মনের ছবিতে মুনীর চৌধুরী

শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী (১৯২৫–১৯৭১)
ছবি: সংগৃহীত

খুব ছোটবেলার কথা মনের মধ্যে টুকরো ছবি হয়ে রয়ে যায়।

ঢাকায় সেন্ট্রাল রোডে আমার নানুবাসায় দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠে টানা বারান্দার পর আরেকটা চারকোনা বড় বারান্দা। জাফরি কাটা ইটের রেলিং, লাল সিমেন্টের মেঝে। এটাকে আমরা বলতাম ব্যালকনি। আমাদের কুমির-কুমির খেলার প্রিয় জায়গা।

সেই ব্যালকনিতে একটা উঁচু টেবিলের ওপর ঝুঁকে লম্বামতো একজন জোরে জোরে কিছু পড়ছেন। মুখোমুখি বসে তাঁর ভাইবোনেরা একমনে শুনছেন। খেলার টান ভুলে কিছুক্ষণের জন্য আমি বারান্দার কোনায় আটকে গিয়েছি। কল্পনার লাগাম ছেড়ে দিলে একটা জাদুকরী কণ্ঠস্বরের ওঠাপড়াও যেন কানে শুনতে পাই।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন


বড় হতে হতে মা-খালাদের মুখে শুনেছি, মুনীর চৌধুরী নতুন কিছু লিখলে ভাইবোনদের পড়ে শোনাতেন। তিনি ছিলেন আফিয়া বেগম আর আবদুল হালিম চৌধুরীর দ্বিতীয় সন্তান, আমার মা দিলু (দিলারা বেগম) অষ্টম। রাহেলা বানু তাঁদের ১৪ নম্বর সন্তান।

রাহেলা খালা একটা পুরোনো ছবি খুঁজে দিয়েছেন। তাতে দেখেছি, লেখা পড়ে শোনাতে ব্যালকনিতে পাঁচ বোনের সঙ্গে পাটি পেতে বসেছেন ভাই। বাকি এক বোন ফেরদৌসী মজুমদার এ ছবিতে নেই, কিন্তু মুনীর মামাকে নিয়ে আমাদের শোনা নানা গল্পে প্রবলভাবে আছেন।

৫ বোনের মধ্যে মুনীর চৌধুরী; একটু পরে শুরু হবে লেখা পড়ে শোনানোর পালা (আনুমানিক ১৯৬৫–১৯৬৭)
ছবি: সংগৃহীত

মুনীর মামা বড়শিতে মাছ ধরতে খুব ভালোবাসতেন। বড় খালার কাছে শুনেছি, তাঁদের অল্প বয়সে একবার পাবনায় নানার কর্মসূত্রে বরাদ্দ পাওয়া বিশাল বাসার মস্ত পুকুরে ধরা পড়া বড় একটা মাছ ছুটে চলে যাচ্ছিল। তিনি নাকি ঝাঁপিয়ে পড়ে লেজ কামড়ে সেটাকে সাপটে পাড়ে তোলেন।

আমার বছর তিনেক বয়স থেকে আমরা থাকতাম হাতিরপুল এলাকায় পুকুরপাড়ে। পুলের পশ্চিম ঢাল থেকে উত্তরে অনেকটা ভেতরে গিয়ে গলি শেষ হতো আমাদের পাড়ায়। বিশাল এক পুকুরের তিন দিক ঘিরে নিরিবিলি নিরাপদ পাড়া। পুবে আরেকটা পুকুরের পর দূরে রেললাইন দেখা যেত।

আমার বাবা নাহার (আবদুল মুক্তাদির), যিনি আমার মায়ের খালাতো ভাইও বটে, বলতেন মুনীর মামা খুব নরম মনের মানুষ ছিলেন। সবাইকে ভালো জানতেন, শত্রু–মিত্র ভেদ না করে উপকার করতেন।


