আমাকে অনেকে জাদুকর ভেবে ভুল করে

সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার পেলে৷ ১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল দলের সদস্য তিনি৷ ফুটবলে বর্ণবাদ বিলোপে ফিফার দূত ও ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে কাজ করেছেন৷ ফুটবলের এই মহাতারকা গত বৃহস্পতিবার রাতে মারা গেছেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ২০১৪ সালের ২৯ জুন প্রথম আলোর রোববারের ক্রোড়পত্র স্বপ্ন নিয়েতে ছাপা হওয়া লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো।

পেলে (২৩ অক্টোবর ১৯৪০–২৯ ডিসেম্বর ২০২২)
ছবি: সংগৃহীত

ছয় বছর বয়সে আমি প্রথম ফুটবলে কিক করি৷ সেদিন ছিল আমার জন্মদিন৷ এ জন্য আমার বাবার ফুটবলার বন্ধু সোসা আমাকে একটি চামড়ার বল উপহার দেন৷ সেটিই ছিল আমার সত্যিকারের কোনো বলে লাথি মারার অভিজ্ঞতা৷ তার আগে আমরা মোজার মধ্যে কাগজ ভরে ফুটবল বানিয়ে খেলতাম৷
আমাকে অনেকে জাদুকর ভেবে ভুল করে৷ আমি আসলে জানি না কেন তারা ভুল করে৷ এটা একমাত্র স্রষ্টাই জানেন৷ কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, ফুটবলের জন্যই আমাকে সবাই চেনে৷ ফুটবল ছাড়া আমার অস্তিত্ব শূন্য৷ ফুটবল একটি পরিবারের মতন, বিশ্বপরিবার৷ এটা কোনো ছোটখাটো পরিবার নয়, সারা বিশ্বই ফুটবল পরিবার৷ আমি এই পরিবারের জন্য কাজ করে যাই৷ আমি সব সময় চেষ্টা করি অন্যের মঙ্গল করতে৷ আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে অন্যকে খুশি রাখার৷ আমি আগে পা দিয়ে ফুটবল খেলতাম, এখন হৃদয় দিয়ে খেলি৷ আমি ইউনেসকোর হয়ে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করার চেষ্টা করি৷ আমি সাধারণ মানুষের পাশে থাকার চেষ্টায় থাকি সব সময়৷

আরও পড়ুন
১৯৫৮ বিশ্বকাপে জেতা (জুলেরিমে) ট্রফি হাতে পেলে
ছবি: রয়টার্স

আমার ফুটবল খেলার অনুপ্রেরণা অনেকে৷ তারুণ্যে অনুপ্রেরণা ছিলেন আমার বাবা দোনদিনহো আর ব্রাসিলিয়ার মধ্যমাঠের ফরোয়ার্ড জিজিনহো৷ আমার চোখে তিনি ব্রাজিলের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার৷ মিশেল প্লাতিনি, বেকেনবাওয়ার অসাধারণ ফুটবলার ছিলেন৷ লেভ ইয়াসিন ছিলেন অনন্য এক গোলরক্ষক৷ ফুটবল মাঠে ক্রুইফ, ডি স্টেফানো, জিকো যাঁর যাঁর দিনে হয়ে উঠতেন ভয়ংকর৷ ম্যারাডোনাও ফুটবলের মাঠে দুর্জেয়৷ জর্জ বেস্ট তো ইউরোপ কাঁপানো ফুটবলার৷
ফুটবল আমাকে সব দিয়েছে—খ্যাতি, সম্মান, অর্থ৷ এখন আমি ফুটবলকে দিতে চাই৷ আমি মানুষকে আমার প্রতি তাদের ভালোবাসা ফেরত দিতে পারব না৷ কিন্তু তার পরও আমি তাদের কিছু দিতে চাই৷ আমি সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করে যেতে চাই৷ এখন যারা শিশু, আমি তাদের ‘হ্যালো’ বলে ডাক দিই৷ এতে তারা যতটা খুশি হয়, আমি তার চেয়েও বেশি খুশি হই৷ আমি পেশাদার ফুটবল ছেড়েছি ৩০ বছর আগে৷ এখন যারা আট বছর, পাঁচ বছরের শিশু, আমাকে বিমানবন্দরে দেখলে চিৎকার করে ওঠে, ‘মা, দেখো, পেলে!’, ‘বাবা, দেখো, ওই যে পেলে!’ এটা নিঃসন্দেহে অন্য রকম একটি অনুভূতি৷ আমার জন্য এটাই তো স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ উপহার৷

