এত জায়গায় সিভি জমা দিই, তবু কেন কেউ ইন্টারভিউতে ডাকে না

একের পর এক সিভি জমা দিচ্ছি, কিন্তু সাক্ষাৎকার বা নিয়োগ পরীক্ষার জন্য ডাক আসছে না কেন, ভেবে হয়রান হন অনেকে। হয়তো সামান্য কিছু ভুলের কারণেই এ সুযোগ আপনি পাচ্ছেন না। এ বিষয়ে কয়েকজন মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছিলাম আমরা।

হয়তো সামান্য কিছু ভুলের কারণে আপনি ইন্টারভিউতে ডাক পাচ্ছেন না
ছবি: এআই/প্রথম আলো

কাঠামোগত ত্রুটি

অনেক চাকরিপ্রার্থী এমন একটি সিভি তৈরি করেন, যা হয়তো প্রাসঙ্গিক তথ্য বহন করে না। সিভির উদ্দেশ্য হলো, নিয়োগকর্তাকে প্রাথমিকভাবে আপনার যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানানো। কিন্তু যদি সিভিটি এলোমেলো বা অপ্রাসঙ্গিক তথ্যে ভরা থাকে, তাহলে সেটি অগ্রাহ্য হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। দীর্ঘদিন জ্বালানি ও ব্যাংকিং খাতে কর্মরত মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞ লামিয়া বুশরা বলেন, ‘একটি পেশাদার ফরম্যাটে সিভি তৈরি করুন। ব্যক্তিগত তথ্য, সংক্ষিপ্ত ক্যারিয়ার লক্ষ্য, শিক্ষাগত যোগ্যতা, কাজের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, পুরস্কার ও ভাষাজ্ঞান, পদ উপযোগী সব তথ্য একটি নির্দিষ্ট ছকে উপস্থাপন করুন। প্রাসঙ্গিক তথ্যপূর্ণ সিভিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।’

চাকরির বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী সিভি না সাজানো

অনেকেই সব চাকরির জন্য একই সিভি পাঠিয়ে দেন। কিন্তু প্রতিটি চাকরির ধরন ভিন্ন, প্রয়োজন ভিন্ন। তাই সিভিও হওয়া উচিত নির্দিষ্ট পদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পদের বিবরণ (জব ডেসক্রিপশন) ভালোভাবে পড়ুন। সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাগুলোই সিভিতে গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করুন। যে চাকরিতে আবেদন করছেন, সেখানে কী ধরনের সমস্যা সমাধানে আপনার অভিজ্ঞতা ভূমিকা রাখবে, তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরুন।

ভুল বা অতিরঞ্জিত তথ্য

অনেক সময় চাকরি পাওয়ার লোভে প্রার্থীরা অতিরঞ্জিত বা ভুয়া তথ্য সিভিতে যোগ করেন, যা পরবর্তী ধাপে যাচাইয়ে ধরা পড়ে। এতে করে ভবিষ্যতে প্রার্থীর ওপর আস্থা নষ্ট হয়। মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞ ও প্রশিক্ষক রুবিনা খানের পরামর্শ, ‘আপনি যা পারেন, যেটুকু করেছেন—সেটুকুই বলুন। বাস্তব অভিজ্ঞতা ও অর্জনগুলো সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরুন। পড়াশোনা বা চাকরিতে কোনো বিরতি থাকলে সিভিতে লিখুন। কোনো তথ্য দিতে অনিচ্ছুক হলে এড়িয়ে যান, কিন্তু মিথ্যা তথ্য দেবেন না।’

আরও পড়ুন

সঠিক চ্যানেলের মাধ্যমে সিভি না পাঠানো

অনেক প্রার্থী ই–মেইলে সিভি পাঠান, কিন্তু ই–মেইলের বিষয় (সাবজেক্ট) ঠিকঠাক লেখেন না। কিংবা নির্ধারিত ফাইল ফরম্যাট অনুসরণ করেন না। এতে করে সিভি পড়া হয় না বা হারিয়ে যায়। যেখানে বলা আছে অনলাইনে আবেদন করতে, সেখানে নির্ধারিত ওয়েবসাইট বা ফরমের মাধ্যমেই সিভি জমা দিন। ই–মেইলে পাঠালে ‘Subject’ অংশে পদের নাম উল্লেখ করুন। ফাইলের নামকরণের ক্ষেত্রে ‘Name_Position_CV.pdf’-এ ধরনের পেশাদার ফরম্যাট অনুসরণ করুন।