আমার মায়েরও ছিল মাছ ধরার নেশা। তাঁর সঙ্গে পুকুরের তিনটি ঘাটে বসে হাতছিপে আমরা টপাটপ পুঁটি মাছ ধরতাম। মায়ের একটু বড় ছিপে অনেক ফলি মাছ উঠত। মুনীর মামা আসতেন হুইল বড়শি নিয়ে, পুকুরের পাড়ে নারকেলগাছের ছায়ায় আয়োজন করে সারা দিনের জন্য মোড়া পেতে বসতেন।

এক বিকেলে তাঁর বড়শিতে বড় শিকার বাঁধল। অনেক খেলিয়ে সেটাকে পাড়ের কাছ আনলেন। দেখা গেল, সেটা মৃতপ্রায় এক প্রাচীন কচ্ছপ।

জালের বড় ছাঁকনিতে করে সেটাকে তোলা হলো। কাছেই কয়েক ঘর ধোপা থাকতেন। কেমন করে খবর পেয়ে তাঁদের কয়েকজন তড়িঘড়ি এসে কচ্ছপটা উল্টে খোলার ওপর ফেলে গড়গড়িয়ে নিয়ে চলে গেলেন—রাতে ভোজ হবে।

২.
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর মুনীর মামারা আমাদের সেই নিরাপদ পুকুরপাড়ের বাসায় দেড়-দুই মাস ছিলেন। ছিলেন বাবার বন্ধু সমরজিৎ রায় চৌধুরীর পরিবারসহ আরও অনেকজন। মায়ের কাছে শুনেছি, সব মিলিয়ে জনাবিশেক মানুষ।

শিশু ছিল পাঁচজন—সমরজিৎ কাকুর দুই ছেলে-মেয়ে সুমন আর রুমা, আমার দুই ভাই কুশল ও অতল আর মুনীর মামার ছোট ছেলে তন্ময় (আসিফ মুনীর)। আমার মেজ খালা (কণা—রওশনআরা বেগম) ও মেজ কাকার (বাহার—আবদুল মোকাদ্দেম) মেয়ে লালীও (আয়েশা বানু) কিছুদিন ছিল। আমরা সাত-আট বছর বয়সী।

পাড়ায় কাছাকাছি বয়সী বন্ধু কম ছিল না। স্কুলে যেতে হচ্ছে না—খেলা, মাছ ধরা আর কাঁচা আম কুড়িয়ে ঘষা ঝিনুক দিয়ে ছিলে খাওয়ার স্মৃতিটাই প্রবল। তন্ময়ের মেজ ভাই মিশুক (মুনীর) আমাদের তিন-চার বছরের বড়। সে গুরুজনোচিত ভাব নিয়ে থাকত! বড়দের উদ্বেগ, উত্তেজনা, স্বাধীন দেশ পাওয়ার আশা-প্রত্যাশা-তৎপরতা আমরা টের পেতাম। রোমাঞ্চ হতো।

স্ত্রী লিলি চৌধুরীর সঙ্গে মুনীর চৌধুরী, কোলে তাঁদের সন্তান তন্ময় (১৯৬৮)
ছবি: সংগৃহীত


ছোট সেই বাসায় পাশাপাশি তিনটি ঘরে ঢালা বিছানা করে রাতে আমরা ঘুমাতাম। জানালার পর্দা টেনে বৈদ্যুতিক বাতির বদলে হারিকেন-মোমবাতি জ্বালানো হতো। করিডর দিয়ে ঢুকে প্রথম ঘরটা ছিল আমাদের বসার ঘর। মুনীর মামারা সেই ঘরে থাকতেন। সন্ধ্যায় সে ঘরে রেডিও ঘিরে বসে বড়রা ‘চরমপত্র’ শুনতেন। আমাদের তখন ঢোকার অনুমতি ছিল না।

এতজন মানুষের খাওয়াদাওয়া চলত মিলেমিশে। মায়ের কাছে শুনেছি, বাবা বাজার করে দিয়ে বেরিয়ে যেতেন। মুনীর মামা কাছে বসে দেখতেন, কোটা–বাছায় হাত লাগাতেন। বলতেন, ‘খুব ভালো লাগে দেখতে যে তোরা কী করিস!’ কোমরে ব্যথার জন্য একটু টেনে হাঁটতেন। স্যান্ডেলের শব্দ শুনে মা ফিরে তাকালেই জড়িয়ে ধরে আদর করতেন।

