মায়ের জন্য, বাবার জন্য কী নিলাম

মডেল: মুবাশ্বিরা, কৃতজ্ঞতা: কুমুদিনী, ছবি: অগ্নিলা আহমেদ

‘মা-বাবার জন্য প্রথম কী উপহার কিনেছিলেন, মনে পড়ে?’

প্রতিষ্ঠিত কোনো চাকরিজীবী কিংবা ব্যবসায়ীকে প্রশ্নটা যদি করেন, অনেকে নিশ্চয়ই স্মৃতিকাতর হবেন। মা-বাবার জন্য প্রথম কেনা উপহারের একটা আলাদা আবেগ তো আছেই। কেউ হয়তো ফিরে যাবেন ছাত্রজীবনের স্মৃতিতে। কারও মনে পড়ে যাবে প্রথম চাকরির প্রথম বেতনের কথা।

দেশের একটা বড়সংখ্যক শিক্ষার্থী স্নাতকজীবনে এসে প্রথম বাড়ি ছাড়েন। দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে গিয়ে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকেন, কেউ ওঠেন মেসে। টিউশনি বা খণ্ডকালীন চাকরি করে যাঁরা টুকটাক আয় করেন, বাড়ি ফেরার সময় কিছু না কিছু নেওয়ার চেষ্টা করেন মা-বাবা কিংবা ভাই-বোনের জন্য। নিজের খরচ সামলে, একটু একটু করে টাকা জমিয়ে পরিবারের জন্য কিছু কেনার আনন্দটা ভীষণ অন্য রকম।

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের স্নাতকোত্তরের ছাত্র ত্বকি তাজওয়ার রহমানের কথাই ধরুন। পড়ালেখার পাশাপাশি শখের আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করেন এই তরুণ। এবার একটু আগেভাগেই ছুটি মিলবে, সেই আশায় আছেন। ছুটি পেয়ে গেলে আর একটা দিনও ঢাকায় থাকতে চান না জানিয়ে ত্বকি বলছিলেন, ‘এখন ক্লাস আর কাজের ফাঁকে সময় পেলেই বাড়ির লোকের জন্য ঈদের কেনাকাটা সেরে ফেলার চেষ্টা করছি। যেন ছুটি পেলেই বাড়ির পথে রওনা হতে পারি।’ হোস্টেলের কাছেই মিরপুর ১০–এর শাহ্ আলী মার্কেট। সেখানে ঘুরতে গিয়ে প্রথমেই মায়ের জন্য কিনেছেন নামাজের হিজাব। সন্তানসম্ভবা বোনের জন্য কিনেছেন প্রয়োজনীয় পোশাক।

কয়েক বছর আগেও অবশ্য ত্বকীর কাছে ঈদের চিত্রটা ছিল অন্য রকম। মা-বাবা আর বড় বোনের সঙ্গে খুলনায় নিজ এলাকার সবচেয়ে বড় মার্কেটে ঘুরে ঘুরে ঈদ পোশাক কিনতেন। তারপর একে একে কত কিছু বদলেছে! বাবাকে হারিয়েছেন। পড়াশোনা ও কাজের জন্য ঢাকায় থাকছেন। বাড়ির একমাত্র ছেলে হিসেবে দায়িত্বটা টের পান ত্বকি। বলছিলেন, ‘পরিবারের জন্য যা দেখি তা-ই কিনতে ইচ্ছা হয়। মনে হয় এটাই তো লাগবে। অল্প যা আয় করি, তা দিয়েই পরিবারের জন্য কিছু কিনতে পারলে কষ্টটা সার্থক মনে হয়।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্রী নাদিয়া মোনেম কাজ করছেন ইয়ুথ এমপাওয়ারমেন্ট ইন ক্লাইমেট অ্যাকশন প্রোগ্রামের শিক্ষানবিশ হিসেবে। পড়াশোনার জন্য নরসিংদীর বাড়ি ছেড়ে একাই ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন বছর পাঁচেক আগে। নাদিয়ার কথাতেও বাড়ি ফেরার রোমাঞ্চের আঁচ পাওয়া গেল। বলছিলেন, ‘এই কয়েক বছরে শুধু ঈদের মতো বড় বড় ছুটিগুলোতেই একটু বেশি সময়ের জন্য বাড়ি ফেরা হয়েছে। এই কারণেই কিনা জানি না, অন্যান্য সময়ে অল্প দিনের জন্য বাড়ি ফেরার চেয়ে ঈদে ফেরার আনন্দ অনেক বেশি মনে হয়। সবার জন্য কেনাকাটা করতেও আনন্দ লাগে। ফোন করে জিজ্ঞেস করি কার কী লাগবে। বাবার পাঞ্জাবি, মায়ের শাড়ি, ভাইবোনদের নানা আবদার। সব মিলিয়ে অনেক কেনাকাটা করা হয়। প্রতিবারই নিজের জন্য কেনার আগে সবার জন্য কিনতে চেষ্টা করি। এবারও তা-ই করব।’

আরও পড়ুন

ঈদে বাড়ি ফেরার আগে অনেক সময় মা-বাবাই টাকা পাঠান কিছু কিনে নেওয়ার জন্য। এই টাকাটা নিতে ইচ্ছে করে না, জানান নাদিয়া। তিনি বলেন, ‘বাড়ির লোকের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিনতে খুব বেশি তো আর খরচ হয় না। তাই নিজের আয়েই একটা কিছু করতে ইচ্ছা করে।’

পড়াশোনার ফাঁকে ছাত্র পড়িয়ে টুকটাক আয় করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের ছাত্র রেদোয়ানুল হক। বাড়ি মাগুরায়। প্রায় তিন বছর ধরে থাকেন ঢাকার একটি হোস্টেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য করোনার কঠিন সময়ে একাই এসেছিলেন এখানে। এরপরই জীবনটা কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেছে। রেদোয়ানুল বলেন, ‘আমার মতো যাঁদের একা একা চলা শিখতে হয় তাঁরা হয়তো বুঝবেন, পরিবার ছেড়ে আসার কিছুদিনের মধ্যেই আয় করার একটা তাড়না টের পাওয়া যায়। নিজে কিছু আয় করে পরিবারকে দিতে ইচ্ছা হয়। আর ঈদ এলে মনে হয় এই অনুভূতি অনেকটাই বেড়ে যায়। বাড়ি ফেরার আগে বাবা মা, ভাইবোনদের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে যেতে ইচ্ছা করে।’

রাজধানীর খুব বেশি দূরে বাড়ি নয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের ছাত্র মোহাম্মদ রহমতুল্লাহর। তবু কাজের চাপে খুব কমই বাড়ি যাওয়া হয়ে ওঠে। এই ঈদে বিহেভিয়র থেরাপিস্ট হিসেবে কর্মরত এই তরুণও ফিরে যাবেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, তাঁর পরিবারের কাছে। তাই ফেরার আগেই তোড়জোড় করছেন কেনাকাটার। বলছিলেন, ‘যেহেতু এখানে সবকিছু বেশ সহজে পাওয়া যায়, তাই চেষ্টা করি এখান থেকেই বাড়ির সবার জন্য কিছু কিনে নিতে। তা ছাড়া ফেরার আগে কারও কোনো আবদার থাকলে মার্কেটে ঘুরে ঘুরে আগে সেগুলো কেনার চেষ্টা করব।’