কুকুর মানেই জলাতঙ্ক না

কুকুর নিতান্তই নিরীহ এক প্রাণী। মডেল: পিংকী ও তাঁর পোষ্য চেরিছবি: অগ্নিলা আহমেদ

মনে পড়ে, ছোটবেলায় শুনেছিলাম কাউকে কুকুর কামড়ালেই তার নাভির গোড়ায় ১৪টি ইনজেকশন দিতে হবে। ইনজেকশন না দিলে জলাতঙ্ক হবে। সেই রোগ হলে আর পানি খাওয়া যায় না। কী একটা ভয়াবহ অবস্থা। নাভির গোড়ায় ইনজেকশন আর পানি খেতে না পারার দৃশ্য দুটি আমার মানসপটে ভেসে উঠত। কুকুর দেখলেই তাই অসম্ভব ভয় পেতাম। কামড়ে দিলেই তো মহাবিপদ!

এ দেশে এমন বহু মানুষই খুঁজে পাওয়া যাবে, যাঁরা কুকুর ভয় পান। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভয়ের কারণ একটাই—যদি কামড়ে দেয়! কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কুকুর কেন কামড়ায়, জানেন? কুকুর যদি কোনো কারণে আপনাকে হুমকি মনে করে, কেবল তখনই আসে কামড়ানোর প্রশ্ন। নইলে নিতান্তই নিরীহ এক প্রাণী কুকুর। আসলে কুকুরের প্রতি নেতিবাচক ধারণা পোষণ করার কারণে অনেক মানুষই কুকুরের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করেন। কুকুরের প্রতি মানুষ খারাপ আচরণ করে বলেই কোনো কোনো কুকুর মানুষকে কামড়ায়।

আচরণের কিছু ভুল

অনেকে কুকুর দেখলেই তাড়িয়ে দিতে চান। ‘হুস’জাতীয় শব্দ করে নিজেরাই কুকুরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। শান্তভাবে বসে থাকা কুকুরের চোখে এভাবেই নিজেদের ‘সন্দেহজনক মানুষ’ হিসেবে প্রতীয়মান করে তোলেন। শিশুরা অনেক সময় দুষ্টুমি করে কুকুরের গায়ে ঢিল ছোড়ে। আবার কুকুর ঘেউ ঘেউ করলে কোনো কোনো মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। দৌড়াতেও শুরু করেন। এগুলো সবই ভুল আচরণ।

কুকুরকে ভালোবেসে কাছে ডাকুন। মডেল: পিংকী ও তাঁর পোষ্য চেরি
ছবি: অগ্নিলা আহমেদ

জলাতঙ্ক নিয়ে আতঙ্ক?

সব কুকুরই জলাতঙ্কের জীবাণু বহন করে না। কেবল জলাতঙ্ক আক্রান্ত অন্য কোনো প্রাণীর কাছ থেকেই তার শরীরে জলাতঙ্কের জীবাণু প্রবেশ করতে পারে। আপনার এলাকায় সরকারি উদ্যোগে কুকুরদের জলাতঙ্কের টিকাদান কর্মসূচি চালাতে দেখেছেন কি? তাহলে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। বিগত এক বছরের মধ্যে না হয়ে থাকলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সহায়তায় এমন কর্মসূচির ব্যবস্থা করতে পারেন। কর্মসূচির দিন এলাকার প্রতিটি কুকুরকেই ‘ধরেবেঁধে’ টিকা দেওয়া সম্ভব না-ও হতে পারে। তাতেও অসুবিধা নেই। যে কুকুরকে টিকা দেওয়া হলো না, সে কী করেইবা জলাতঙ্কে আক্রান্ত হবে, যদি আশপাশে অন্যদের জলাতঙ্ক না থাকে? আর অন্যদের তো টিকা দেওয়াই হলো। অবশ্য ভিন্ন প্রজাতির কোনো সদস্যের (যেমন শিয়াল) আক্রমণে এলাকার কুকুরের জলাতঙ্ক হতে পারে, যদি তার টিকা দেওয়া না থাকে। তারপরও বাস্তবতা হলো, টিকা দেওয়া থাকলে জলাতঙ্কের ঝুঁকি কমে যায়।