দুপুরে মাছ-আলু-সবজি-ডাল; রাতে মাংস, কখনো ডিম—এসব থাকত। কখনো লিলি (চৌধুরী) মামি গুঁড়ো দুধ দিয়ে ঘন করে মেখে দুধভাত খেতে দিতেন। নাশতা চিড়া, আখের গুড়, কলা বা মুড়ি।

ঘরোয়া আড্ডায় মুনীর চৌধুরী (১৯৭০)
ছবি: সংগৃহীত


আমার বাবা নাহার (আবদুল মুক্তাদির), যিনি আমার মায়ের খালাতো ভাইও বটে, বলতেন মুনীর মামা খুব নরম মনের মানুষ ছিলেন। সবাইকে ভালো জানতেন, শত্রু–মিত্র ভেদ না করে উপকার করতেন। আত্মীয়স্বজন সবার ঝুঁকির কথা ভাবতেন। একরকম বাধ্য হয়েই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে ফিরে যান। পরে সেন্ট্রাল রোডে মায়ের বাসায় চলে যান।

৩.
একাত্তরে সেখানে আমার নানু, রাহেলা খালা, আরও দুই মামা ও তাঁদের পরিবার থাকত। বাসার নাম দারুল আফিয়া—আফিয়ার বাসা।

আমার নানু আফিয়া বেগমের বিয়ে হয়েছিল ১১ বছর ৮ মাস বয়সে, স্বামীর বয়স তখন ৩০-এর কাছাকাছি। ছোটখাটো মানুষটি ১৫ বছর বয়স থেকে শুরু করে ১৫ জন জীবিত সন্তানের জন্ম দেন; শেষের জন কয়েক মাস বেঁচেছিল। মুনীরের জন্ম তাঁর ১৭ বছর বয়সে, আর মৃত্যু তাঁর ৬৩ বছর বয়সে। স্বামী চলে গেছেন তার আগের বছর।
আমার নানা আবদুল হালিম চৌধুরী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট-কালেক্টর হিসেবে অবসরে যান। নোয়াখালীর প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অত্যন্ত বিদ্যানুরাগী, একইসঙ্গে কড়া ও স্নেহশীল, কঠোর নিয়মানুবর্তী, পরিশ্রমী আর বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন। অতি সুদর্শন ছিলেন।

ছেলেমেয়ে প্রত্যেককে পড়িয়েছেন, ধর্ম ও নীতি শিখিয়েছেন। বাড়ির পরিবেশ ছিল রক্ষণশীল। কিন্তু ছেলেমেয়েরা যখন নিজের পথ ও মত বেছে নিয়েছেন, তিনি তা মেনে নিয়েছেন। ছেলেমেয়েরা ছিল তাঁর অহংকার।

বড় খালা হেনার (নাদেরা বেগম) কাছে শুনেছি, সবার বড় মানিক ভাই (কবীর চৌধুরী) প্রথম তাঁকে বোরকামুক্ত করেন। আর কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে পড়ে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শুরু করলে মুনীর ভাই তাঁর ‘চোখ খুলে দেন’। তাঁর শিক্ষায় বড় খালা কমিউনিস্ট আন্দোলনের পথ ধরে ভাষা আন্দোলনে জড়িত হন।

মুনীর ভাইই ফেরদৌসীকে নাটকের জগতে টেনে নিয়েছেন; ‘মনে পড়ে’ আর অন্যান্য বইয়ে সে বিবরণ বোন লিখেছেন। বোনদের কেউ, কাজিনসহ, বিপন্ন ও একাকী হয়ে পড়লে মুনীর ভাই পাশে থেকেছেন। ভালোবেসে কাপড় ধোয়া, ছেলের দুধের বোতল ধোয়ার মতো বাড়ির কাজ করতেন; গাড়ি চালিয়ে বাবাকে শুক্রবারে মসজিদে নিতেন; বাজার করতেন, যত্ন করে সবাইকে খাওয়াতেন।

