রোবোটিকস নিয়ে দেশে কোথায় কী হচ্ছে
সমুদ্রের তলদেশ থেকে শুরু করে মঙ্গল গ্রহ—নানা স্থানে চলার উপযোগী রোবট তৈরি করছেন আমাদের শিক্ষার্থীরা। অংশ নিচ্ছেন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়, জিতছেন পুরস্কার। রোবটপ্রেমীরা গড়ে তুলছেন বিভিন্ন ক্লাব। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে নির্দিষ্টভাবে রোবট নিয়েই পড়ালেখার সুযোগ তৈরি হয়েছে। রোবট নিয়ে কোথায় কী হচ্ছে, একনজরে তা–ই দেখুন।
রোবট নিয়ে পড়ালেখা
রোবোটিকস একধরনের ‘মাল্টিডিসিপ্লিনারি’ বিষয়। অর্থাৎ বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের নানা শাখার জ্ঞান এতে প্রয়োজন হয়। সে জন্যই তড়িৎ প্রকৌশল থেকে শুরু করে যন্ত্রকৌশল, কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল, স্থাপত্য, বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা এক হয়ে রোবোটিকস নিয়ে কাজ করেন। এসব বিভাগে এক দশক ধরেই রোবোটিকস–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক খলিলুর রহমান মনে করেন, মূলত ২০১০ সালের পর থেকে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রোবোটিকসের চর্চা পুরোদমে শুরু হয়েছে। আর এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং নামে আলাদা একটি বিভাগই আছে। ২০১৫ সালে এটি মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং নামে যাত্রা শুরু করে। পরের বছরই বিভাগের নামের সঙ্গে যুক্ত হয় ‘রোবোটিকস’। এই বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়া যায়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি রোবোটিকস নামে কোনো বিভাগ নেই। তবে সব বিভাগেই এ–সংক্রান্ত পড়ালেখা হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস ও অটোমেশন ইনস্টিটিউট থেকে মাস্টার্স ও গবেষণার সুযোগ আছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে রোবোটিকসে মেজরসহ সফটওয়্যার প্রকৌশলে বিএসসি করা যায়। অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে রোবোটিকস অ্যান্ড অটোমেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ আছে। ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ আছে। এই বিভাগে যন্ত্রকৌশল, তড়িৎকৌশল ও কম্পিউটার প্রকৌশলের সমন্বয়ে রোবোটিকস নিয়ে পড়ানো হয়। আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস বিভাগের অধীন আছে রোবোটিকস অ্যান্ড অটোমেশন ল্যাবরেটরি। রোবটের অ্যানাটমি (শরীরের গঠন) থেকে শুরু করে মেকাট্রনিকস সিস্টেম ডিজাইন, কন্ট্রোল সিস্টেম ডিজাইন, মাইক্রোকন্ট্রোলার, রোবট অপারেটিং সিস্টেম, নানা বিষয় এখানে পড়ানো হয়।
গাজীপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ ডিজিটাল ইউনিভার্সিটিতেও ইন্টারনেট অব থিংস অ্যান্ড রোবোটিকস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি নেওয়া যায়। রোবোটিকস–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়; যেমন সেন্সর নেটওয়ার্ক, এমবেডেড সিস্টেম, এআই, মেশিন লার্নিং, কন্ট্রোল সিস্টেম, রোবোটিকস অ্যালগরিদম, নানা কিছু এখানে পড়ানো হয়।
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক হেলাল আন নাহিয়ানের সঙ্গে কথা হলো। রোবোটিকস ও কন্ট্রোল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে মাস্টার্স ও জাপান থেকে পিএইচডি করেছেন এই শিক্ষক। বললেন, ‘মানুষকে সহায়তা করার মতো নানা ধরনের রোবট নিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা কাজ করছে। কুয়েটে যেমন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রোবোটিকস ল্যাব, মেকাট্রনিকস সিস্টেম ডিজাইন ল্যাব আছে। এসব ল্যাবে ছেলেমেয়েরা কাজ করছে। তবে আমাদের দেশে রোবোটিকস চর্চা খুব ব্যয়বহুল। আবার অনেক সময় দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সুযোগ পেয়েও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে শিক্ষার্থীরা যেতে পারে না। এসব চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখেই কাজ করতে হচ্ছে।’
