অর্থনৈতিক উন্নয়নের বড় হাতিয়ার হলো শিক্ষা

ভিনসেন্ট চ্যাং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য। চাইনিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের উত্থানের পেছনে তাঁর অবদান আছে। ওমানের একটি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি প্রতিষ্ঠাকালীন প্রেসিডেন্ট। চীনের পিকিং ইউনিভার্সিটির এইচএসবিসি বিজনেস স্কুল তাঁর হাতে গড়া। যুক্তরাষ্ট্রের জেপি মরগান, ম্যাককিনসে, এক্সনমোবিলের মতো নামী প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকেও কাজ করেছেন। এমআইটি, হার্ভার্ড, ইয়েল, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলে এবং ন্যাশনাল তাইওয়ান ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি নিয়েছেন। সম্প্রতি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিয়েছেন তিনি।

ভিনসেন্ট চ্যাং
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে আমরা মহামারির শেষ প্রান্তে পৌঁছেছি। আজ তাই ব্যক্তির ঊর্ধ্বে গিয়ে একটু বড় পরিসরে কথা বলব।

আমরা জানি, বাংলাদেশের লক্ষ্য হলো ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া। শুরুতে কিছু অঙ্ক করা যাক। ধরে নিই, উন্নত দেশ হতে হলে বাংলাদেশের মানুষের গড় বার্ষিক আয় হতে হবে ১০ হাজার মার্কিন ডলার। বর্তমানে সংখ্যাটা প্রায় দুই হাজার। অতএব লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে মানুষের আয় আজকের তুলনায় পাঁচ গুণ বাড়াতে হবে।

এটা কি সম্ভব? যদি সম্ভব হয়, তাহলে কী করা উচিত?

তিন উপাদান

অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল উপাদান মূলত তিনটি—টাকা, প্রযুক্তি ও জনবল। সোলোর গ্রোথ মডেল এমনটাই বলে। জানিয়ে রাখি, রবার্ট সোলো একজন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ, তিনি এমআইটির অধ্যাপক। কিন্তু তাঁর মডেলটা কি আসলেই কাজের? হ্যাঁ। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অর্থনীতির দিকে তাকালেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং, সিঙ্গাপুর এবং পরে চীনেও একই প্রবণতা দেখা গেছে। পূর্ব এশিয়ার এই সব কটি দেশের মধ্যেই একটা জায়গায় মিল। টাকা—শুরুতে তাঁরা ধার করেছে। প্রযুক্তি—কিনেছে বা শুরুর দিকে অনুকরণ করেছে। কিন্তু জনবল? এটাই মূল উপাদান। দক্ষ জনবল তাঁরা পেয়েছে মানসম্মত শিক্ষার ফল হিসেবে। অতএব দেখুন, টাকা, প্রযুক্তি আর জনবল—এই তিন উপাদানই তাঁদের অর্থনীতিকে উন্নত করেছে।

এবার আবার সেই অঙ্কে ফেরা যাক।

২০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি কি এখনকার তুলনায় ৫ গুণ বড় হতে পারে?

তাইওয়ানের একটা বস্তিতে আমি বড় হয়েছি। হাইস্কুলে ওঠার আগ পর্যন্ত আমার কোনো পড়ার টেবিল ছিল না। একাধিক পরিবারের ব্যবহারের জন্য ছিল একটা মাত্র টয়লেট। এক বালতি পানির জন্য আমি আর আমার ভাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতাম।

মিস্টার ওয়াংয়ের গল্প

একটা ঘটনা বললে বোধ হয় বুঝতে সুবিধা হবে। ১০ বছর আগে চীনে আমার মিস্টার ওয়াংয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। নিজ গ্রামের বাড়ি থেকে তিনি শেনজেন শহরে পাড়ি জমিয়েছিলেন কাজের খোঁজে। আইফোনের যন্ত্রপাতি জুড়ে দেয় (অ্যাসেম্বল), এমন এক প্রতিষ্ঠানে তিনি কাজ করতেন। গ্রামে তাঁর আয় ছিল ১০০ ডলারেরও কম। আইফোনের কাজ পেয়ে তাঁর মাসিক আয় দাঁড়ায় ৫০০ ডলার। অর্থাৎ, রাতারাতি আয় বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ। এখন মিস্টার ওয়াংয়ের মাসিক আয় প্রায় দুই হাজার ডলার। ১০ বছরে তাঁর আয় ২০ গুণ বেড়েছে।

ভিনসেন্ট চ্যাং
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

মিস্টার ওয়াং কাজ করেন তাইওয়ানের একটি প্রতিষ্ঠানে। এই প্রতিষ্ঠান চীনের প্রায় ১৩ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করেছে। অতএব মিস্টার ওয়াংয়ের মতো আরও ১৩ লাখ গল্প সেখানে থাকতেই পারে।

বাংলাদেশের মানুষের জীবনেও যদি একই রকম পরিবর্তন আনা যায়, তাহলে হয়তো ২০ বছরে এ দেশের অর্থনীতি ৫ গুণ বড় হওয়া সম্ভব।

তবে এখানে একটা চ্যালেঞ্জ আছে। অর্থনীতিক উন্নয়নের তিন উপাদানের কথা মনে আছে তো? টাকা—সেটা ধার করা যায়। অতএব ধরে নিচ্ছি এটা সমস্যা নয়। প্রযুক্তি—অন্যের অনুকরণ করা যায়। কিন্তু জনবল? এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তো তেমন দক্ষ জনবল তৈরি করতে পারেনি। যদি এখনই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া না হয়, তাহলে এই একটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়েই থাকবে।

গার্মেন্ট শিল্পের সুবাদে বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরা হয় ৭ থেকে ৮ শতাংশ। কিন্তু এই গতি আমরা ধরে রাখতে পারব, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। গার্মেন্ট শিল্প ছাড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির শক্তিশালী হাতিয়ার আর কি কিছু আছে?

