কাবাবনামা ১

৯ জুলাই বিশ্ব কাবাব দিবস। কাবাবের মতো জিবে জল আনা স্বাদ, ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে কাঠ-কয়লা পোড়া ধোঁয়ার ঝড় তোলা অনুভূতি খুব কম খাবারেই আছে পৃথিবীতে। ছেলে-বুড়ো সবার পছন্দের তালিকায় একেবারে শীর্ষস্থানীয় এই হাজারো রকমের কাবাব যুগ যুগ ধরে বিশ্বের উপাদেয় খাদ্যগুলোর একটি হয়ে সবার মন জয় করে আসছে। দেশ-বিদেশের কাবাবগুলোতে মসলা, উপকরণ, প্রস্তুতপ্রণালির দিক থেকে বিচিত্র রকমের ভিন্নতা থাকলেও সব কাবাবের বেলায় একটি কথা খাটে; তা হলো এর স্বাদগন্ধের রাজকীয় ভাব।

ঝলসে নিলেই কাবাব নয়

সপ্তদশ শতকের কাবাব তৈরির সরঞ্জাম

গ্রিল করে বা ঝলসে নিলেই যে তা কাবাব হয়ে যায়, তেমন কিন্তু নয় ব্যাপারটি। পশ্চিমা দেশীয় বার-বি-কিউ, ইন্দোনেশিয়ান সাঁতে, জাপানি ইয়াকিতোরি,  লাতিন আমেরিকান এন্তিকুচো—এ সব খাবারই মাংস আগুনে ঝলসে তৈরি হয়। কিন্তু বহু যুগ আগে তুর্কিস্তান, পারস্য, আরব অঞ্চলের দেশগুলোতে বিশেষ কায়দায় হরেক সুগন্ধি মসলায় সময় নিয়ে মেখে রেখে হাড়ছাড়া মাংস ধাতব শলাকায় গেঁথে আগুনে ঝলসে নিয়ে যে সুখাদ্য তৈরি হতো, তা-ই দিন বদলের পালায় আফগান আর মোগলদের হাত ধরে কাবাব নামে এল আমাদের উপমহাদেশে।  

মার্কিন মুলুকের কোবাব

আবার সেই তুর্কি শিস বা আরব কাবাব বিলাতে আর ইউরোপের অন্যান্য দেশে গিয়ে মুখ বদলে নাম পেল কেবাব। আর মার্কিন মুলুকে গিয়ে হয়ে গেল কাবোব। তবে নাম যা-ই হোক না কেন, কাবাবের জনপ্রিয়তা সারা বিশ্বেই আকাশচুম্বী। একেবারে  আমজনতার হাতের নাগালে স্ট্রিটফুড কার্ট বা ঠেলা থেকে শুরু করে তারকাখচিত বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ—সব জায়গাতেই মিলবে কাবাব। এই কাবাবনামা লিখতে গেলে ফেরদৌসীর ‘শাহনামা’র চেয়ে তা কম কিছু বড় হবে না। তবুও ঘুরে আসা যাক কাবাবের দুনিয়ায় কাবাবি জাদুর গালিচায় করে।

শিক কাবাব ও শিস কাবাব

কাঠিতে বা শিকে গেঁথে ঝলসানো

কাঠিতে বা শিকে গেঁথে ঝলসানো, সারা দুনিয়ায় সবচেয়ে জনপ্রিয় এই কাবাবের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন বলে জানা যায়৷ সেই ১৩০০ শতকের তুর্কি পাণ্ডুলিপি ‘কিসসা এ ইউসুফ’-এ যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদের আশপাশ থেকে শিকার করা পশুর মাংসের টুকরা তরবারিতে গেঁথে খোলা আগুনে ঝলসে কাবাব বানিয়ে খাওয়ার গল্প বলা আছে। বিশ্বজুড়ে এখন সাধারণত বাঁশের বা কাঠের কাঠি, লোহার শিক প্রভৃতিতে কাবাব গাঁথা হলেও তুর্কিরা এখনো চ্যাপ্টা ধাতব তলোয়ারসদৃশ স্কিউয়ারে গেঁথেই কাবাব তৈরি করে। কাবাবের মসলা একেক দেশে একেক রকম। তবে আফগানি, পারসি শিস কাবাবে মাংসের টুকরাতে মেশানো মসলা অনেকটাই মৃদু স্বাদের, সঙ্গে শুষ্কভাব দূর করতে চর্বির ব্যবহার হয়। সর্বসাকল্যে দেওয়া হয় লবণ, গোলমরিচগুঁড়া, লেবুর রস, দারুচিনিগুঁড়া আর অলস্পাইস। অথচ ভারতীয় উপমহাদেশের আগুন ঝাল শিক কাবাবে মাংসের কিমার সঙ্গে মরিচের গুঁড়া, ধনেগুঁড়া, জিরাগুঁড়া, আদা-রসুনবাটা, কাবাব চিনি, তারা মসলা, জয়ত্রী, জায়ফল, তেজপাতা, এলাচ, দারুচিনি, গোলমরিচ, দই—এই এত কিছু দিয়ে শিকের চারদিকে হাত দিয়ে চেপে চেপে আকৃতি দিয়ে তারপর ঝলসে নেওয়া হয় মাঝারি আঁচের কাঠকয়লার আগুনে।

