ইউক্রেনে রুশ যুদ্ধশিবির থেকে দুর্বিষহ জীবনের গল্প বললেন এই বাংলাদেশি তরুণ

উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে দালাল ধরে রাশিয়ায় গিয়েছিলেন। তারপর কাজ হারিয়ে এক দালাল থেকে আরেক দালালের খপ্পরে পড়ে বিক্রি হন রুশ বাহিনীর কাছে। শাহাদৎ হোসেনকে দুর্বিষহ জীবনের গল্প বললেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বাংলাদেশি তরুণ। এমন বেশ কয়েকজন তরুণ এখন রুশ বাহিনীর হয়ে ইউক্রেনে যুদ্ধ করছেন।

ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের একটি এলাকায় রুশ বাহিনীর হামলার পর ক্ষতিগ্রস্ত ভবনে উদ্ধারকাজ চলছে। ২৪ এপ্রিল ২০২৫ছবি: এএফপি

যুদ্ধশিবিরে আজ আমার ২৯তম দিন। ইউক্রেনের রুশনিয়ন্ত্রিত শহর দোনেৎস্কে আছি। প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুভয়। এই তো সেদিন আমাদের গাড়িবহরে গোলা আঘাত হানল। দিগ্বিদিক ছুটে কোনোরকম বেঁচে ফিরলাম। এখানে রুশ সৈনিক আছেন ৩০-৪০ জন। আমি সবার ছোট বলে সবাই স্নেহ করেন। অভিযানে না নিয়ে বেশির ভাগ দিন শিবিরেই কাজ করি। কমান্ডারের নির্দেশে কখনো অস্ত্রশস্ত্র, কখনো গোলাবারুদ টানি, আবার কখনো সৈনিকদের খাবার সরবরাহ করি।

বিভিন্ন যুদ্ধশিবিরে আমার মতো আরও কয়েকজন বাংলাদেশি আছেন। তাঁদের অনেকের সঙ্গেই গোপনে যোগাযোগ আছে। সেদিন একজনের মৃত্যুর খবরও পেলাম। দুর্বিষহ জীবন, তবু বাড়িতে কথা বলার সময় হাসিমুখে থাকি। মা-বাবাকে বলতেও পারি না কোথায় আছি, কত কষ্টে সবার অগোচরে তাঁদের সঙ্গে কথা বলছি।

অথচ এক সুন্দর জীবনের স্বপ্ন নিয়ে রাশিয়ায় এসেছিলাম।

উন্নত জীবনের খোঁজে

এসএসসির পর থেকেই ইউরোপের কোনো একটি দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কাজসহ উত্তর মেসিডনিয়ার ভিসা করিয়ে দেওয়ার আশ্বাসে আমার পাসপোর্টও নিয়ে যান এক দালাল।

পরে গত বছর দালাল জানান, মেসিডনিয়ায় ভিসা হবে না। রাশিয়ায় ভালো একটি কোম্পানিতে উচ্চ বেতনে কাজের একটি ভিসা আছে। মাসিক বেতন ৪০-৪৫ হাজার রুবল (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬০–৭০ হাজার টাকা)। খরচ লাগবে আট লাখ টাকা। আমার পরিবার তাতেও রাজি।

আমার তখন এইচএসসি পরীক্ষা চলছিল। এর মধ্যেই গত বছর রাশিয়ায় আসি। মাস দেড়েক পর চীন সীমান্তবর্তী ব্লাগোভেশচেনস্ক শহরের এক প্রতিষ্ঠানে আমাকে কাজে পাঠানো হয়। রাশিয়ায় ওয়েল্ডিংয়ের কাজে পাঠানো হলেও সিনোপ্যাক নামে চীনা কোম্পানিতে আমি ছিলাম ইলেকট্রিশিয়ান। তারপরও মেনে নিই। কাজ শেখায় মনোযোগী হই।

মাস দুয়েক ভালোই চলছিল। এরপর বেতন অনিয়মিত হয়ে পড়ে। ভেবেছিলাম, হয়তো সাময়িক অসুবিধা হচ্ছে, ঠিক হয়ে যাবে; কিন্তু না, ফেব্রুয়ারির শুরুতে কোম্পানি পাসপোর্ট হাতে ধরিয়ে বের করে দেয়। শুধু আমি না, আরও প্রায় ২০ জনের সঙ্গেও একই কাজ করে। তাঁদের দুজন নেপালি, দুজন ভারতীয়, বাকিরা বাংলাদেশি।