কভার লেটার না দেওয়া বা দুর্বল কভার লেটার

অনেকে সিভি পাঠালেও কভার লেটার দেন না, বা দিলেও সেটি খুব সাদামাটা হয়। মনে হয়, স্রেফ দেওয়ার জন্য দেওয়া। অথচ কভার লেটার হচ্ছে প্রার্থীর আত্মপ্রকাশের সুযোগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) অধ্যাপক খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘চাকরিটির জন্য কেন আপনি উপযুক্ত, তা এক পৃষ্ঠায় বর্ণনা করার জন্য কভার লেটার একটা ভালো সুযোগ। নিয়োগদাতার যেন আপনার দক্ষতার ওপর আস্থা তৈরি হয়, এমনভাবে কভার লেটার সাজান।’

অপ্রাসঙ্গিক অভিজ্ঞতা তুলে ধরা

সিভিতে সব ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা ঢুকিয়ে ফেললে চাকরিদাতার জন্য মূল যোগ্যতা খুঁজে বের করা কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। অধ্যাপক খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘কেবল সেই সব অভিজ্ঞতাই উল্লেখ করুন, যা পদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। প্রতিটি কাজের বর্ণনায় আপনার দায়িত্ব ও অবদান সংক্ষেপে উল্লেখ করুন। যদি নতুন চাকরি খুঁজে থাকেন, তাহলে ট্রেনিং বা স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের অভিজ্ঞতাও তুলে ধরতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ক্লাব কার্যক্রম কিংবা স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে যুক্ত থাকলে সেই তথ্য ও কাজের বিস্তারিত লিখুন।

আরও পড়ুন

যোগাযোগের তথ্য ভুল বা অসম্পূর্ণ

অনেক সময় দেখা যায়, সিভিতে দেওয়া মুঠোফোন নম্বর বা ই–মেইল আইডিতে ভুল থাকে। অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁরা ঠিকঠাক সাড়াও দেন না। গ্রামীণ ডানোন ফুডস লিমিটেডের সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং বিভাগের পরিচালক সুরাইয়া সিদ্দিকা বলেন, ‘সব সময় হালনাগাদ মুঠোফোন নম্বর ও ই–মেইল ব্যবহার করুন। প্রয়োজনে দুটি মুঠোফোন নম্বর দিন। [email protected]এ ধরনের ই–মেইল ঠিকানা দেবেন না।’

দুর্বল অনলাইন প্রোফাইল

আজকের দিনে অনেক নিয়োগকর্তা প্রার্থীর লিংকডইন প্রোফাইল বা ফেসবুক ঘেঁটে দেখেন। সেখানে যদি নেতিবাচক কিছু থাকে বা সিভির সঙ্গে সাংঘর্ষিক তথ্য থাকে, তবে তা আপনার বিপদ ডেকে আনতে পারে। সিভিতে এক নাম আবার লিংকডইন বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্য নাম না রাখাই ভালো। একটি পেশাদার লিংকডইন প্রোফাইল তৈরি করুন। সেখানে আপনার অভিজ্ঞতা, শিক্ষা ও দক্ষতাগুলো তুলে ধরুন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শালীনতা বজায় রাখুন।

বানান-ব্যাকরণ ও ছবির ভুল

সিভি বা কভার লেটারে বানান ভুল বা অশুদ্ধ ব্যাকরণ নিয়োগকর্তার মনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে। সুরাইয়া সিদ্দিকা বলছিলেন, ‘যেকোনো প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর আগে সিভি একাধিকবার প্রুফরিড করা উচিত। প্রয়োজনে বিশ্বস্ত কাউকে দিয়ে যাচাই করিয়ে নেওয়া যায়। বানান ও ব্যাকরণ যাচাই করা তো এখন খুব সহজ। গ্রামারলির মতো ওয়েবসাইট ব্যবহার করতে পারেন।’ অনেকে সিভিতে ছবি যোগ করেন। অপ্রাসঙ্গিক ছবি, সেলফি বা অনানুষ্ঠানিক ছবি দিলে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ ক্ষেত্রে পাসপোর্ট সাইজের ফরমাল ছবি ব্যবহার করুন। ব্যাকগ্রাউন্ড হালকা এবং পোশাক করপোরেট প্রতিষ্ঠান উপযোগী হওয়া উচিত।