শিসকাবাব

আবার বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় এই শিসকাবাব একেক দেশে তাদের নিজস্ব মসলার কারুকাজে তৈরি করা হয়। এতে ক্যাপসিকাম, পেঁয়াজ, টমেটো, বেগুন প্রভৃতি সঙ্গে গেঁথে নেওয়া হয়, যা অঞ্চল ভেদে শাসলিক বলে পরিচিত। এই শাসলিক নামটি কিন্তু আবার শিসকাবাবেরই ‘বালটিক’ (Baltic) রূপ। মজার ব্যাপার হলো, আমাদের দেশে শিককাবাব বলে যেই নরম-গরম মোমের মতো ঝাল ঝাল শিকে গেঁথে ঝলসানো কাবাব সমাদৃত, তা আসলে উৎপত্তিগতভাবে বিহারি কাবাব। এই বিহারি কাবাবে হরেক মসলার সঙ্গে দই আর পেঁপে বাটায় খুব পাতলা করে কাটা মাংসের টুকরা মেখে রেখে তার আঁশগুলো নরম করে ফেলা হয় ঝলসানোর আগে। আর বিহারি কাবাবে পুরো গরমমসলা তেলে ভেজে সঙ্গে বেরেস্তা পেঁয়াজবাটা ব্যবহার করা হয় মাংস মাখাতে। বাদামবাটাও দেওয়া হয় এতে প্রথাগত পাকপ্রণালিতে।

টিক্কা কাবাব

চিকেন টিক্কা কাবাব

টিক্কা কথাটি কিন্তু আসলে এসেছে পারসি ‘তিক্কে’ শব্দ থেকে, যার অর্থ টুকরা। সাধারণত মাংসের টুকরা দই ও বিভিন্ন মসলা দিয়ে মেখে রেখে লোহার শিকে গেঁথে গনগনে তন্দুরে ঢুকিয়ে খুব কম সময়ে ওপরে ঝলসানো আর ভেতরে রসাল টিক্কা কাবাব তৈরি হয়। অনেক ইতিহাসবেত্তা এই টিক্কাকে মোগলদের আমদানি বললেও ভারতীয় উপমহাদেশে এই কাবাবের নিজস্ব ইতিহাসও কিন্তু আছে। প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতার পুরাকীর্তির নিদর্শনেও তন্দুর ধরনের চুল্লির সন্ধান মিলেছে। জানা গেছে, তাতে মাংসের টুকরা মসলাপাতি, বিশেষ করে ঝাঁজালো কালো সরষে বাটায় মেখে কাবাব বানিয়ে খাওয়ার কথা।

বিভিন্ন রকমের মরিচ উৎপাদন শুরু হওয়ার পর ভারতের উত্তরাঞ্চল, বিশেষ করে পাঞ্জাবে এই তন্দুরে তৈরি করা ঝালে লালে নাকাল করা চিরচেনা মুরগির মাংসের টিক্কা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মাখন আর টমেটোর মাখামাখা ঝোলে চিকেন টিক্কা ডুবিয়ে বানানো লন্ডনপ্রবাসী বাংলাদেশি এক রেস্তোরাঁমালিক আর রন্ধনশিল্পীর উদ্ভাবিত চিকেন টিক্কা মাসালা তো এখন বিলেতের জাতীয় ডিশ। রানির ভোজসভায়ও নাকি দেখা মেলে এই পদের।

চিকেন টিক্কা মাসালা

টিক্কা কাবাবের কিন্তু আছে বহু রকমফের। ধনেপাতা, পুদিনা, কাঁচামরিচ আর পালংয়ের সবুজ রঙে রাঙিয়ে দই আর গরম মসলায় তৈরি হয় হারিয়ালি টিক্কা। হালকা ঝালে সুগন্ধি এলাচ, দারুচিনি, শাহিজিরা, কাবাবচিনির মিশেলে দই মেখে বানানো হয় রেশমি টিক্কা কাবাব। আবার মালাই, দই, বাদামবাটা, পোস্তবাটা মিশিয়ে আর জাফরানি সুগন্ধি দিয়ে তৈরি হয় মখমলি মালাই টিক্কা। টুকরো করে তন্দুরে না দিয়ে কাঠকয়লার আগুনে ঝলসে তৈরি করা কাবাবগুলোকে আবার বোটি কাবাব বলা হয়। শিকে গাঁথলেও বোটি কাবাব শিক থেকে খুলে পরিবেশন করা হয়। আবার, পনির দিয়ে তৈরি পনির টিক্কা আর মাছের কাঁটা ছাড়া টুকরা দিয়ে তৈরি মাহি টিক্কাও খুবই জনপ্রিয়।