একাত্তরে দারুল আফিয়ায় থাকার সময় মুনীর মামা নিয়মিত বাজার করতেন। মৌসুমের প্রথম কাঁচা আম, প্রথম সবজি, টাটকা মাছ কিনে আনতেন; একই পাড়ায় থাকা শ্বশুরবাড়িতেও দিয়ে আসতেন। গোস্ত-রুটি খেতে ভালোবাসতেন।

তিনি কথা বলতেন নাকি খুব মজা করে। রাহেলা খালার মুখে শুনেছি, তাঁর লেখাতেও পড়েছি, কেউ তাঁদের বয়সের পার্থক্য জানতে চাইলে মুনীর মামা বলতেন, ‘ওর আর আমার মধ্যে আরও ১১ জন আছে।’ একাত্তরে এই বোনের বানানো পরোটা খেয়ে মাকে বলেছিলেন, ‘খুব মজবুত হয়েছে, বরকত হবে।’

মা আফিয়া লেখাপড়া শিখেছিলেন তাঁর মা আর স্বামীর কাছে। বইয়ের পোকা ছিলেন; ১৯৭৫ সাল থেকে ২০০০ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। তাঁর ‘উজ্জ্বল রত্ন’ মুনীরের কথা বলে-লিখে শেষ করতে পারতেন না।

নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন মুনীর চৌধুরীর মা আফিয়া বেগম
ছবি: সংগৃহীত


ছোটবেলায় মুনীর খুব দুষ্টু ছিল। অভিমানীও ছিল। ম্যাট্রিক পড়ার সময় একদিন বাজার থেকে বড় বোয়াল মাছ আনা হয়েছে। মা বাটা মসলা দিয়ে তার ভুনা করেছেন। খেতে এসে মুনীর বলল, সে বোয়াল মাছ খাবে না। মা তাকে দুটো ডিম ঘি-মরিচ-পেঁয়াজ দিয়ে ভেজে দিলেন। তা দিয়ে খেয়ে ছেলে বলে, ‘এবার মাছ দেন।’

মা বললেন, ‘ও, তোমার চালাকি? ফাঁকি দিয়ে দুইটাই উসুল করতে চাও?’ ছেলে ভাত ফেলে কেঁদে ওপরে গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। মা হতবুদ্ধি। পরে বড় ছেলে মানিক খেতে এসে মাখা ভাত দেখে সব জানলেন। তিনি গিয়ে ভাইকে ডেকে এনে মাছভাত খাওয়ালেন।

মা লিখেছেন, ‘আমি কালো, মুনীরও কালো। মানিক ফরসা, ওর আব্বাও ফরসা। তাই ওর আব্বা বলতেন, “তুই তোর মায়ের ছেলে। মানিক আমার ছেলে।”…আমার গলার আওয়াজও নাকি মুনীরের গলার আওয়াজের মতো। আমার ছেলে আমার মতো। কিন্তু আমাকে ফেলে সে চলে গেল।’

নানু আমাকে বলেছিলেন, একাত্তরে রান্নাঘরের সামনের উঠানে একটা লাউয়ের চারা উঠলে মুনীর মামা সেখানে মাচা দেওয়ান। লাউ বড় ভালোবাসতেন। একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর মায়ের রান্না করা শোল মাছ-লাউয়ের তরকারি তাঁর খাওয়া হয়নি।

রাহেলা খালার মুখে শুনেছি, ‘অনেক দিন পর পর্যন্ত মা দরজার দিকে তাকিয়ে থাকতেন—যদি মুনীর আসে। তিনি কখনো শব্দ করে কাঁদতেন না। ‘আল্লাহ’ বলে জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন।’


বিজ্ঞাপনী সংস্থা বিটপীর কর্ণধার রেজা আলী আর বন্ধু জাহেদ ইকবালের গাড়িতে করে আমার বাবা ভারতে লোক পারাপারের কাজে যুক্ত ছিলেন।