কামড় দিলেও ভয় নয়

কুকুরের প্রতি এমন কোনো আচরণ করবেন না, যাতে কুকুর আপনাকে কামড়াতে উদ্যত হয়। তারপরও যদি কামড় বা আঁচড় লেগেই যায়, সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতস্থান খুব ভালোভাবে সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। এমন কোনো সাবান বেছে নেওয়া উচিত, যাতে ক্ষারের পরিমাণ বেশি। কাপড় কাচার সাবান বেশ ক্ষারীয় হয়। ১৫ মিনিট ধরে সাবান-ফেনা ঘষে, প্রচুর পানি দিয়ে ধুয়ে এর পরপরই জলাতঙ্কের টিকা নিতে যেতে হবে। তবে ভয় পাবেন না। নাভির গোড়ায় ১৪টি ইনজেকশন দিতে হবে না। ইনজেকশন দেওয়া হয় বাহুতে, ছোট সুই দিয়ে। প্রথম দিনের পর সেখানে যেতে হবে আরও তিনটি দিন। তবে কামড়ের ফলে যদি রক্ত গড়িয়ে পড়ে, তাহলে একটিমাত্র বাড়তি ইনজেকশন দিতে হবে ক্ষতস্থানে, সেটিও কেবল প্রথম দিনে।

পোষ্যের নিয়মিত টিকা দিতে হবে
ছবি: অগ্নিলা আহমেদ

লালা নিয়ে ভ্রান্তি

কুকুরের লালা লাগলেই ক্ষতি হবে, এমন ধারণাও ভুল। তাই কোনো কারণে কুকুরের লালা লাগলেও ভয় পাবেন না। কেবল কুকুরটি জলাতঙ্ক আক্রান্ত হয়ে থাকলেই তার লালায় জলাতঙ্কের জীবাণু থাকতে পারে। আর আপনার হাতে-পায়ে কুকুরের লালা লেগে গেলেও সেই লালায় থাকা জীবাণু আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, যদি না আপনার ত্বকে কোনো ক্ষত থাকে। তাই যদি আপনার ত্বকে কোনো কাটাছেঁড়া থাকে বা কোনো কারণে চামড়া ছিলে গিয়ে থাকে, আর সেখানটিতে কুকুরের লালা লেগে যায়, তাহলে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থাৎ, কামড় বা আঁচড় লাগলে যা করণীয় (সাবান দিয়ে ধোয়া থেকে শুরু করে ইনজেকশন দেওয়া পর্যন্ত), সেগুলোই করতে হবে।

চলুন, মানবিক হই

পথের অসহায় প্রাণীদের খাবারের এক বিরাট উৎস ছিল বাসাবাড়ির সামনে স্তূপ করে রাখা ময়লা। এখন মানুষ নিজ থেকে পথপ্রাণীদের খাবার না দিলে ওরা তেমনভাবে আর খাবার খুঁজে পায় না। মানুষ হিসেবে আমাদেরই দায়িত্ব এলাকার প্রাণীদের টিকে থাকার লড়াইয়ে শামিল হওয়া। এ তো পরিবেশ রক্ষারই লড়াই। এর জন্য কিন্তু প্রচুর অর্থ বিনিয়োগের প্রয়োজন হয় না। বাড়ির খাবারের উচ্ছিষ্টটুকুই দিতে পারেন। সামান্য কেক, বিস্কুটও কিনে দিতে পারেন। একটু পানি দিন। বৃষ্টি, রোদ আর শীতে একটু আশ্রয় দিন বাড়ির সামনে। অসুস্থ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। শিশুদের মধ্যেও মমতা জাগিয়ে তুলুন। আপনি যে কুকুরটাকে সামান্য একটু সাহায্য করলেন, সে সারা জীবন আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। কোনো না কোনোভাবে আপনার উপকার করবে। আর কামড়ানোর তো প্রশ্নই ওঠে না। কেউ কেউ ধর্মীয় কারণে কুকুর পছন্দ করেন না। তবে এটা ভুলে যাওয়া যাবে না, প্রতিটি ধর্মই আমাদের শিক্ষা দেয় প্রাণিকুলের প্রতি সদয় হতে। গায়ে হাত বুলিয়ে আদর না-ইবা করলেন, খাদ্য, আশ্রয় আর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে কিন্তু কোনো বাধা নেই। আর একেবারেই কিছু করতে না পারলেও অন্তত কোনো প্রাণীর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবেন না।

লেখক: ক্লিনিক্যাল স্টাফ, নিউরোমেডিসিন বিভাগ, স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেড, পান্থপথ, ঢাকা।