আসবাব যেভাবে অফিসের কাজে প্রভাব ফেলে

 একটা সময় অফিসের জন্য বেছে নেওয়া হতো কাঠের ভারিক্কি আসবাব। বড়বাবুর জন্য থাকত বাঁকা হাতওয়ালা চেয়ার। আসবাবের রংও কাঠের রঙেই রাখা হতো বেশি। তবে এখন অফিসের আসবাব করা হচ্ছে থিমনির্ভর। ব্যবহৃত হচ্ছে উজ্জ্বল রং। গবেষণা বলছে, উজ্জ্বল রঙে অফিসের পরিবেশে আসে কর্মচাঞ্চল্য ভাব। অফিসের ব্র্যান্ডের কোনো নির্দিষ্ট রং থাকলে আসবাবে সেটিও দেখা যাচ্ছে। আজকের দিনে অফিস আসবাবের উপকরণ হিসেবে কাঠের ব্যবহার নেই বললেই চলে। বরং মেলামাইন লেমিনেটেড বোর্ড এখন জনপ্রিয়। অফিসের ধরন, আয়তন এবং কর্মীদের প্রয়োজন অনুযায়ী এই বোর্ড দিয়ে তৈরি করিয়ে নেওয়া যায় নানা নকশার আসবাব। রঙেও আনা যায় বৈচিত্র্য। আর এসব বোর্ড টেকসইও বটে। এমনটাই বলছিলেন সৃষ্টি আর্কিটেকচার অ্যান্ড কনসালট্যান্সির স্বত্বাধিকারী স্থপতি তাসনিম তূর্যি।

পরিবর্তনের হাওয়া

আজকাল প্রকৃতিকেও নিয়ে আসা হয় অফিসের মাঝে। অফিসের নানান স্থানে রাখা হয় অন্দর উপযোগী গাছ।
ছবি : কবির হোসেন

আসবাব তৈরির প্রতিষ্ঠান হাতিলের পরিচালক সফিকুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশে বাসাবাড়ির আসবাবের মতো অফিস আসবাবের ধারায়ও পরিবর্তন বেশ লক্ষণীয়। ১০-১৫ বছর আগের একটি অফিসের সঙ্গে এখনকার একটি অফিসের চিত্র তুলনা করলেই এটি বোঝা যায়। এখনকার অফিসগুলো অনেক বেশি গোছানো। অফিসের অন্দরসজ্জা, নকশা ও আসবাব বাছাইয়ে এখন আধুনিকতা, মিনিমালিজম এবং ওপেন স্পেসকে গুরুত্ব দিচ্ছেন কর্তারা। কর্মীদের স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করে কর্মসহায়ক পরিবেশ গড়ে তোলার দিকে বাড়তি খেয়াল দেওয়া হয়।’

সফিকুর রহমান আরও জানালেন, অনেকেই আজকাল আধুনিক ধারার মডিউলার আসবাব পছন্দ করেন। কাঠের তুলনায় এসব আসবাব অনেকটাই হালকা। ফলে সহজেই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরানো যায়। প্রয়োজনে এসব আসবাবের আকার-আকৃতিতেও পরিবর্তন আনা যায়। কাঠের তুলনায় দামেও সাশ্রয়ী। তাই এসব আসবাব বেশ গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। হালকা রং ও নকশার পাতলা আসবাব আধুনিক অফিসের উপযোগী। সুইভেল চেয়ার, এক্সিকিউটিভ টেবিল, কনফারেন্স টেবিলসহ অন্দরসজ্জার নানান উপকরণই পাওয়া যায় হাতিলে।

অফিস যেমনই হোক

অনেক অফিসেই এখন কর্মীর স্বস্তিকে প্রাধান্য দিয়ে তৈরি হয় আসবাব
ছবি : কবির হোসেন

আসবাব তৈরির প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বসে নিজেদের চাহিদামতো আসবাব তৈরি করে নেয় অনেক প্রতিষ্ঠান। ‘বহু’র ডিজাইনার নাবিলা নওরিন বললেন অফিসের প্রথাগত ডেস্ক, টেবিল, চেয়ারের ধারণার বাইরে আধুনিক ধারার কথা। হাইব্রিড মডেল অফিসে খোলামেলা জায়গায় যখন যাঁর যেখানে প্রয়োজন, তখন তিনি সেখানেই বসে পড়ছেন কাজ নিয়ে। নিজের ডেস্কে বসেই যে সব সময় কাজ করতে হবে, এমন ধরাবাঁধা নিয়ম অনেক অফিসেই এখন নেই। এমন অফিসে খোলামেলা ওয়ার্কটপ হলেই চলে। তবে কেউ কেউ আবার অতটা খোলামেলা আয়োজনে কাজ করতে পারেন না। মনোযোগের জন্য তাঁদের একটু নিজস্ব জায়গার প্রয়োজন হয়।