কাবাব মে হাড্ডি

টাংরি কাবাব ও ছাড়গা কাবাব

মজার ব্যাপার হলো কাবাব মে হাড্ডি বেশ এক অপাঙ্‌ক্তেয় ব্যাপার হলেও হাড়সহ মোরগের মাংসের টিক্কা খুবই প্রিয় সবারই। হাড়সহ মুরগির রানের মাংস দিয়ে তৈরি চটপটে টকঝাল টাংরি কাবাবে আবার তেঁতুলের ক্বাথ দেওয়া হয় ঝাল মরিচের পেস্টের সঙ্গে। এর আরেকটু মৃদু স্বাদের রূপটি আবার কালমি কাবাব বলে পরিচিত। এ ছাড়া লাহোরে দেদার মসলা মেখে হাড়সহ আস্ত মুরগির ‘ছাড়গা’ তেলে ভেজে নিতে হলেও কাবাব হিসেবেই খাওয়া হয়। ভেড়া বা খাসির চাপের কাবাবও কিন্তু হাড়সহই বানানো হয়।

কিমার কাবাব

কিমা দিয়ে শিককাবাব

মাংসের কিমা দিয়ে শিককাবাব ছাড়াও মুঠো করে বা গোল, চ্যাপ্টা, লম্বাটে নানা রূপ দিয়ে বহু ধরনের বিচিত্র সব ঐতিহ্যবাহী কাবাব তৈরি হয় নানা দেশে। আমাদের উপমহাদেশের শামি কাবাবের কথাই ধরা যাক। সিরিয়ান এক রন্ধনবিদের এই অনবদ্য সৃষ্টিতে মাংসের সঙ্গে ছোলার ডাল আর অনন্য সব সুগন্ধি মসলা ও ঝালের জন্য গোলমরিচ—এই সবকিছু একসঙ্গে মসৃণ করে বেটে নিয়ে শামি কাবাব তৈরি হয়। এতে ভেতরে পুদিনা, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচকুচি বা অঞ্চল ভেদে কিশমিশ, বাদামকুচির পুর দিয়ে চ্যাপ্টা গোল করে গড়ে নিয়ে ভাজা হয় ডুবো তেলে।

শামি কাবাব ও গালৌওটি কাবাব

ঠিক একই রকম আরেক কাবাব হচ্ছে লক্ষ্ণৌয়ের গালৌওটি কাবাব। মিহি করে বাটা ভেড়া বা খাসির কিমায় অন্য সব মসলার সঙ্গে পেঁপে বাটা দেওয়ায় এই কাবাব মুখে দিতেই গলে গিয়ে নিজের নামের সার্থকতা দেখিয়ে দেয় হাতে-কলমে অথবা দাঁতে জিবে। কাঁচা কিমার সঙ্গে পেঁয়াজকুচি, পুদিনা, আদাকুচি গুঁড়া করে নেওয়া রকমারি ভাজা মসলা যেমন জিরা, এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, তেজপাতা প্রভৃতি মিশিয়ে চ্যাপ্টা-গোল কাবাব গড়ে নিয়ে ডিমে চুবিয়ে তেলে ছাড়া হয় জালি কাবাব। তেলে দিয়ে আবার এর ওপরে হাত দিয়ে তরল ডিম ছড়িয়ে ছড়িয়ে জালিদার আকৃতি দেওয়া হয় এই কাবাবকে।

পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় চাপলি কাবাবও কিমার তৈরি। এতে কিমার সঙ্গে ফেটানো ডিম, টমেটো, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, আদা ঝুরি, গরমমসলা, কাবাবচিনি প্রভৃতি খুব ভালোভাবে ফেটিয়ে মেখে দুহাতের তেলোয় নিয়ে একদম চিড়ে-চ্যাপ্টা আকৃতি দিয়ে অল্প ছ্যাঁকা তেলে ভাজা হয় চাপলি কাবাব।

চাপলি কাবাব ও কোফতা কাবাব

কিমার কাবাবের গল্পের আরেক নায়ক হচ্ছে কোফতা কাবাব, কোফতে বা কেফতাহ। পারস্য, ইরাক, মরক্কো, তুরস্ক, লেবানন, আরব—সবারই আছে কোফতের নিজস্ব রেসিপি। আরবে এতে অরেগানো ও থাইম দেওয়া হয় দারুচিনি আর অলস্পাইস গুঁড়ার সঙ্গে। আবার তুর্কিরা এতে সুমাক দিতে ছাড়ে না। কোফতেতে সাধারণত সুজি বা রুটির গুঁড়া দেওয়া হয় আর একটু লম্বাটে করে গড়ে নিয়ে ভাজা হয়। (চলবে)

ছবি: উইকিপিডিয়া, পেকজেলসডটকম ও ইউটিউব