বাবার ছোট বোন মালেকা বেগম আর দু-তিনজন ভাই ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী ছিলেন। মেজ কাকার ছেলে (এম.এম.) আকাশসহ তাঁরা একাত্তরে ভারতে চলে যান।

লিলি মামি, যুদ্ধে যোগ দেওয়া বড় ছেলে ভাষণ (আহমেদ মুনীর), আমার বাবাসহ স্বজনেরা মুনীর মামাকে ভারতে যেতে, অন্তত গ্রামে যেতে রাজি করানোর অনেক চেষ্টা করেছিলেন। তিনি মা আর বোনকে বিপদের ঝুঁকিতে ফেলে রেখে যেতে চাননি। স্ত্রী ও ছেলেদের তিনি গভীর ভালোবাসতেন, সংসারের কাঙাল ছিলেন। সেই সংসার আর ভালোবাসার গণ্ডিটা সবাইকে জড়িয়ে অনেক বড় ছিল।

২০১৮ সালে ‘প্রথম আলো’য় লিলি মামি লিখেছেন, ‘১৪ ডিসেম্বর সকালে মুনীর বলেছিলেন, ‘‘দেশ এবার স্বাধীন হয়ে যাবে।’’ এ বিশ্বাস যেমন তাঁর দৃঢ় ছিল, তেমনি ভাবতে পারেননি, দেশের কেউ তাঁর ক্ষতি করবে।’

৪.
১৩ ডিসেম্বর দুপুরে মেঝেতে পড়ে আমার ছোট্ট ভাই কুশলের কপাল কেটে গেল। বাবা বাইরে ছিলেন। মা তার রক্তাক্ত কপালে বরফের পুঁটলি চেপে আমাকে নিয়ে রিকশায় করে দারুল আফিয়ায় গেলেন। তখন কারফিউয়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে।

মুনীর মামা দ্রুত নেমে এসে গাড়ি চালিয়ে আমাদের নিয়ে গেলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। সেখানে আমার মেজ কাকা ডা. আবদুল মোকাদ্দেমকে পাওয়া গেল। তিনিই সেলাই করে দিলেন। তারপর তাঁর গাড়ির পেছন পেছন আমাদের হাতিরপুল পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।

আমরা হাতিরপুলে পৌঁছালে মা রিকশা নিতে চাইলেন। মুনীর মামা জোর করে আমাদের বাসা পর্যন্ত গেলেন। ততক্ষণে সাইরেন পড়ছে। মা তাঁকে রাতে থেকে যেতে বললেন। তিনি বললেন, বাসায় সবাই চিন্তা করবে। তাড়াহুড়ায় গাড়ি ঘোরাতে গিয়ে দেয়ালে একটা ধাক্কা লাগল। তিনি চলে গেলেন।

পরদিন বিকেলেই বাবা মুনীর মামাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার খবরটা পেয়েছিলেন। আমার চোখে কয়েকটা ছবি ভাসে। ছাদের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে মা কাঁদছেন। ১৬ ডিসেম্বর নানুবাসায় লিলি মামি, নানু, খালা-মামারা। কান্না আর কান্না। আমরা ছোটরা হতবিহ্বল, থমকে আছি।

এ সময় কোনো একদিন দারুল আফিয়ায় আমার মাতৃহারা চাচাতো বোন লিপির (তিবুন্নেসা ফাতেমা খাতুন) পাশে বসে মিশুক আস্তে করে বলেছিল, ‘তোমার মা নাই, আমার বাবা নাই। আমরা এক রকম।’ যুদ্ধফেরত ভাষণ ভাইয়ের ক্ষোভ-ক্রোধ, জীবন উল্টে-পাল্টে তোলপাড় হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা আমরা ছোটরা টের পেতাম।

১৩ ডিসেম্বর বিকেলে ভাই থেকে গেলে পরদিন ঘাতকেরা হয়তো তাঁকে পেত না, সেই আক্ষেপ আমার মায়ের মন থেকে কখনো যায়নি।

[email protected]