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির রোবোটিকস ল্যাবের উপদেষ্টা ও জ্যেষ্ঠ প্রভাষক হাফিজুল ইমরান বলেন, ‘এখন ফিজিক্যাল অটোমেশনের পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে। অটোনোমাস রোবোটিকসের বিকাশ ঘটেছে। শিল্পকারখানার পাশাপাশি এখন ঘরে ঘরে রোবট ঢুকে পড়ছে। একাডেমিতে রোবোটিকস নিয়ে পড়ার সুযোগ তৈরি করতেই ২০১৮ সালে আমরা একটি বিশেষায়িত ল্যাব প্রতিষ্ঠা করি। রোবোটিকস বিষয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা বলতে যে শুধু রোবট বানানো বা তৈরি করা বোঝায়, তা কিন্তু নয়। এর ক্ষেত্রটা অনেক বড়।’
রোবোটিকস ক্লাব
রোবট তৈরি করতে বা এ নিয়ে গবেষণা করতে হলে নানা বিষয়ের বিশেষায়িত জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের একত্র হওয়াটা জরুরি। এই সুযোগটাই করে দেয় ক্লাব। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু রোবোটিকস ক্লাব।
মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এমআইএসটি), ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রাম, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজিসহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই রোবোটিকস ক্লাব সক্রিয় আছে।
এমআইএসটি রোবোটিকস ক্লাবের প্রেসিডেন্ট রাইসুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের ক্লাবটা মোটামুটি পুরোনো। ক্লাবের অনেক সিনিয়র এখন ভিনদেশি রোবোটিকস গবেষণাগার ও ল্যাবে কাজ করছেন। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় আমরা ক্লাবের পক্ষ থেকে অংশ নিই। নিজেরা প্রতিযোগিতা, কর্মশালার আয়োজন করি। আগামী ডিসেম্বরে যেমন রোবোলিউশন ৩.০ আয়োজন করতে যাচ্ছি। আমরা মনে করি, রোবোলিউশন দেশের সবচেয়ে বড় রোবোটিকস ফেস্ট। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নিতে পারবেন এই আয়োজনে।’
যাচ্ছি প্রতিযোগিতায়, আসছে পুরস্কার
রোবোটিকস–সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাতেই নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন আমাদের শিক্ষার্থীরা।
মঙ্গল গ্রহে চলার উপযোগী রোবট (মার্স রোভার) নিয়ে সারা বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে একটি প্রতিযোগিতা করে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বর্তমানে মার্স রোভার নিয়ে কাজ করছেন। যেমন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইইউ), ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি), গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দল নিয়মিতই তাঁদের রোভার হালনাগাদ করেন।
আইইউটি মার্স রোভারের দলনেতা মো. ইমন বলেন, ‘আমাদের মার্স রোভার প্রজেক্টের নাম প্রজেক্ট আলতাইর। গত তিন বছরে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় আমরা অংশ নিয়েছি। যুক্তরাষ্ট্র, পোল্যান্ড ও ভারতের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় গেছি। প্রায় ৬০ জন সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে। ২০২৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল রোভার চ্যালেঞ্জে আমরা সায়েন্স মিশনে ফার্স্ট হই। এ বছর প্রথম প্রচেষ্টাতেই ইউনিভার্সিটি রোভার চ্যালেঞ্জে কোয়ালিফাই করি, ৩৮টি অনসাইট টিমের মধ্যে ১৮তম হই। রোবোটিকসের নানা ধরনের গবেষণার সঙ্গেই আমরা যুক্ত। সামনে আন্ডারওয়াটার ভেহিকেল প্রজেক্টও চালু করতে যাচ্ছি।’
