ডিপ্লোমার পর পড়ালেখা স্থগিত হয়ে গিয়েছিল, এখন শিক্ষকতা করি অস্ট্রেলিয়ায়

সিডনি মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির প্রভাষক মো. বদিউজ্জামান। অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসে গবেষক হিসেবেও কাজ করছেন তিনি। সুন্দরবন সংলগ্ন এক গ্রাম থেকে কীভাবে এত দূর পৌঁছলেন? সে গল্পই লিখেছেন তিনি।

ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে লেখক (ডানে)

আমাদের গ্রামটা সুন্দরবনের কাছে। নাম রাজাপুর। বাগেরহাট জেলার শরণখোলা থানায় পড়েছে। একটু প্রত্যন্ত অঞ্চলে হওয়ায় বিদ্যুৎ পৌঁছেছিল বেশ দেরিতে। এ অঞ্চলে ভালো পড়ালেখার সুযোগ তেমন ছিল না। তার ওপর ছোটবেলায় এক দুর্ঘটনায় পড়ে আমার ডান পায়ে একটা স্থায়ী সমস্যা তৈরি হয়। তখনই স্বাভাবিক গতিতে হাঁটা বা দৌড়ানোর সক্ষমতা হারিয়েছিলাম। সেই আমিই এখন দেশ থেকে প্রায় ৯ হাজার কিলোমিটার দূরে অস্ট্রেলিয়ার একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াই। পেছনে ফিরে তাকালে অবাক লাগে, কীভাবে এতটা পথ পাড়ি দিলাম!

অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পাওয়া ছাত্র হয়েও এসএসসিতে রেজাল্ট যখন খারাপ হলো, খুব ভেঙে পড়েছিলাম। তলানিতে ঠেকেছিল আত্মবিশ্বাস। দ্রুত পেশাজীবনে পা রাখার তাড়নায় এক সহপাঠীর কাছ থেকে তথ্য পেয়ে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি হই। বিষয় ছিল কম্পিউটার প্রকৌশল। অথচ আমার নিজেরই তখন কোনো কম্পিউটার ছিল না। কলেজের ল্যাবেই বিকেল পর্যন্ত পড়ে থাকতাম। এই পরিশ্রম বৃথা যায়নি। প্রোগ্রামিং, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, মাইক্রোপ্রসেসর, ডিজিটাল সিস্টেমের ওপর দক্ষতা অর্জন করে ফেলি।

আর দশজন ডিপ্লোমা প্রকৌশলীর মতো আমারও ইচ্ছা ছিল, ডিগ্রি নেওয়ার পর ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ডুয়েট) পড়ব। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের অঞ্চলে সিডরের কারণে একটা বড় অর্থনৈতিক ধাক্কা লাগে। অর্থের অভাবে মাঝপথেই থেমে যায় ডুয়েটের ভর্তি কোচিং। এই ট্রমা কাটিয়ে উঠে খুলনাতেই ‘ম্যানগ্রোভ ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হই।

মাত্র ৪৭ জন শিক্ষার্থী, আর অনেক স্বপ্ন নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু। তবু কত বাঁকা কথা যে শুনতে হয়েছে। ‘কোচিং সেন্টার খুলেছ!’, ‘সময়ের অপচয় করছ’ ইত্যাদি কত কথা। জানিয়ে রাখি, আমাদের সেই প্রতিষ্ঠানই এখন বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট হিসেবে বেশ পরিচিত। তিন হাজার শিক্ষার্থী এখানে পড়ে। বিভিন্ন পদে কাজ করার পর ২০১৫ সালে আমি ম্যানগ্রোভ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেছিলাম।

ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসের বিজনেস স্কুলের একটি প্রকল্পে এখনো গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করছি
ছবি: সংগৃহীত

এসব কাজের পাশাপাশি ২০০৯ সালে ভর্তি হই প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগে। ঢাকায় পড়াশোনা আর খুলনায় কর্মক্ষেত্র সামাল দিতে প্রতি সপ্তাহেই বাইক নিয়ে ছুটতে হতো। টিউশন ফি দেওয়া, জীবনযাপনের খরচ মেটানো—সব মিলিয়ে এটা ছিল জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়। ঠিক করেছিলাম, এই শেষ। স্নাতকের পর পড়ালেখা আর করব না। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন থেকেই ২০১২ সালে স্নাতক শেষ করে ২০১৩ সালে মাস্টার্সে ভর্তি হই খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েটে)। ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রকৌশল ও ব্যবস্থাপনা প্রোগ্রামে।

আরও পড়ুন

২০১৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব আমার ওপর পড়ে। সফলভাবেই ৫টি ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রামসহ আমরা চালু করি ইম্পেরিয়াল কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং। এ প্রকল্পের জন্য প্রতিনিয়ত এমন মানুষদের সঙ্গে কাজ করতে হচ্ছিল, যাঁদের পিএইচডি ডিগ্রি আছে। তখন আমিও একটা পিএইচডি ডিগ্রির প্রয়োজনীয়তা বোধ করি। কিন্তু পর্যাপ্তসংখ্যক সুপারভাইজারের অভাবে কুয়েটে তখন পিএইচডি শিক্ষার্থী নেওয়া বন্ধ। তাই একরকম বাধ্য হয়েই বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করা শুরু করি। সে আরেক সংগ্রামের গল্প।

সত্যি বলতে, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির সুযোগ পাওয়ার মতো গবেষণার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। আমার জীবনের একটা বড় অংশই কেটে গেছে দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়া ও তার উন্নয়নের পেছনে। বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ২১টি আবেদন করার পর অবশেষে অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস থেকে বৃত্তির জন্য নির্বাচিত হই। চার বছরের টিউশন ফি, স্টাইপেন্ডসহ এই বৃত্তি প্রায় তিন কোটি টাকা সমমূল্যের।

আমার প্রকল্পের অন্যতম ফোকাস ছিল প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ও তাঁদের পরিবার। দুর্ঘটনার পর থেকে পায়ে সমস্যার কারণে সমাজে যে বঞ্চনার শিকার হয়েছি, সেই বোধ থেকেই এই গবেষণায় যুক্ত হই। আজীবন প্রকৌশল নিয়ে পড়ে হঠাৎ ‘সামাজিক বিজ্ঞান ও শিক্ষা’–বিষয়ক গবেষণায় যুক্ত হওয়া ছিল অথই সাগরে পড়ার মতো। গবেষণাপদ্ধতি অনেকটা নতুন করেই শিখতে হয়েছে। অবশেষে ২০২৪ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করি।

ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসের বিজনেস স্কুলের একটি প্রকল্পে এখনো গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করছি। আমাদের এই গবেষকদল অস্ট্রেলিয়ায় জাতীয় পর্যায়ের একটা পুরস্কারও পেয়েছে। এখনকার সময়ে পিএইচডি হয়তো তেমন বড় কোনো অর্জন নয়। কিন্তু ডিপ্লোমা শেষে একরকম পড়ালেখা স্থগিত করে দেওয়ার পরও যে নতুন করে এতটা পথ পাড়ি দিতে পেরেছি, এটাই আমার কাছে বড় পাওয়া।

আরও পড়ুন