বাবা থাকলে জীবন কেমন হতো জানি না, তবে মা আমার সব শূন্যতা পূরণ করে দিয়েছেন
প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার বিশ্বজুড়ে পালিত হয় মা দিবস। সেই হিসাবে আগামীকাল মা দিবস। দিনটি উপলক্ষে মাকে নিয়ে পাঠকের কাছে লেখা আহ্বান করেছিল প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’। নির্বাচিত একটি লেখা পড়ুন এখানে।
আমার বড় বোন যখন সবে ক্লাস টুয়ে পড়ে আর আমি মায়ের আঁচল ধরে হাঁটতে শিখছি, ঠিক তখনই আব্বু হঠাৎ মারা গেলেন। বাবার কোনো স্মৃতিই আমার নেই। যখন স্মৃতি জমতে শুরু করল, তখন বুঝলাম, সিঙ্গেল প্যারেন্ট হিসেবে মা আমাদের লালন–পালনের দায়িত্ব নিয়েছেন, সমাজের সব সংকীর্ণতা, প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে আমাদের দুই বোনকে সামলে রাখছেন। তিনি শুধু মা নন, হয়ে উঠলেন বাবা, অভিভাবক, বন্ধু, শিক্ষক—সব।
প্রতিদিন সকালে উঠে, আমাদের জন্য সবকিছু গুছিয়ে অফিসে ছুটতেন। বিকেলে ফিরতেন ক্লান্ত হয়ে, কিন্তু মুখে হাসি লেগেই থাকত। যেন তিনি আমাদের শেখাতে চান—কোনো কিছুই অসম্ভব নয়, যদি মন থেকে চাও।
প্রাইমারি স্কুলে পড়ি তখন। ছোট্ট একটা ছেলেমানুষি ভুলে হয়তো মা একটু রেগে গিয়েছিলেন। স্কুলে যাওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে তিনি আমাকে একটি চড় মারলেন। আমি চোখে জল নিয়ে, গাল ফুলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম স্কুলের পথে। মনে রাগ, কষ্ট আর অভিমান। বারবার খালি মনে হচ্ছিল, ‘মা কেন এমন করলেন?’
সেই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য স্কুলে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পরই পেয়েছিলাম।
আমার মা, সংসারের হাজারটা দায়িত্ব সামলে সকালেই যার অফিসে যাওয়ার কথা, সেই মা হঠাৎ টিফিনের সময় আমাদের ক্লাসরুমে হাজির। হাতে খাবার নয়, মুখে হাসিও নয়, খালি চোখে একরাশ অপরাধবোধ। শুধু বললেন, ‘তুই ঠিক আছিস তো?’
ওই একটা প্রশ্নেই বুঝে গিয়েছিলাম—মা আমাকে মেরে নিজেকেই শাস্তি দিয়েছেন সারাটা সকাল। আমি যেভাবে গালে ব্যথা পেয়েছিলাম, মা ঠিক সেভাবেই ব্যথা পেয়েছিলেন মনে।
আমাদের সংসার তখন কিছুটা অসচ্ছল। বাবা নেই, মায়ের কাঁধেই সব দায়িত্ব। কোনো খেলনা দোকানের শোকেসে চোখে পড়লে বুঝতাম, ওটা আমার জন্য নয়। দামি জিনিস আমাদের বাসায় আসে না। কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো—আমি কোনো কিছু মন থেকে চাইলে, কিছুদিন পরই সেটা মায়ের হাতে। তখন বুঝিনি, মা নিজের প্রয়োজনের কত কিছু বাদ দিয়েছেন, নিজের স্বপ্নগুলোকে পেছনে ঠেলে দিয়েছেন, শুধু আমার হাসিটুকুর জন্য।
আমি যখন বলতাম না, তখনো মা বুঝে ফেলতেন আমার মনের ইচ্ছাগুলো। কীভাবে ম্যানেজ করতেন জানি না, কিন্তু কখনোই আমাকে না বলতেন না। এখন বুঝি, ওই না–বলাটাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা শব্দে প্রকাশ করা যায় না, কেবল অনুভব করা যায়।
বাবা থাকলে জীবন কেমন হতো—সে অভিজ্ঞতাও আমার নেই। কিন্তু জানি, যিনি আমার সব শূন্যতা পূরণ করে দিয়েছেন, তিনি আমার মা। আমার সব এলোমেলো জীবনের শেষ আশ্রয়। তাঁর কোলে মাথা রাখলেই সব ভয় দূর হয়ে যায়, তাঁর মুখের একটুকু হাসি আমাকে আশ্বাস দেয়—‘তুমি পারবে।’
আজ আমি যখন নিজে একজন কর্মজীবী নারী, বুঝি মায়ের লড়াইয়ের গভীরতা। বুঝি, আমাদের হাসি-খুশির পেছনে লুকিয়ে ছিল তাঁর অগণিত না–বলা কষ্ট, নির্ঘুম রাত আর একাকিত্বময় দিন।
লেখক: আইনজীবী, জজকোর্ট, ঢাকা