মার্স সোসাইটি আয়োজিত ইউনিভার্সিটি রোভার চ্যালেঞ্জে এ বছর নিয়ে টানা চারবার এশিয়ায় প্রথম হয়েছে ইউআইইউ মার্স রোভার দল। দলের মেন্টর, সিএসই বিভাগের প্রভাষক আবিদ হোসেন বলেন, ‘৩-৪ বছর ধরেই বাংলাদেশে রোবোটিকসের ভালো চর্চা হচ্ছে। আমাদের দেশের রোবটের বাজার এখনো বেশ ছোট। সামনে এই বাজার আরও বড় হবে। এ–সংক্রান্ত পড়ালেখা ও গবেষণায় আমরা যদি আরও জোর দিই, সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পাই, তাহলে সামনে আরও ভালো করার সুযোগ আছে।’
আছে সম্ভাবনা, আছে চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে রোবোটিকস–সংক্রান্ত স্টার্টআপের ক্ষেত্রে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে, মনে করেন উদ্যোক্তারা। ডুবোটেক নামের একটি স্টার্টআপের প্রধান নাঈম হোসেন বলছিলেন, ‘হাতে গোনা যে কটি প্রতিষ্ঠান দেশে রোবোটিকস নিয়ে কাজ করে, তাদের মধ্যে আমরা অন্যতম। গত বছর থেকে শুরু করেছি। সামরিক ও বেসামরিক পর্যায়ে আন্ডারওয়াটার রোবট নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমাদের প্রতিষ্ঠানে ১৬ জন প্রকৌশলী আছেন। মহাকাশ, ড্রোন আর আন্ডারওয়াটার রোবট–সংশ্লিষ্ট কাজের চাহিদা কিন্তু সারা বিশ্বেই বাড়ছে। দেশে এখন সাইবারনেটিকস রোবো, ফ্রনটেক লিমিটেড, ধূমকেতু এক্স, চট্টগ্রামে রোবট্রি বাংলাদেশসহ বেশ কিছু স্টার্টআপ বিভিন্নভাবে কাজ করছে।’
রেজওয়ানুল হকের বক্তব্যেও কিছু চ্যালেঞ্জ উঠে এল। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই স্নাতক রোবোটিকস নিয়ে গবেষণা করছেন ১০ বছরের বেশি সময়। তিনি বলেন, ‘দেশে প্রাথমিক পর্যায়ের কাজগুলো করা সহজ হলেও রোবট নিয়ে একটু অ্যাডভান্সড লেভেলের কাজ করা কঠিন। বিদেশ থেকে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ আনতে হয়। বিশেষ করে অনলাইনে পেমেন্ট ও কুরিয়ার ম্যানেজ করতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রয়োজনীয় শিক্ষক বা প্রশিক্ষকের অভাব। আমি শিক্ষাজীবনে পদার্থবিজ্ঞানে পড়ার পাশাপাশি নিজের আগ্রহ থেকে রোবোটিকস নিয়ে কাজ করেছি। এখন শিশু-কিশোর-তরুণ; বিশেষ করে মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য এসআরএইচ নাবিল একাডেমির মাধ্যমে অ্যাডভান্সড রোবোটিকস কোর্স ও কিট তৈরির কাজ করছি। তা ছাড়া বিভিন্ন সামরিক প্রযুক্তি নিয়েও কাজ করছি।’
বাংলাদেশে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রোবোটিকস শেখার সুযোগ দিচ্ছে। স্টিমন বাংলাদেশ, আইটেসারেক্ট, সাইবারনেটিকস রোবো লিমিটেড, রোবোটেক বিডি, দ্য টেক একাডেমি, রোবোডেমি, রোবো টেক ভ্যালিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রোবোটিকস–সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় শেখানো হয়। স্কুল–কলেজের মধ্যে সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল ও কলেজ, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীদের রোবোটিকস নিয়ে কাজের আগ্রহ বেশ চোখে পড়ে। বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের তত্ত্বাবধানে নিয়মিতই ওয়ার্ল্ড রোবট অলিম্পিয়াডে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক এই রোবোটিকস প্রতিযোগিতায় শিশু-কিশোরেরা বিভিন্ন রোবট ডিজাইন, নির্মাণ ও প্রোগ্রামিং নিয়ে কাজ করে। মাত্র ৮ বছরের আরিয়েত্তি ইসলামও এ বছর ২৬তম ওয়ার্ল্ড রোবট অলিম্পিয়াডে স্বর্ণপদক জিতেছে।
আরিয়েত্তিদের হাত ধরেই আরও বহু গবেষণা, আবিষ্কারের সুখবর আসতে পারে, যদি আমরা তাদের যথাযথ সুযোগ করে দিই।