পাহাড়ের নারীরা কেন স্কুটারে স্বচ্ছন্দ

খাগড়াছড়ি জেলায় প্রতিদিন বাড়ছে স্কুটার চালানো নারীদের সংখ্যা
ছবি: জয়ন্তী দেওয়ান

একসময় পাহাড়ে শুধু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার নারী কর্মীরাই স্কুটি চালাতেন। তা–ও হাতে গোনা কয়েকজন। সময় বদলেছে। কেটেছে জড়তা। এখন পাহাড়ে নারী–পুরুষ কর্মজীবী–শিক্ষার্থীনির্বিশেষে স্কুটার ব্যবহার করছেন। যোগাযোগের সহজ মাধ্যম হিসেবে বেড়েই চলেছে স্কুটারের জনপ্রিয়তা। অর্থ ও সময় সাশ্রয়ের বিষয়টি তো আছেই। কর্মজীবী ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্কুটি এখন বিলাসিতা নয়, প্রয়োজন।

খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালের চিকিত্সক রাজর্ষী চাকমার একসময় শখ ছিল স্কুটি চালানোর। প্রতিদিন তাঁকে সন্তানের স্কুল থেকে শুরু করে হাসপাতাল, চেম্বারসহ বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে হয়। তিনি যে এলাকায় থাকেন, সেখানে সব সময় টমটম বা রিকশা পাওয়া যায় না। বাস্তবতা ও সময়ের কথা চিন্তা করে ১০ বছর আগে স্কুটি কিনেছিলেন। চালানো শিখেছিলেন তিন দিনে। এর পর থেকে স্কুটিই তাঁর চলার নিত্যসঙ্গী।

রাজষ৴ী চাকমার মতো আরেকজন কর্মজীবী নারী স্নিগ্ধা রোয়াজা। তিনি খাগড়াছড়ির মহালছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা। থাকেন মহালছড়িতে। খাগড়াছড়ি শহরে প্রথম দিকে যে কজন নারী স্কুটার চালাতেন, তাঁদের মধ্যে তিনি একজন। স্কুটি চালান ২০ বছর। বর্তমানে চালাচ্ছেন ১২৫ সিসি ইয়ামাহা কোম্পানির স্কুটার। তিনি বলেন, ‘আগে প্রতিদিন শুরুতে টমটম, এরপর বাস, মাহিন্দ্র অথবা পিকআপের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। অপরিচিত লোকজনের সঙ্গে চলাচলের অসুবিধার কথা ভেবে স্কুটি কেনার সিদ্ধান্ত নিই। এখন সময়ও বাঁচে আর স্বাচ্ছন্দ্যেও চলতে পারি। নিজের ইচ্ছেমতো থামতে পারি, কেনাকাটা করতে পারি।’

খাগড়াছড়িতে নারী স্কুটি চালকদের বড় গ্রুপ আছে
ছবি: জয়ন্তী দেওয়ান

এই মুহূর্তে খাগড়াছড়ি জেলায় কতজন নারী স্কুটার চালাচ্ছেন, তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। তবে এই সংখ্যা দুই শর ওপরে হবে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিপণনকেন্দ্রের কর্মকর্তারা। সেখানে পুরুষদের কাছেও স্কুটার জনপ্রিয় এক নাম।

খাগড়াছড়ি শহরে ২৭ বছর আগে মোটরসাইকেল চালানো শুরু করেন স্নিগ্ধা চাকমা। তিনি বলেন, ‘২৭ বছর আগে আমি হিরো হোন্ডা চালাতাম। সে সময় জেলায় হাতে গোনা তিন-চারজন নারী মোটরসাইকেল চালাতেন। তখন মোটরসাইকেল চালাতে দেখলে সবাই এমনভাবে তাকাতেন যেন এই বাহন শুধু পুরুষদের জন্য তৈরি হয়েছে! এখন রাস্তায় বের হলেই নারীদের স্কুটি চালাতে দেখা যায়। শুনেছি খাগড়াছড়িতে এখন দুই শর বেশি নারী স্কুটারচালক আছে। নারীদের এই এগিয়ে আসাটাকে সাধুবাদ জানাই। তবে হেলমেট পরা ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক, এই সেফটি নিজের জন্যই মানতে হবে।’

আরও পড়ুন

নারীদের স্কুটারে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ও ছাড় দিচ্ছে খাগড়াছড়ির বিক্রয়কেন্দ্রগুলো। খাগড়াছড়িতে টিভিএস একতা মোটরসের বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের কর্মকর্তা মনোতোষ ত্রিপুরা বলেন, ‘চলতি মাসে স্কুটি বিক্রি করেছি ১৫টি, তার মধ্যে ১১টিই কিনেছেন নারীরা। কোনো নারী স্কুটি কিনতে এলে আমরা তাঁদের বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা করে থাকি। এ ছাড়া নারীদের জন্য সহজ কিস্তিতে আমরা স্কুটার দিয়ে থাকি।’

আঁকাবাঁকা পথে চলছে স্কুটার
ছবি: জয়ন্তী দেওয়ান

গানের শিক্ষক চমচমি চাকমা বলেন, ‘সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে আমাকে বিভিন্ন জায়গায় আসা-যাওয়া করতে হয়। তা ছাড়া জেলা শহরের বাইরের দুটি উপজেলায় গিয়ে আমি টিউশনি করেছি। অনেক সময় অনুষ্ঠান থাকলে সেখানে সময়মতো পৌঁছাতে নিজের বাহনের প্রতিই আস্থা রাখতে পারি। স্কুটি আমার প্রতিদিনের জীবনটা সহজ করে দিয়েছে। আগে যেখানে যেতে ৪০ টাকা প্রয়োজন হতো, এখন সেখানে ২০ টাকার তেলেই চলে যেতে পারি। তবে মাঝেমধ্যে রাস্তায় হয়রানির শিকার হতে হয়। যেটা না থাকলে আরও ভালো হতো।’

দুই বছর আগে খাগড়াছড়িতে স্কুটি চালানো বিভিন্ন পেশার ৬০ জন নারী মিলে গড়ে তুলেছেন ‘লেডি বাইকার গ্রুপ’। এই গ্রুপের সদস্যরা মিলে বিভিন্ন সময়ে ঘুরতে যান জেলা ও জেলার বাইরে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে। এ ছাড়া তাঁরা বিভিন্ন সামাজিক কাজ করেন। তাঁদের এই কমিউনিটিতে নিয়মিত লোকজন বাড়ছে। স্কুটার–সংক্রান্ত যেকোনো সমস্যার সমাধানে দ্রুত একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়ান। সব মিলিয়ে নারীদের এই গ্রুপ নানা দিক থেকে সক্রিয়।

খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার মুক্তা ধর বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কোনো নারী হয়রানি হয়েছেন বলে অভিযোগ নেই। তবে কেউ ইভ টিজিং বা হয়রানির অভিযোগ নিয়ে এলে গুরুত্বের সঙ্গেই সেটাকে দেখা হবে।’