার’–এর ভাবনাটা হুড়মুড় করে মাথার মধ্যে চলে এল, গোপন এই পৃথিবী তৈরি করতে আমি একরকম মুখিয়ে ছিলাম। দ্য প্রাইভেট জোক-এর পাশাপাশিই কিছুদিন ফিলোসফারস স্টোন লেখা চালিয়ে গেছি। কিন্তু যখন দেখলাম, ‘হ্যারি পটার’–এর দুনিয়াই আমাকে টেনে নিচ্ছে, তখন দ্য প্রাইভেট জোককে মুক্তি দিই।

“‘হ্যারি পটার” কেন এত জনপ্রিয় হলো?’ এই প্রশ্নের মুখোমুখি বহুবার হয়েছি। কখনোই খুব ভালো উত্তর দিতে পারিনি। তবে আমার মনে হয়, কিশোর–তরুণেরা পটারের বইয়ে তা-ই পায়, যা তারা অনলাইনে খোঁজে—ছকে বাঁধা পৃথিবী থেকে একধরনের পরিত্রাণ, রোমাঞ্চ, কোনো একটা মাধ্যম। পটারের বইগুলোতে আমরা এমন একদল মানুষের সঙ্গেও পরিচিত হই, যারা অস্বাভাবিক-অদ্ভুত বিষয়গুলোকেও স্বাগত জানায়। এমনটা কে না চায়? সবাই-ই তো মনে মনে চায়, কেউ এসে বলুক, তুমি একজন জাদুকর! কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর বইয়ের পার্থক্য হলো, বইয়ে ‘পারফর্ম’ করার চাপ নেই। বইয়ে যা লেখা, পাঠককে তার সঙ্গে সম্মত হতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। বই অনেকটা বন্ধুত্বপূর্ণ ‘কমন রুম’–এর মতো। যখন খুশি বেরিয়ে যেতে পারেন। কেউ আপনাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে না। এখানে আপনার কাছে কারও কোনো চাওয়া নেই।