ভাগনে পাবজি খেলায় আসক্ত হয়ে ৪০ দিন ঘর থেকে বের হয় না, সমাধান চাই

পাঠকের কাছ থেকে মনোজগৎ, ব্যক্তিজীবন ও সন্তান পালনের মতো সমস্যা নিয়ে ‘পাঠকের প্রশ্ন’ বিভাগে নানা রকমের প্রশ্ন এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম নির্বাচিত একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার।

প্রশ্ন: আমার ছোট ভাগনের বয়স ১৬ বছর। নবম শ্রেণির ছাত্র। তারা দুই ভাই, কোনো বোন নেই। বাবা দীর্ঘদিন ধরে জাহাজে চাকরি করছেন। সম্প্রতি বড় ভাগনে বাবার সঙ্গে কাজে যোগ দিয়েছে। তার বাবা তিন-চার বছর পরপর বাড়িতে আসেন। ভাগনেকে নিয়ে একটা বাসায় ভাড়া থাকেন আমার বোন। ভাগনে খুব সহজ-সরল ও মেধাবী। বর্তমানে সে ‘ফ্রি ফায়ার’, ‘পাবজি’ প্রভৃতি অনলাইন গেমে আসক্ত হয়ে পড়েছে। ৪০ দিন ধরে সে তার রুম থেকে বের হয় না। দিনে ঘুমায়, রাতে জেগে থাকে। সে ২০০ টাকা চাইলে তার মা যদি দিতে একটু দেরি করে, তাহলে বাসার কাপড়চোপড় ও জিনিসপত্র নষ্ট করে। সেই সঙ্গে টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে ৫ হাজার করে ফেলে। টাকা দিতে মাকে বাধ্য করে। এখন সে খুবই চুপচাপ থাকে। মাঝে মাঝে টাকা আদায়ে প্রচণ্ড জেদ করে। মায়ের সঙ্গে জেদ ছাড়া অন্য কোনো খারাপ আচরণ করে না। খাওয়াদাওয়ায় তেমন কোনো মনোযোগ নেই। বাবার প্রতি আগ্রহ অনেক কম। বাবার সঙ্গে সে কথা বলতে চায় না, বলেও না। এ ব্যাপারে তার মা সমাধান চান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, মির্জাপুর, টাঙ্গাইল

পাঠকের এই সমস্যার সমাধান দিয়েছেন মেহতাব খানম
ছবি: প্রথম আলো

উত্তর: বুঝতে পারছি, এ মুহূর্তে আপনার বোন কতটা অসহায় বোধ করছেন। বর্তমান যুগে মা–বাবা যৌথভাবে বয়ঃসন্ধিতে থাকা সন্তানদের সুষ্ঠুভাবে বড় করতে গিয়েও যথেষ্ট হিমশিম খাচ্ছেন। এ বয়সের শিশুদের মধ্যে প্রচুর প্রাণশক্তি থাকে। তাদের জন্য খোলামেলা ও প্রাকৃতিক পরিবেশে খেলার সুযোগ থাকা খুব প্রয়োজন। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, অধিকাংশ স্কুল বা কলেজে সে ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালনার কোনো সুযোগ নেই। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদান পদ্ধতিতে পড়ালেখার প্রতি আগ্রহী করে তোলার ব্যাপারেও তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। শিক্ষাঙ্গনে পাঠাগারে আকর্ষণীয় বই পড়া এবং সেগুলো নিয়ে আলোচনারও ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, বিভিন্ন ধরনের ক্লাব তৈরি করে সেগুলোর কার্যক্রমে অংশ নেওয়াও প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। শিশুরা স্কুল-কলেজ থেকে ফিরেই আবার দৌড়ে যাচ্ছে কোচিং ক্লাসে। বাড়ি থেকেও সারাক্ষণ শুধু লেখাপড়ায় ভালো করার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে।

এভাবে প্রায় নিরানন্দ ও বৈচিত্র্যহীন দিন কাটাতে হচ্ছে বলে এই বয়সের শিশুরা এমন কিছু অভ্যাস বা কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে, পরে যা আসক্তিতে পরিণত হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতার কারণে বেশ অল্প বয়স থেকেই এগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে তারা। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতি আসক্তি, সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার আসক্তি, পর্নোগ্রাফিতে আসক্তির কবলে পড়ে শিশু-কিশোরেরা জীবনের স্বাভাবিক গতিপথ থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে ডিজাইন করা ভিডিও গেমগুলোয় বহু শিশু ভয়াবহভাবে ঢুকে পড়ছে। বিশেষ করে কোভিডের সময় তাদের মোবাইল ও অন্য গ্যাজেটগুলো ব্যবহার করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ঘরে আটকে থাকার কারণে প্রবল আসক্তি তৈরি করে, এমন কিছু খেলায় ঢুকে গেছে তারা।

অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক এই খেলাগুলো তাদের মানসিক জগৎকে এতটাই দখল করে রাখে যে ওদের কাছে পৃথিবীর অন্য সব কিছু মনে হয় গৌণ। অত্যন্ত দুঃখজনক হচ্ছে, আপনার ভাগনের বাবা তিন-চার বছর পরপর দেশে আসেন। বাবার সঙ্গে সন্তানের কোনো আবেগময় বন্ধনও তাই তৈরি হয়নি। ওর যে বড় ভাইটি ছিল, সে–ও এখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করায় বাড়িতে শুধু দুই প্রজন্মের দুটো মানুষকে থাকতে হচ্ছে। আপনার ছোট ভাগনেটি কীভাবে তার সময় কাটাচ্ছে, সেটি খেয়াল করে, তাকে একটি সঠিক নির্দেশনা দেওয়ার জন্য এ মুহূর্তে কেউ নেই। আপনার বোনের পক্ষে এ দেশের বর্তমান সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে এই সংবেদনশীল বয়সে থাকা সন্তানটিকে ঠিকমতো বড় করা অত্যন্ত দুরূহ হচ্ছে।

এ সমস্যা এখন ঘরে ঘরেই দেখা যাচ্ছে। যে খেলাগুলো সে খেলেছে, সেখানে প্রচণ্ড প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। খুব ভালো খেললে টাকা উপার্জন করা যায় বলে এই নেশা থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার আকাঙ্ক্ষা এতটাই তীব্র হয় যে খাওয়াদাওয়া-ঘুমকেও তখন মনে হয় অপ্রয়োজনীয়। আপনার ভাগনে যেহেতু খুব মেধাবী, তাই হয়তো সে খুব ভালো খেলে। সেই কারণে তার পৃথিবীজুড়ে রয়েছে পাবজি ও ফ্রি ফায়ার। আমাদের মস্তিষ্ক ভালো লাগার যে বিষয়গুলো দ্বারা উজ্জীবিত হয়, অবচেতনভাবে আমরা সেই জিনিসগুলোই খুঁজতে থাকি। আর সে কারণেই সেগুলোর প্রতি দিন দিন অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা তৈরি হয়। আরও ভালো খেলার জন্য অনলাইনে কিছু সরঞ্জাম কেনার প্রয়োজন হয় বলে টাকার চাহিদা বেড়ে যায়। অনেকেই একই সঙ্গে ইয়াবার মতো কিছু মাদকদ্রব্যও গ্রহণ করে থাকে।

মনে হচ্ছে, আপনার ভাগনে বেশ ভালোভাবেই আসক্তিতে ঢুকে পড়েছে। সে কারণে মা টাকা দিতে দেরি করলে জিনিসপত্র নষ্ট করছে। আমার অনুরোধ থাকবে, আপনি ওর বাবা এবং ভাইকে জরুরি ভিত্তিতে আসতে বলেন। ওই দুজনের সহায়তা নিয়ে ঢাকায় কোনো ভালো মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রে যোগাযোগ করে কীভাবে ওর চিকিৎসা করানো যায়, সেই বিষয়ে আলোচনা করুন। যেহেতু আমাদের দেশে গেম বা অন্য আসক্তির জন্য আলাদা করে নিরাময় কেন্দ্র নেই, তাই এই সেবা নিতে মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রে যোগাযোগ করতে হবে। তবে কোনোভাবেই ওর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করবে না, বা ওকে কোনো দোষারোপ করবেন না। ঠান্ডা মাথায় ওর চিকিৎসা কেন প্রয়োজন, সেটি বোঝাতে হবে। এ ছাড়া ওকে যে আপনারা ভালোবাসেন, সেটিও বোঝাতে হবে।

আরও পড়ুন

পাঠকের প্রশ্ন, বিশেষজ্ঞের উত্তর

পাঠকের প্রশ্ন পাঠানো যাবে ই–মেইলে, ডাকে এবং প্র অধুনার ফেসবুক পেজের ইনবক্সে। ই–মেইল ঠিকানা: [email protected] (সাবজেক্ট হিসেবে লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’) ডাক ঠিকানা প্র অধুনা, প্রথম আলো, প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবন, ২০–২১ কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫। (খামের ওপর লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’) ফেসবুক পেজ: fb.com/Adhuna.PA