সৌম্য-দিব্যর কাব্য

ওপাশে ফোন তুলতেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনিই তো কাইজার–এর অনন্ত, তাই না?’ উত্তর এল, ‘আমি না, ওটা সৌম্য।’ সৌম্যর সঙ্গে যখন কথা বলছি, হাসতে হাসতে এক মজার গল্প বললেন। ওয়েব সিরিজ কাইজার–এর সাকসেস পার্টিতে দিব্যকেও নিয়ে গিয়েছিলেন সৌম্য। অনেকেই এগিয়ে এসে দিব্যর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘খুব ভালো। কাজটা খুব ভালো হয়েছে। তুমি তো চরিত্রটার পালস ধরতে পেরেছ।’ এমনকি পরিচালক তানিম নূর পর্যন্ত কনফিউজড! কাকে সিরিজে নিয়েছিলেন?

বেশ কয়েকটি কোম্পানির অ্যান্ড্রয়েড ফোন পর্যন্ত তাঁদের আলাদা করতে পারে না। সৌম্যর ফোনের ‘ফেসলক’ দিব্য তাকালেই দিব্যি খুলে যায়। আর দিব্যর ব্যাপারেও ঘটছে একই ঘটনা।
সৌম্য জ্যোতি আর দিব্য জ্যোতি জমজ দুই ভাই
ছবি: কবির হোসেন

সৌম্য জ্যোতি আর দিব্য জ্যোতিকে নিয়ে হয়েছে মহাযন্ত্রণা! সৌম্য গ্রামীণফোনের বিজ্ঞাপন করেন। আর দিব্যকে শুনতে হয়, ‘কাজটা কিন্তু ভালো হয়েছে।’ এদিকে দিব্য অ্যান্টি-টেররিজমের বিজ্ঞাপন করেন। আর লোকে সৌম্যকে এসে বাহবা দেয়। ঘটনা এই পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলেও ঠিক ছিল। কিন্তু না, বেশ কয়েকটি কোম্পানির অ্যান্ড্রয়েড ফোন পর্যন্ত তাঁদের আলাদা করতে পারে না। সৌম্যর ফোনের ‘ফেসলক’ দিব্য তাকালেই দিব্যি খুলে যায়। আর দিব্যর ব্যাপারেও ঘটছে একই ঘটনা। তাই এক ভাই আরেক ভাইয়ের কাছ থেকে ‘প্রাইভেসি’ বাঁচাতে কপালে ভাঁজ ফেলছেন।

অল্প সময়ে স্বল্প কাজ দিয়েই সম্প্রতি আলোচনায় এসেছেন ছোট পর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী শাহনাজ খুশি ও নাট্যকার বৃন্দাবন দাস দম্পতির যমজ পুত্র সৌম্য জ্যোতি ও দিব্য জ্যোতি। আকরাম খান পরিচালিত নকশিকাঁথার জমিন সিনেমায় অভিনয় করেছেন এই দুই ভাই। এ সিনেমায় যুক্ত হওয়া কীভাবে? ‘চঞ্চল চৌধুরী তো আমাদের পরিবারেরই একজন। উনি একটা চরিত্র থেকে আরেকটা চরিত্রে ঢুকতে মাঝে একটু বিরতি নেন। সেই বিরতিতে আমরা সবাই মিলে দুই মাইক্রো নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম চঞ্চলের গ্রামের বাড়ি পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার কামারহাট গ্রামে। একেবারে পদ্মা ঘেঁষে তাঁদের বাড়ি। আমি তো লুঙ্গি পরে ঝাঁপিয়ে পড়ি নদীতে। তাই দেখে আকরাম আঙ্কেল ঠিক করেছিলেন, আমাকে তাঁর ছবিতে নেবেন। সৌম্যকে শেষ মুহূর্তে কাস্ট করা হয়।’

এই দুই ভাই-ই অভিনয় করেছেন বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকে, বঙ্গবন্ধুর ছোটবেলার চরিত্রে
ছবি: কবির হোসেন

দিব্য আর সৌম্য দুজনেই বঙ্গবন্ধুর ছোটবেলার চরিত্র করেছেন। শ্যাম বেনেগাল পরিচালিত বঙ্গবন্ধুর অফিশিয়াল বায়োপিকে আছেন দিব্য। অন্যদিকে সৌম্য করছেন মুশফিকুর রহমান গুলজার পরিচালিত বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক। বেশ কয়েকটি নাটকেও দেখা দিয়েছেন এই দুই ভাই। তবে আপাতত পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। সৌম্য-দিব্য দুজনই পড়েন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষে। সৌম্য ইংরেজি সাহিত্যে আর দিব্য অর্থনীতিতে। বললাম, অভিনয়টা তো ভালোই করছেন। এটাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার ইচ্ছা আছে? দুই ভাইয়ের উত্তর এল একই রকম। ‘আগে টিভিতে নাটক দেখতাম। আর মায়ের অভিনয়ের খুঁত ধরতাম। এখন নিজেরা যখন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে অভিনয় করি, হাড়ে হাড়ে টের পাই অভিনয় কতটা কঠিন, চ্যালেঞ্জিং আর কষ্টের কাজ। অভিনয়কে পেশা হিসেবে নিয়ে টানা ২০–৩০ বছর ক্যারিয়ারের ক্রিজে টিকে থাকা সহজ কথা নয়। তাই আপাতত পড়াশোনায় মন দিয়েছি। যাতে অভিনয়ে ফেল মারলে অন্যকিছু করে খেতে পারি।’

