শহরে ফ্ল্যাট আমি ঠিকই নিয়েছি, কিন্তু মা আর কোনো দিন এলেন না

প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার বিশ্বজুড়ে পালিত হয় মা দিবস। সেই হিসাবে আগামীকাল মা দিবস। দিনটি উপলক্ষে মাকে নিয়ে পাঠকের কাছে লেখা আহ্বান করেছিল প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’। নির্বাচিত একটি লেখা পড়ুন এখানে।

শহরে ফ্ল্যাট আমি ঠিকই নিয়েছি, কিন্তু মা আর কোনো দিন এলেন নাছবি: সুমন ইউসুফ

তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি, বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেব। স্কুল থেকে রাত জেগে পড়ার তাগিদ দিয়েছেন হেডস্যার। তখনো আজকের মতো বাড়ি বাড়ি বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। হারিকেন বা কুপি জ্বালিয়ে পড়ি। একদিন রাতে কুপি জ্বালিয়ে পড়ছি। ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছিল বলে বারবার পাশ থেকে পড়া বন্ধ করতে বলতে থাকলেন বাবা। মন খারাপ করে সে রাতে ঘুমিয়ে পড়ি।

বিষয়টা মা খেয়াল করলেন। পরদিন পথে হেডস্যারের সঙ্গে দেখা হলে মা বললেন, ‘আপনারা তো রাত জেগে ছেলেকে পড়তে বলেছেন, কিন্তু ছেলের বাপ তো রাত জেগে পড়তে দেন না, তাঁর ঘুমের সমস্যা হয়।’

হেডস্যারের ছেলে আমার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে। আমি ক্লাসে প্রথম, সে দ্বিতীয়। স্যার প্রস্তাব দিলেন, তাঁর বাড়িতে গিয়ে যেন আমি পড়ি।

ছবি: এআই/প্রথম আলো

সেদিন থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ভাত খেয়ে হেডস্যারের বাসায় চলে যেতাম। অনেক রাত পর্যন্ত পড়ে সেখানেই ঘুমাতাম। সকালে বাড়ি এসে গোসল সেরে স্কুলে যেতাম। তিন মাস পর বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিলাম। প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুল থেকে বৃত্তি পেলাম। আমাকে নিয়ে সাড়া পড়ে গেল। সেদিন যে বাহবা পেয়েছিলাম, পরে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায়ও তা উৎসাহ জুগিয়েছে। গ্রামের কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে উচ্চশিক্ষা নিতে ঢাকায় আসি।

বাড়িতে মোবাইল ছিল না। আমার সঙ্গে এক মিনিট কথা বলার জন্য পাশের বাসার চাচির পেছন-পেছন ঘুরতেন মা। কখনো কখনো আমি কল দিতাম। ফোন ধরেই বলতেন সাবধানে চলতে ও পড়াশোনা করতে।

মা ছিলেন নিরক্ষর মানুষ। তিনি চাইতেন, তাঁর পাঁচ ছেলেমেয়েই শিক্ষিত হয়ে ভালো চাকরি করুক। আমরাও চেষ্টা করেছি। কিন্তু অভাবের সংসারে সব ভাইবোন পারিনি। তাই আমাকে নিয়ে তাঁর প্রত্যাশা ছিল বেশি। মা স্বপ্ন দেখতেন, আমি একদিন অফিসার হব, শহরে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকব। গ্রামের কুঁড়েঘর ছেড়ে সেই বাসায় এসে তিনি অনেক দিন থাকবেন।

শহরে ফ্ল্যাট আমি ঠিকই নিয়েছি, কিন্তু মা আর কোনো দিন এলেন না।

লেখক: সার্কেল অ্যাডজুট্যান্ট, কক্সবাজার আনসার ব্যাটালিয়ন