সবাই আবার ডেস্কটপ কম্পিউটার ব্যবহার করেন না। ল্যাপটপ বা মুঠোফোনেও কাজ করেন কেউ কেউ। সে ক্ষেত্রে বসার জন্য একটু আরামদায়ক আয়োজন রাখা যেতে পারে। সোফা কিংবা হাই ব্যাক কমিউনাল সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট এমন স্বস্তিদায়ক ব্যবস্থা। কর্মীর স্বস্তির বিষয়টাকেই গুরুত্ব দিলেন তিনি। তাপমাত্রা বা আর্দ্রতার মতো আবহাওয়া-সংক্রান্ত বিষয়, লোডশেডিং প্রভৃতি মাথায় রেখেই অফিসের অন্দর কর্মিবান্ধব করে তৈরি করার পরামর্শ দিলেন তিনি। আসবাব বাছাইয়ের বেলায়ও খেয়াল রাখতে বললেন এসব বিষয়।

টেকসই কিন্তু নান্দনিক

কো–ওয়ার্ক স্টেশনে এভাবে পাশাপাশি বসে কাজ করতে পারেন কর্মীরা
ছবি : কবির হোসেন

অফিসের ধরনে ভিন্নতার কারণে গ্রাহকের চাহিদাও হয় ভিন্ন ভিন্ন। আসবাবের নকশায় নান্দনিকতাকে যেমন গুরুত্ব দিতে হবে, তেমনি একটি আসবাব টেকসই হবে কি না, সেদিকেও খেয়াল রাখা জরুরি। তা ছাড়া যেকোনো আসবাব থেকে একজন গ্রাহক যাতে সবচেয়ে বেশি কার্যকারিতা পান, সেই দিকও বিবেচনায় রাখা উচিত। একটি আসবাব সেই অফিসের সামগ্রিক পরিবেশের সঙ্গে মানাচ্ছে কি না, সেটিও খেয়াল রাখা প্রয়োজন। অফিসে খোলামেলা জায়গা থাকলে সেখানকার আসবাবের চাহিদা এক রকম, ব্যক্তিগত কক্ষের জন্য অন্য রকম। একটি প্রতিষ্ঠানের অফিস ক্যাবিনেট, কনফারেন্স টেবিল, এক্সিকিউটিভ টেবিল, অফিস চেয়ার, এক্সিকিউটিভ চেয়ার, ওয়ার্ক চেয়ার, ভিজিটরস চেয়ার, ওয়ার্ক পড, ওয়ার্কস্টেশন, অফিস সোফা ইত্যাদি সেই অফিস সম্বন্ধে দর্শনার্থীদেরও দিতে পারে প্রাথমিক ধারণা। তাই আসবাব নির্বাচনে ভুল করা চলবে না বলে মনে করেন অন্দরসজ্জাবিদেরা।

উপকরণ ও রঙের বৈচিত্র্য

কাচের ওপারে স্বচ্ছ মিটিং রুম। কৃতজ্ঞতা : ডিজাইন আর্ক
ছবি : কবির হোসেন

বোর্ড ছাড়াও ধাতব উপকরণ, প্লেক্সি গ্লাস, এমনকি প্লাস্টিকের মতো উপকরণের ব্যবহারে আসবাব হয় বৈচিত্র্যময়। আসবাবের ভিত্তি এবং যেসব অংশ ভার বহন করে, সেখানে ধাতব উপকরণ দেওয়া যায়। অর্থাৎ আসবাবে রাখা হচ্ছে একাধিক উপকরণের সমন্বয়। ক্যাবিনেটের মতো আসবাবের বেলায়ও তা–ই। প্রতিষ্ঠানের ধরন অনুযায়ী রংটা বেছে নেওয়া হয়। রঙিন আসবাবে উজ্জ্বল রঙের সঙ্গে একটু ভিন্ন ধাঁচের রঙের সমন্বয়ও বেশ জনপ্রিয়। আসবাবের এই ধাতব অংশে সাদা, কালো বা ধূসরের মতো রং সমসাময়িক ধারায় ব্যবহার করা হচ্ছে। মেলামাইন লেমিনেটেড বোর্ড ব্যবহার করলে ভিন্ন ভিন্ন শেড থেকে পছন্দের রংটা বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকে। পুরোনো দিনের কাঠের আসবাবের আমেজ পেতে কাঠের টেক্সচারের মতো দেখায়, এমন কাজও করা হয় কিছু মেলামাইন বোর্ডের লেমিনেশনে। হালকা নকশার আধুনিক আসবাবে কেবল হালকা রঙের ব্যবহারেও অফিসে আসে দারুণ পরিপাটি লুক। আবলুস, আমেরিকান টিক অথবা এন্টিক রং কিন্তু আধুনিক ধারায় বেশ মানায়। বাজেট বেশি থাকলে অবশ্য ভিনিয়ার বোর্ড দিয়েও আসবাব তৈরি করা যেতে পারে। এগুলোও আধুনিক ধারার উপযোগী।

