নর্থ সাউথে ভর্তির সুযোগ পেয়েও আসতে পারছেন না ফিলিস্তিনের মাহা
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষা দিয়ে ইন্টার্নশিপ করতে দেশে ফিরে গিয়েছিলেন মাহা শুবেইর। দুই বছরের ইন্টার্নশিপ শেষে এখন তিনি পুরোদস্তুর চিকিৎসক। আর দশজন চিকিৎসকের মতো এত দিনে তাঁর ‘স্বাভাবিক’ পেশাজীবন শুরু করার কথা; কিংবা উচ্চশিক্ষায়ও মগ্ন থাকতে পারতেন। মাহার কপালে এর কোনোটিই জোটেনি। কারণ, তাঁর জন্মভূমি ফিলিস্তিন। ইসরায়েলের আক্রমণে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এই তরুণের বাড়ি। খালা, চাচাসহ হারিয়েছেন পরিবারের আট সদস্যকে। মা-বাবা, ভাই-বোনদের নিয়ে এখন তিনি আশ্রয় নিয়েছেন শরণার্থী তাঁবুতে।
২০২৫ সালের শুরুতে মাহার জন্য আশার আলো হয়ে এসেছিল বাংলাদেশের নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির বৃত্তি। সম্পূর্ণ বিনা খরচে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে স্নাতকোত্তর, পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা সহকারী হিসেবে চাকরির সুযোগ পেয়েছেন তিনি; কিন্তু ফিলিস্তিন সীমান্ত ইসরায়েলিদের দখলে থাকায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তাঁর বাংলাদেশে আসা।
১ জুলাই রাতে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হলে মাহা জানান, মে মাসে দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস এলাকায় তাঁদের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর বাড়ি থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে মাওয়াসি খান ইউনিস এলাকার সমুদ্রতীরবর্তী একটি স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন তাঁরা। এক তাঁবুর তলেই গাদাগাদি করে থাকছেন পরিবারের আট সদস্য। প্রায় ১০ হাজার মানুষ বাস্তুহারা হয়ে ওই এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে।
তাঁবুতে তাঁদের সঙ্গে মাহার বড় বোনের দেড় বছর বয়সী সন্তানও আছে। ফোনের ওপার থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহা বলছিলেন, ‘জন্মের পর এখন পর্যন্ত আমার বোনের ছেলে মাংস, ফলমূল কিংবা কোনো পুষ্টিকর খাবার খেতে পারেনি। কোনো রকমে ভাত, ডাল আর বীজ খেয়ে আমরা বেঁচে আছি। এখানে বিদ্যুৎ নেই। বিশুদ্ধ খাওয়ার পানিও দুর্লভ। বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার সময় যেই চাল-ডাল নিয়ে এসেছিলাম, সেগুলোর মজুতও বেশি নেই। আশপাশে কোনো দোকানপাট নেই। মাঝেমধ্যে বাজার বসলেও আটা–চাল ছাড়া তেমন কিছু পাওয়া যায় না। আবার দামও বেশ চড়া।’
২০১৭ সালে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন মাহা শুবেইর। তখন তাঁর কাছে বাংলাদেশ অজানা-অচেনা একটা দেশ। ধীরে ধীরে এই দেশই আপন হয়ে উঠেছে। মাহার ভাষায় বাংলাদেশ এখন তাঁর ‘সেকেন্ড হোম’। বাংলাদেশের খাবার, মানুষের আতিথেয়তা তাঁর ভালো লাগে। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের মানুষ সব সময় ফিলিস্তিনের পক্ষে আছেন। এ জন্য তিনি এ দেশের প্রতি কৃতজ্ঞ।
ফিলিস্তিনে ফিরে যাওয়ার পর থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সহপাঠী আর শিক্ষকেরা নিয়মিত মাহার খোঁজ রেখেছেন। বন্ধু মালিহা মেহজাবিন ও ফয়সাল চৌধুরীর পরামর্শেই নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্সের জন্য আবেদন করেছিলেন। মাহা বলেন, ‘স্বেচ্ছায় কেউ জন্মভূমি, পরিবার ছাড়তে চায় না; কিন্তু বর্তমানে আমাদের পরিস্থিতি এতই করুণ যে ফিলিস্তিন ছাড়তে পারলেই যেন আমরা বাঁচি। জানি না বাংলাদেশে যেতে পারব কি না। জর্ডান বা আশপাশের কোনো দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে সাহায্য না পেলে সীমান্ত পার হওয়া প্রায় অসম্ভব। আমার পরিস্থিতির বিস্তারিত জানিয়ে জর্ডানে বাংলাদেশ দূতাবাসে ইতিমধ্যে ই–মেইল করেছি; কিন্তু এখনো কোনো উত্তর পাইনি।’
সামার সেমিস্টার (এপ্রিল) থেকেই নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে মাহার ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ছিল। এ বিষয়ে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজের পরিচালক এম এন ইসলাম বলেন, ‘স্নাতকে ভালো ফলের কারণে মাহা ফুল স্কলারশিপ পেয়েছেন। পাশাপাশি তিনি যেন এখানে নির্বিঘ্নে পড়াশোনা করতে পারেন, সে জন্য তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিরও সুযোগ দেওয়া হয়েছে; কিন্তু যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে এখনো ক্লাসে যোগ দিতে পারছেন না। পরের সেমিস্টার শুরুর আগেই তাঁকে বাংলাদেশে নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। এ ব্যাপারে সহযোগিতা চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে জর্ডান, কাতার ও মরক্কোয় বাংলাদেশ দূতাবাসে ই–মেইলও করা হয়েছে। তবে এসব দূতাবাস থেকে এখনো কোনো সাড়া মেলেনি। বাংলাদেশে অবস্থিত ফিলিস্তিন দূতাবাস জানিয়েছে, এ ব্যাপারে তাঁরাও নিরুপায়।’ অন্তত মানবিক দিক বিবেচনা করে হলেও মাহার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতার অনুরোধ জানান তিনি।