নতুন বছরের প্রথম দিন নিয়ে প্রতিবারই নেলির নানা রকম পরিকল্পনা থাকে। বেশির ভাগই ছেলেমানুষি পরিকল্পনা। যেমন বছরের প্রথম দিন সে আমাকে নিয়ে গাছের চারা কিনতে যাবে বেইলি রোডের ওই দিকে, দরদাম করে কিনবে, কিংবা রিকশায় করে নিউমার্কেটের দিকে ঘুরবে। চলতি পথে কিছু পছন্দ হয়ে গেলে রিকশা থেকে নেমে কেনার আবদার করবে।
আমি প্রতিবারই এসব পরিকল্পনা ভেস্তে দিই নানা অজুহাতে—আজকে অফিসে কাজের চাপ, সকাল থেকে পেটের ভেতর নানা রকম গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে, আমার এক বাল্যবন্ধু প্রথমবারের মতো বিয়ে করতে যাচ্ছে, এই ‘বিপদের সময়’ তাঁর পাশে থাকা আমার পবিত্র দায়িত্ব ইত্যাদি।
অবশ্য দু–একবার নেলির সঙ্গে রিকশায় করে আমার নিউমার্কেটের দিকে যাওয়া হয়েছে। আমি একটু পরপর হাই তুলেছি। নেলি বলেছে, ওই দেখো, হাওয়াই মিঠাইওয়ালা যাচ্ছে। তুলোর মতো লাল। কী সুন্দর দেখতে! আমি কিনব।
আমি বলেছি, রিকশা থামিয়ে এসব কেনার কিছু নেই।
কিছুক্ষণ পর নেলি বলেছে, অ্যাই দেখেছ, ছোট বাচ্চাটা দেখতে কী মিষ্টি, অথচ ভিক্ষা করছে! চলো, ওকে আমরা কিছু খাবার কিনে দিই। আমি একটা ফুলের মালা কিনে ওকে পরিয়ে দেব।
আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে রাস্তার এক পাগলকে দেখছিলাম। এই পাগলের সঙ্গে একজনের চেহারার মিল আছে। কার মিল আছে, বোঝার চেষ্টা করছিলাম।
নেলি কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছে, অ্যাই শুনছ।
আমি বলেছি, পাগলটাকে দেখো। পাগল হলেও লোকটা কিন্তু রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছে না। তার মানে পাগলেরও নিরাপত্তাজ্ঞান থাকে।
‘যে তার পাশে একটা অপরূপ সুন্দরী মেয়েকে রেখে পাগল-ছাগল নিয়ে গবেষণা করে, তার নিজের মাথায় সমস্যা আছে। তোমাকে আমার সঙ্গে রিকশায় ঘুরতে হবে না। তুমি বাসায় গিয়ে গ্যাসের ওষুধ খাও। এরপর তোমার বাল্যবন্ধুর বিয়েতে গিয়ে তাকে উদ্ধার করো, নিজের পবিত্র দায়িত্ব পালন করো। তোমার সঙ্গে রিকশায় যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়,’ বলতে বলতে নেলি রিকশা থেকে নেমে যায়।
নেলিকে এ–জাতীয় বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে একধরনের আনন্দ বোধ করি। একটা পরমা সুন্দরী মেয়েকে অগ্রাহ্য করতে পারার মধ্যে একটা সাময়িক বিজয়ের তৃপ্তি আছে।
তবে এ বছরের প্রথম দিন নিয়ে আমার একটি পরিকল্পনা ছিল। আমি নেলিকে নীলক্ষেতের দিকে একটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাই। নেলিকে একটি টেবিলে বসিয়ে দিয়ে বের হয়ে যাই। কিছুক্ষণ পর কোলে করে একটি বাচ্চাকে নিয়ে ঢুকি।
নেলি বলল, এটা কে? কিডন্যাপিং শুরু করেছ নাকি?
আমি বললাম, এটা সেই বাচ্চাটা, যাকে তুমি একদিন রিকশা থেকে খাবার কিনে দিতে চেয়েছিলে। তারপর ওকে ফুলের মালা কিনে দিতে চেয়েছিলে। আমি ব্যাগ থেকে একটি ফুলের মালা বের করে নেলির হাতে দিলাম।
নেলি আমার দিকে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। বাচ্চাটা মিটিমিটি হাসছিল। নেলি ওকে কোলে তুলে নিল। যত্ন করে মালাটা ওর গলায় পরিয়ে দিল।
আমার হুট করে মনে পড়ল, সেদিন রাস্তায় দেখা পাগলটির চেহারার সঙ্গে আমার স্কুলজীবনের একজন শিক্ষকের চেহারার অদ্ভুত মিল ছিল। তিনি একবার বলেছিলেন, জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ হচ্ছে অন্যের ইচ্ছেপূরণ করার আনন্দ।
আমি নেলির দিকে তাকালাম। নেলি পরম মমতায় বাচ্চাটিকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। আজ নেলির ইচ্ছেপূরণের দিন।
ছুটির দিনে’তে আপনিও লিখুন
প্র ছুটির দিনে, প্রথম আলো, প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবন, ২০-২১ কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫
ই-মেইল: [email protected]
ফেসবুক পেজ: fb.com/ChutirDine