আসবাবে আধিক্য নয়

আসবাবের উচ্চতা, গড়ন, ধরন-ধারণ—সব মিলিয়ে পুরো নকশাতেই থাকতে হবে পরিমিতি, যাতে ফুটে উঠবে রুচির ছাপ। কৃতজ্ঞতা: হাতিল
ছবি : কবির হোসেন

আসবাবের সংখ্যা এবং নকশায় মিনিমালিজমটাই অফিসের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য। ভারী কারুকাজ ঠিক অফিসের উপযোগী নয়। নকশার আধিক্য ছাড়াই আসবাবে আনা যায় আধুনিকতা। রঙের বৈচিত্র্য তো থাকেই। তবে একেবারে ছোট জায়গায় আবার খুব উজ্জ্বল বা গাঢ় রঙের আসবাব কিংবা বেশ বড়সড় আসবাব বেমানান। সেখানে হালকা রঙের পাতলা ও মসৃণ ধাঁচের আসবাবেই চোখে আসে আরাম। বড় জায়গায় আবার গাঢ় রঙে আসে আভিজাত্য। আসবাবের সংখ্যার ক্ষেত্রেও একই কথা। একটা জায়গায় অনেক বেশি আসবাব সাজিয়ে রাখা হলেও তা অগোছালো দেখায়। আসবাবের উচ্চতা, গড়ন, ধরন-ধারণ—সব মিলিয়ে পুরো নকশাতেই থাকতে হবে পরিমিতি, যাতে ফুটে উঠবে রুচির ছাপ। কর্মীর প্রয়োজনটা যেমন দেখতে হবে, তেমনি দেখতে হবে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় একটি আসবাবের প্রযোজ্যতা।

আধুনিকতায় যেমন

অফিস বুঝে আসবাব বেছে নিতে হবে। কৃতজ্ঞতা : হাতিল
ছবি : কবির হোসেন

আপনার হয়তো অফিসের জন্য ঠিক গৎবাঁধা আকার-আকৃতির আসবাব পছন্দ নয়। আপনি চান ভিন্ন কিছু। কিন্তু এমন কিছু একটা আপনার পছন্দ হলো, যেটি আবার আপনার অফিসে রাখা হলে আশপাশে আর তেমন জায়গাই থাকে না। তাহলে কিন্তু মুশকিল। আসবাব বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অফিসের আয়তন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোন জায়গার জন্য ঠিক কোন আসবাবটি জুতসই, আসবাবের দোকানে গিয়ে তা ঠিক করাটা অনেক সময় মুশকিল হয়ে পড়ে। অনেকে তাই ফরমাশ দিয়ে আসবাব গড়িয়ে নিতে চান।

টেবিল, ক্যাবিনেট, ডেস্ক—এমন নানান কিছুই বোর্ড দিয়ে গড়ে নেওয়া যায়। নকশায় থাকে আধুনিকতার ছোঁয়া। নিজের পছন্দমতো টুকিটাকি বিষয় বলে দেওয়ারও সুযোগ থাকে। এভাবে সুবিধামতো জায়গায় ওয়ার্কস্টেশন তৈরি করিয়ে নেওয়া যেতে পারে। বিদ্যুৎসাশ্রয়ী ভাবনা থেকে ওয়ার্কস্টেশন গড়া হয় এমন জায়গায়, যেখানে প্রাকৃতিক আলো আসে। প্রাকৃতিক আলো পেতে এখন অফিসের জানালায় পর্দার পরিবর্তে ব্লাইন্ড ব্যবহারেরও চল হয়েছে।

প্রকৃতিকে কিন্তু আজকাল নিয়েও আসা হয় অফিসের মাঝে। অন্দরের উপযোগী গাছ রাখা হয় অফিসের নানান স্থানে। প্রতিষ্ঠানের কর্মপন্থা, কাজের ধরন প্রভৃতি বিষয়কে সামনে রেখে কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করতে নানান কিছু লিখেও রাখা হয় অফিসের বিভিন্ন জায়গায়। পেইন্টিংও রাখা থাকে। সব মিলিয়ে একটা ইতিবাচক কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করার দিকেই বেশি মনোযোগী থাকেন আধুনিক প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা। তাই আমূল বদল এসেছে অফিসের আসবাবে।