গণিতের প্রতি ভালোবাসাই তাঁকে পথ দেখিয়েছে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ ফেরদৌস
ছবি: মুহাম্মদ ফেরদৌসের সৌজন্যে

ছোটবেলা থেকেই গণিতের প্রতি টান। সহপাঠীরা যখন জটিল অঙ্ক মেলাতে হিমশিম খেত, তখন সহজেই সমাধানে পৌঁছে যেত ছোট্ট ছেলেটি। অবাক হতেন শিক্ষকেরা। সেই আগ্রহই তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে বিশ্বমঞ্চে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক হয়েছেন, পেয়েছেন আন্তর্জাতিক পুরস্কার।

বলছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ ফেরদৌসের কথা। এ বিভাগের তিনি চেয়ারম্যানও। জন্ম কুমিল্লার তিতাস থানার উলুকান্দি গ্রামে। তবে বাবার চাকরির সুবাদে চলে আসেন মুন্সিগঞ্জে, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন কে কে গভ. ইনস্টিটিউশনে। এই স্কুলের ভর্তি ছিল তুমুল প্রতিযোগিতাপূর্ণ। দূরদূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা এসে ভর্তি হতো।

আরও পড়ুন

একদিন বাবা বলেন, ‘যদি এই স্কুলে ভর্তি হতে পারো, যা চাও তা-ই পাবে।’ বাবার কাছ থেকে বোধ হয় এই অনুপ্রেরণা, সমর্থনটুকুই ফেরদৌসের চাওয়া ছিল। এর পর থেকে একে একে নানা প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সাফল্য পেয়েছেন তিনি। অনেক বাধা ডিঙিয়ে ২০২২ ও ২০২৪ সালে স্ট্যানফোর্ড-এলসেভিয়ারের শীর্ষ ২ শতাংশ গবেষকের তালিকায় স্থানও পেয়েছেন।

গবেষণার আনন্দ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় গণিতে ২৫-এ ২৫-ই পেয়েছিলেন মুহাম্মদ ফেরদৌস। বিষয় বাছাইয়ের জন্য যখন গেছেন, তৎকালীন ডিন তাঁর নম্বর দেখে অবাক হয়ে বলছিলেন, ‘তুমি গণিত পড়ো। এই পথেই আলো পাবে।’

সত্যিই গণিত তাঁকে পথ দেখিয়েছে। একদিন অধ্যাপক মো. আবদুস সাত্তারের সঙ্গে দেখা করে গবেষণার দিকনির্দেশনা চান তিনি। সব শুনে অধ্যাপক মো. আবদুস সাত্তার একটু অবাকই হন। বলেন, স্নাতক শেষের আগেই থিসিস নিয়ে এত আগ্রহ তিনি আর কোনো ছাত্রের মধ্যে পাননি।

এভাবেই গবেষণার জগৎ ধীরে ধীরে টেনে নেয় মুহাম্মদ ফেরদৌসকে। লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয় (যুক্তরাজ্য), টুয়েন্টি বিশ্ববিদ্যালয় (নেদারল্যান্ড) ও টোকিও মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয় (জাপান) থেকে বৃত্তিসহ উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন। পিএইচডির জন্য শেষ পর্যন্ত টোকিও মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়কেই বেছে নেন। প্রথম দিনই অধ্যাপক মাসাহিরো ওতার ব্ল্যাকবোর্ডে বাংলাদেশের পতাকার লাল বৃত্তটা এঁকে বলেছিলেন, ‘তুমি এখন সমুদ্রের মাঝখানে। স্রোত প্রতিকূল হবে, ঢেউ আঘাত করবে। কিন্তু তীরে ভিড়তে চাইলে সবকিছুর মোকাবিলা করতে হবে।’

তিন বছরে ৯টি গবেষণাপত্র, অনেক রাতজাগা মুহূর্ত আর কঠিন ‘ডিফেন্স’ শেষে ফেরদৌস লাভ করেন তাঁর কাঙ্ক্ষিত পিএইচডি। পেনস্টেট বিশ্ববিদ্যালয় (যুক্তরাষ্ট্র) থেকে পোস্ট ডকের ডাক এসেছিল। তবে মুহাম্মদ ফেরদৌসের কানে বাজছিল বাবার কথা—‘দেশের প্রতি তোমার দায়বদ্ধতা মনে রেখো।’

অতএব দেশে ফিরে আসেন তিনি।

নানা অর্জন

আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরেন মুহাম্মদ ফেরদৌস; তবে এবার আর শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষক হয়ে। প্রভাষক থেকে অধ্যাপক, গণিত থেকে ফলিত গণিত—তাঁর সীমানা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। পিএইচডি পর্যায়ে ৯ জন, স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ৩৮ জন, এবং স্নাতক পর্যায়ের ৪৭ জন শিক্ষার্থী এই শিক্ষকের অধীনে গবেষণা করেছেন; যাঁদের অনেকে আজ বিশ্বের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে আলো ছড়াচ্ছেন।

বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স গোল্ড মেডেল, রাষ্ট্রপতির হাত থেকে ইব্রাহিম গোল্ড মেডেল, তিনবার ডিনস অ্যাওয়ার্ড—এসবের চেয়েও অধ্যাপক ফেরদৌসের কাছে বড় অর্জন তাঁর শিক্ষার্থীরা, যাঁদের চোখে তিনি নতুন স্বপ্ন দেখেন।

২০২৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত ২৬তম আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে বক্তৃতার জন্য আমন্ত্রিত হয়ে তিনি ‘তরুণ বিজ্ঞানী অ্যাওয়ার্ড’ পান। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে বিজ্ঞান অনুষদে তাঁর গবেষণাপত্রের মাধ্যমে তিনি গবেষণায় সর্বোচ্চ সম্মাননা পেয়েছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেশ কয়েকটি ফেলোশিপেও অংশ নিয়েছেন।

আরও পড়ুন