ইউক্রেনের মারিওপোলে রুশ ট্যাংক বহর
ছবি: রয়টার্স

আরেক দালালের খপ্পরে

চাকরি হারিয়ে আমরা সবাই ব্লাগোভেশচেনস্ক থেকে সাড়ে সাত হাজার কিলোমিটার দূরে মস্কোয় চলে আসি। ভাষার দূরত্ব থাকায় কাউকে কিছু বলতেও পারি না। কী করব, কিছুই কূলকিনারা করতে পারি না। তারপর যাঁর যাঁর মতো ভাগ হয়ে গেলেন। আমি পাঁচজনের একটি দলে থাকলাম। তাঁদের সঙ্গেই একটি হোটেলে কোনোমতে পাঁচ দিন কাটানোর পর দেশে ফেরার চেষ্টা শুরু করলাম। কোনো দিশা না পেয়ে সবাই চলে যাই এয়ারপোর্টে; কিন্তু কাকে কী বলব? সামান্য অর্থ সঙ্গে ছিল, তা দিয়েই খেয়ে না খেয়ে দিন কাটতে থাকে। রাতে এয়ারপোর্ট বা আশপাশের সুবিধাজনক জায়গায় থাকি। এভাবে ২০ দিন কাটানোর পর এয়ারপোর্টে একজনের সঙ্গে আলাপ হয়। গুগল ট্রান্সলেটরে সব শুনে তিনি বলেন, তোমাদের তো ভিসার মেয়াদ আছে। চলো, তোমরা কাজ করবে।

আমাদের একটি হোটেলে নিয়ে গেলেন ওই ব্যক্তি। পাসপোর্টসহ আমাদের সব কাগজপত্র নিয়ে নিলেন। হোটেলে তিন-চারজন রুশ আসেন। তাঁরা একটি চুক্তিনামায় আমাদের স্বাক্ষর নেন। সেখানে কী লেখা কিছুই বুঝি না। ছবি তুলে অনুবাদ করে দেখব, সেই সুযোগ না দিয়ে তাঁরা বলেন, এটা কাজের চুক্তিনামা।

আমরা স্বাক্ষর করি।

গোলাবারুদ আনা হচ্ছে

মাংস কাটার কাজ দেবে বলে মস্কো থেকে দূরের একটি শহরে আমাদের নিয়ে যান; কিন্তু গিয়ে দেখি, বরফ পরিষ্কারের কাজ। সপ্তাহখানেক সেই কাজই করি। এরপর একদিন গাছ কাটার কথা বলে একজন নারীসহ চারজন এসে আমাদের জঙ্গলে নিয়ে যান। গাছ কাটার কাজ করি চার-পাঁচ দিন। একদিন দেখি, সেখানেই বন্দুকসহ গোলাবারুদ আনা হচ্ছে। তারপর সিভিল পোশাকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা আসতে শুরু করেন। যাঁরা জঙ্গলে এনেছিলেন, আমাদের রেখে তাঁরা সটকে পড়েন। বুঝতে পারি, আমরা কোনো পক্ষের কাছে বিক্রি হয়ে গেছি।

সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হলো, আমাদের অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। পাঁচজনই গিয়ে কমান্ডারের পায়ে ধরলাম। তাঁকে অনুনয়–বিনয় করে আমাদের ছেড়ে দিতে বললাম। কমান্ডার চুক্তিনামার কথা বলে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন আমরা স্বাক্ষর করেছি?

বললাম, আমরা এর কিছুই জানতাম না।

কমান্ডার বললেন, এখন কিছু করার নেই।

২০ মার্চ থেকে পাঁচ দিন বন্দুক লোড আর গুলি করার প্রশিক্ষণ নিলাম। ষষ্ঠ দিনের মাথায় আমাদের ইউক্রেনে রুশ যুদ্ধশিবিরের উদ্দেশে পাঠানো হলো। অন্য বাংলাদেশিদের থেকে আলাদা হয়ে গেলাম।

ইউক্রেনে পৌঁছানোর পর আরও দুই দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো। মার্চের শেষ দিনে এক অভিযানে পাঠানো হলো। যেখানে গাড়ি রাখা হয়েছিল, সেখানেই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হলো। গাড়িতে না থাকায় বেঁচে গেলাম। সেদিন অনেকটা পথ হেঁটে ক্যাম্পে ফিরলাম।

এরপর ৭ কি ৮ এপ্রিল ইউক্রেনের লুহানস্ক শহর থেকে দেশটির আরও ভেতরের একটি এলাকায় আবার অভিযানে পাঠানো হয়। অভিযানে আমরা ১২ জন ছিলাম, ফিরে এসেছি ৬ জন।

আরও পড়ুন

পালানোর সুযোগ নেই

এরই মধ্যে চারটি যুদ্ধশিবিরে থেকেছি। বর্তমানে ৫ নম্বর শিবিরে আছি। পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয় না। টয়লেটের পাশে বা ভেতরে গিয়ে লুকিয়ে কথা বলি। দেখলে মারধর করা হয়।

খাওয়াদাওয়া নিয়ে কী আর বলব। অভিযানে গেলে না খেয়ে থাকতে হয়। আর ক্যাম্পে দুপুর ও রাতে শুকনা রুটি আর পাস্তা দেওয়া হয়।

এখান থেকে পালানোর কোনো সুযোগ নেই, কোনদিকে যাব? যতই দিন যাচ্ছে, কেউ না কেউ আহত হচ্ছেন, প্রাণ হারাচ্ছেন, ঝুঁকি বাড়ছে ও গোলাগুলি বাড়ছে। আমার অবস্থা দেখে কমান্ডার বলেন, যদি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আমার বিষয়ে যোগাযোগ করা হয়, তাহলে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

রাত-দিন মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে বসে থাকি।

বেঁচে কি ফিরতে পারব?

আরও পড়ুন