সম্প্রতি কার কোন কাজটা দেখে মনে হয়েছে যে আপনারাও এ রকম শক্তিশালী অভিনেতা হতে চান? উত্তর এল, ‘প্রথম দিন দেখলাম পরাণ। পরের দিন হাওয়া। এই দুই সিনেমায় শরীফুল রাজ একেবারে আলাদা দুটি চরিত্র করেছেন। দুটি চরিত্রই এত বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে করেছেন যে মনে হলো, আমরা দুজন বড় হয়ে রাজ ভাইয়ের মতো এ রকম অভিনয় করব।’
ছোট পর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী শাহনাজ খুশি ও নাট্যকার বৃন্দাবন দাস দম্পতির যমজ পুত্র সৌম্য জ্যোতি ও দিব্য জ্যোতি
ছবি: কবির হোসেন

কেবল এই প্রশ্নের ক্ষেত্রেই নয়, আরও একটি প্রশ্নেও একই জবাব দিলেন দুই ভাই। জানতে চাইলাম, সম্প্রতি কার কোন কাজটা দেখে মনে হয়েছে যে আপনারাও এ রকম শক্তিশালী অভিনেতা হতে চান? উত্তর এল, ‘প্রথম দিন দেখলাম পরাণ। পরের দিন হাওয়া। এই দুই সিনেমায় শরীফুল রাজ একেবারে আলাদা দুটি চরিত্র করেছেন। দুটি চরিত্রই এত বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে করেছেন যে মনে হলো, আমরা দুজন বড় হয়ে রাজ ভাইয়ের মতো এ রকম অভিনয় করব।’ এ ছাড়া এই দুই ভাইয়ের প্রিয় অভিনেতাদের তালিকায় আছেন হুমায়ুন ফরীদি, নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী, সব্যসাচী চক্রবর্তী, ফজলুর রহমান বাবু, চঞ্চল চৌধুরী।

এটা সত্যি যে আমার বাবা–মায়ের সন্তান হওয়ার কারণে আমাদের প্রথম কাজটা পাওয়া সহজ হয়েছে। তবে এটাও সত্যি যে কাজটা যদি আমরা ভালো না করি, তাহলে আর কাজ পাব না। টিকে থাকতে পারব না।
সৌম্য ও দিব্য

বয়সে যদি ছোট-বড় করতেই হয়, তবে দিব্য সৌম্যর এক মিনিটের বড়। ছোটবেলায় এই এক মিনিটের বড় হওয়া নিয়ে দিব্যর বেশ গর্ব ছিল। বড় ভাই–জাতীয় একটা কলার উঁচু রাখা ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে চলার চেষ্টা করতেন। তবে সৌম্যর কাছ থেকে বিশেষ পাত্তা না পেয়ে সেই ভাব নেওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। সৌম্য-দিব্যর আসলে সেভাবে ছেলেবেলা বলে কিছু নেই। বাবা-মায়ের সুবাদে ছোটবেলা থেকেই ঘরে চঞ্চল চৌধুরী, মোশাররফ করিম, আজিজুল হাকিম, সালাহউদ্দিন লাভলু, আজাদ আবুল কালাম, প্রাচ্যনাটের আড্ডা। সেই আড্ডার সঙ্গী হয়েই একটু একটু করে বড় হয়েছেন। তারপর ছিল ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনার চাপ। সেই সময় বৃহস্পতিবার ক্লাস করেই চলে যেতেন মায়ের অভিনয়ের সেটে। শুক্র, শনি সেখানেই থেকে একবারে রোববার সেটের গাড়ি দিয়ে আসত স্কুলে। আরও একটু বড় হয়ে স্কুলে ফুটবল খেলতেন। একদিন যুক্ত হয়ে গেলেন অভিনয়ের সঙ্গে। সৌম্য বললেন, ‘এটা সত্যি যে আমার বাবা–মায়ের সন্তান হওয়ার কারণে আমাদের প্রথম কাজটা পাওয়া সহজ হয়েছে। তবে এটাও সত্যি যে কাজটা যদি আমরা ভালো না করি, তাহলে আর কাজ পাব না। টিকে থাকতে পারব না।’

অল্প সময়ে স্বল্প কাজ দিয়েই সম্প্রতি আলোচনায় এসেছেন সৌম্য আর দিব্য
ছবি: কবির হোসেন

নিজেদের অভিনয় নিয়ে সৌম্য বা দিব্য কারোরই খুব একটা ভরসা না থাকলেও মায়ের আছে। ছেলেদের অভিনয় কেমন লাগে জানতে চাইলে শাহনাজ খুশি ফিরে গেলেন ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে। বললেন, ‘ক্যামেরার সামনে সাবলীল হতে আমার বেশ সময় লেগেছে। কিন্তু ওদের মধ্যে নার্ভাসনেস ব্যাপারটাই নেই। ওরা যদি কাজটাকে এভাবেই মনেপ্রাণে ভালোবেসে চালিয়ে নেয়, টিকে যাবে। ওদের কিছু ভালো কাজ রয়ে যাবে।’