আরও পড়ুন

আমি ব্রাজিলের ত্রেস কোরাকোয়েস শহরের জন্মগ্রহণ করি৷ আমার নাম অনেক লম্বা! এডসন অরান্তেস দো নাসিমেন্তো—একবার বলা শুরু হলে আর শেষ হয় না; যদিও আমার এত বড় নাম ছোটবেলা থেকে কখনোই পছন্দের ছিল না৷ আমার নামকরণ করা হয় বিখ্যাত উদ্ভাবক, বিজ্ঞানী থমাস এডিসনের নাম থেকে৷ আমার বাবা ভালো ফুটবলার ছিলেন৷ তিনি সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনে খেলতেন৷ তাঁর ঝুলিতে অনেকগুলো গোলও ছিল৷ আমি ছোটবেলা থেকে চাইতাম বাবার মতো হতে৷ কিন্তু একটা ইনজুরি বাবার খেলা বন্ধ করে দেয়৷
আমি শহরের শিশু-কিশোরদের সঙ্গে অনেকটা সময় ফুটবল খেলেছি৷ তাদের কেউ একজন আমাকে ‘পেলে’ বলে ডাকত৷ আমি প্রতিবাদ করতাম, ‘না, পেলে না, আমাকে পেলে নামে ডেকো না৷ আমার নাম এডসন৷’ যারা আমার ভুল নামে ডাকত, আমি তাদের সঙ্গে মারামারি করতে ছুটতাম৷ আমার স্কুলেও একই ঘটনা ঘটত৷ আমাকে পেলে নামে সবাই খ্যাপাত৷

আমি সেখানেও মারামারি করতাম৷ আমাকে স্কুল থেকে দুদিনের জন্য বহিষ্কার করা হয়৷ আমার মা-বাবাকে স্কুলে ডাকা হয়৷ আমি তাঁদের বলি, ‘আমাকে পেলে নামে সবাই ডাকে বলে আমি মারামারি করেছি৷ আমি এই বাজে নাম পছন্দ করি না৷ আমার নাম এডসন৷’ এর পরের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে উঠল৷ আমাকে সবাই ‘পেলে–পেলে–পেলে’ বলে ডাকা শুরু করল! অনেক সাংবাদিক আমার নামের অর্থ খুঁজতে উদ্গ্রীব৷ পেলে নামের অর্থ কী? তারা আফ্রিকা ও এশিয়ার অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছে, কিন্তু নামের অর্থ বের করতে পারেনি৷ শেষ পর্যন্ত তারা ‘মাদাম পেলে’ নামে এক আগ্নেয়গিরি খুঁজে পায়৷ ব্রাজিলে অনেক ফুটবলারের মধ্যে একজন গোলরক্ষক আমার বাবার বন্ধু ছিলেন৷ তাঁর নাম ছিল ‘বিলে’৷ আমার ধারণা, তাঁর নামের বিকৃত উচ্চারণেই আমার নাম৷ স্রষ্টা ভালো জানেন, আমি জানি না৷
প্রথম বিশ্বকাপে খেলা ছিল অনন্য এক অভিজ্ঞতা৷ এটা ছিল স্বপ্নের মতন৷ প্রথম ম্যাচে গোল করার পরে আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছিল৷ তার পরের সময়টুকু ইতিহাস৷ ফরাসিদের বিপক্ষে আমি তিন গোল করি আর ফাইনাল খেলা ছিল বিস্ময়কর স্বপ্ন! বিশ্বকাপ জয় ছিল আমার জন্য বিশেষ একটি ঘটনা৷ আত্মবিশ্বাস থাকলে কেউ কাউকে দমিয়ে রাখতে পারে না৷ আমার বাবা আমাকে বলতেন, ‘স্রষ্টা তোমাকে ফুটবল খেলার অনন্য দক্ষতা দিয়েছেন৷ এটা তাঁর উপহার৷ আত্মবিশ্বাস রেখে সেই উপহার কাজে লাগাও৷’

সূত্র: এনটিভি নেটওয়ার্কসের গ্লোবাল লিডার্স অনুষ্ঠান, জিকিউ ম্যাগাজিন ও ফোরফোরটু’কে দেওয়া সাক্ষাৎকার অবলম্বনে জাহিদ হোসাইন খান