আমার বেড়ে ওঠা

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০২০ সালের সামাজিক গতিশীলতা প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে থাকা বিশ্বের ৫ শতাংশ দেশের মধ্যে। সামাজিক গতিশীলতা কম মানে কী? অর্থাৎ একজন রিকশাচালকের সন্তানের ব্যাংকার বা আইনজীবী হওয়ার সম্ভাবনা কম। একজন জেলের সন্তান অধ্যাপক বা চিকিৎসক হবে, সেই সম্ভাবনা কম। বস্তিতে থাকা কোনো ছেলে বা মেয়ে বিজ্ঞানী বা মহাকাশচারী হওয়ার স্বপ্ন দেখবে, সেটা এক রকম অসম্ভব।

সামাজিক বিজ্ঞানী এবং শিক্ষাবিদদের মতে, শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক গতিশীলতার উন্নয়ন সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটু সময় লাগতে পারে।

তাইওয়ানের একটা বস্তিতে আমি বড় হয়েছি। হাইস্কুলে ওঠার আগ পর্যন্ত আমার কোনো পড়ার টেবিল ছিল না। একাধিক পরিবারের ব্যবহারের জন্য ছিল একটা মাত্র টয়লেট। এক বালতি পানির জন্য আমি আর আমার ভাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতাম।

বছর কয়েক পর যখন একটা ব্যবস্থাপনা পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ শুরু করলাম, আমাকে প্রায়ই বিশ্বের নানা দেশে যেতে হতো। তাইওয়ানে গেলে হোটেলে না উঠে মা–বাবার সঙ্গে থাকতাম। অফিসের গাড়ি আমাকে বাড়ি থেকে বিমানবন্দর, কিংবা বিমানবন্দর থেকে বাড়িতে পৌঁছে দিত। এক সকালে বাবা বললেন, ‘যা–ই করো, এমন কিছু কোরো না যাতে আইন লঙ্ঘন হয়।’ আমি কী করি, সেটা বোঝা তাঁর জন্য কঠিন ছিল।

মা আমাকে নিয়ে গর্ব করতেন। বয়স যখন চল্লিশের কোঠায়, আমার প্রতিষ্ঠান আমাকে পূর্ণ বেতনসহ দ্বিতীয় পিএইচডির জন্য অর্থায়ন করল। আমার মা এসব কথা কোনোদিন বন্ধু–স্বজনদের জানাননি। কারণ, বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। এমনকি মায়ের নিজের জন্যও বিশ্বাস করা কঠিন ছিল।

শিক্ষা আমার জীবন বদলেছে। আমি একা নই। আমার প্রজন্মের অনেকের ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য।

আরও একটা লক্ষ্য চাই

উচ্চশিক্ষার বৈশ্বিক মানচিত্রে সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের দেশটির উল্লেখযোগ্য কোনো অবস্থান নেই। তোমাদের কেমন লাগে জানি না। কিন্তু আমি ঠিক গর্ব বোধ করতে পারি না।

একটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয় একটি দেশের বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিচায়ক। একটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে জাতীয় গৌরবের উৎস।

মোদ্দাকথা হলো, অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটা বড় হাতিয়ার হলো শিক্ষা। শিক্ষাই পারে সামাজিক গতিশীলতা আনতে। ব্যবসা আসবে যাবে, ক্ষমতার উত্থান–পতন হবে, কিন্তু একটা ভালো বিশ্ববিদ্যালয় টিকে থাকবে আজীবন।

বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের তালিকায় স্থান পেতে চায়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এটা একটা দারুণ আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু আমি পরামর্শ দেব, এর সঙ্গে আরও একটা লক্ষ্য যোগ করা উচিত। আর তা হলো: ২০৪১ সালের মধ্যে অন্তত একটি বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পাবে বিশ্বের সেরা ১০০–এর তালিকায়।

এটা কি সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব। আমি নিজের চোখে দেখেছি। কোরিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয় ৩০ বছরের মধ্যে বিশ্বসেরা শতকের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। হংকংয়ের একটি বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের ওপরের সারির ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থান পেয়েছে ২০ বছরের মধ্যে।

অতএব দেশের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের প্রতি আমার আবেদন—শিক্ষাকে জাতীয় এজেন্ডার একদম ওপরে স্থান দিন। স্রেফ দর্শক হয়ে থাকবেন না। স্রেফ সমালোচক হবেন না। মাঠে নামুন। জামার হাতা গুটিয়ে নিন। আঘাত করুন। পাল্টা আঘাতের মোকাবিলা করুন। কিন্তু ২০৪১ সালের মধ্যে বিশ্বসেরা ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় জায়গা নিশ্চিত করে ছাড়ুন। (ঈষৎ সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত)

ইংরেজি থেকে অনূদিত