টোখা গ্রামের সুস্বাদু চাকু

নেপালে ১২ মাসে ২২টির বেশি উৎসব। জানুয়ারির প্রধান উৎসব হলো মকর বা মাঘে সংক্রান্তি। থারু সম্প্রদায়ের মানুষেরা এই বিশেষ দিনটিকে নাচ–গানের সঙ্গে উদ্‌যাপন করে। আর তির খেলে মাগর সম্প্রদায়ের লোকজন। নেপালের অন্যান্য সম্প্রদায়ও বেশ ঘটা করেই মাঘে সংক্রান্তি পালন করে থাকে। উৎসবে নেপালিরা খায় সুস্বাদু চাকু। হ্যাঁ, চাকু একটি জনপ্রিয় নেপালি খাবার। নেওয়ারি সম্প্রদায়ের ভেতর এ খাবার সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। নেওয়ারি ভাষায় চাকু মানে ‘মিষ্টি’। এটি একান্তই নেপালের নিজস্ব।

উৎসবে নেপালিরা খায় সুস্বাদু চাকু, এই সেই চাকু
ছবি: সংগৃহীত

পাহাড়ের ওপর নির্মল টোখা গ্রাম। টোখা মানে আখ চাষ। গ্রামজুড়ে সুবাস ছড়াচ্ছে প্রকৃতি। এ ঘ্রাণ বেশ সতেজ এবং ক্ষুধাবর্ধক। গ্রামের শিশুরা মহানন্দে রাস্তার চারপাশে দৌড়াচ্ছে, খেলছে। আমি ‘টোখা চাকু’ লেবেলটি দেখে গ্রামের কাছে যেতেই একটি ঘরোয়া পরিচিতি ঠান্ডা আবেশ আমাকে জড়িয়ে ধরল। চাকুর অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে টোখা গ্রাম। চাকুর উৎপাদনকেন্দ্র হওয়ার পাশাপাশি মিষ্টিটির জন্মস্থানও টোখা। টোখার প্রতিটি কোণে চাকু উৎপাদন কারখানা রয়েছে। গ্রামের কমবেশি প্রায় প্রত্যেকের বাড়িতেই আছে চাকুর বয়াম।

তৈরি হচ্ছে চাকু
ছবি: সংগৃহীত

কারখানায় ঢুকতেই উষ্ণ হাওয়া শরীর ছুঁয়ে যায়। নাকে আসে চাকুর গরম সুঘ্রাণ। কারখানার লোকেরা লোকসংগীত ছেড়ে চাকু বানাচ্ছে। অনেকগুলো চুলার ওপর বিশাল পাত্রে তরল আখের গুড় টগবগ করে ফুটছে। এক পাশে ফাঁকা জায়গায় গলিত গুড় ঠান্ডা করা হচ্ছে। পাশেই  ঘি, তিল, নারকেল মিশিয়ে চাকু ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখছেন কয়েকজন নারী। একটি কাঠের বোর্ডে পেরেকের ওপর একটি বিশাল চাকুর ঢিবি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপর প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে সামনে–পেছনে টানা হচ্ছে। এমনটা কেন করা হচ্ছে, জিজ্ঞাসা করতেই কারখানার মালিক জানালেন, চাকুর রং হালকা করার জন্য।

চাকু তৈরি করছেন টোখা গ্রামের অধিবাসীরা
ছবি: সংগৃহীত

শীতকালে চাকু তৈরির এ ঐতিহ্য নেওয়ার সম্প্রদায়ের ভেতর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বেঁচে আছে। কারখানার মালিকের বাবা হেমেন্দ্র শ্রেষ্ঠ টোখার চাকু প্রস্তুতকারকদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক আর অভিজ্ঞ। তিনি বলেন, চাকু তৈরির প্রক্রিয়াটি অনেক সূক্ষ্ম। তাপমাত্রার হেরফেরে এটি তেতো ও শক্ত হয়ে ওঠে। খেতেও হয় জঘন্য। অথচ এমনিতে এ খাবার যথেষ্ট মিষ্টি ও নরম। সঠিকভাবে বানানো চোখা আপনার মুখে গলে যাবে।

চাকু কারখানার মালিক রোহিত শ্রেষ্ঠ বলেন, ‘মানুষ মূলত শীতকালে চাকু খেতে বেশি ভালোবাসে। কেননা এটি শরীরকে গরম করে।’ তিনি আরও জানান, গর্ভবতী নারীদের জন্য চাকু খুবই উপকারী। নতুন মায়েদের জন্যও। এই খাবার তাঁদের শরীরে পুষ্টি জোগায়। বুকের দুধ তৈরিতে সাহায্য করে। তিনি যোগ করলেন, ‘সুতকেরি আইমাই লাই তা চাকু নাভাই হুন্না (একজন গর্ভবতী মায়ের জীবন চাকু ছাড়া হতে পারে না)।’ তাদের চাকু তৈরির প্রক্রিয়া স্বাস্থ্যকর। এটিকে মিষ্টি বা হালকা করতে কোনো রাসায়নিক তারা ব্যবহার করে না। চকলেটের মতো এটি আমাদের শরীর বা দাঁতের তেমন কোনো ক্ষতি করে না।

টোখায় চাকু উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত শ্রমিক এবং মালিকেরা সবাই নিজেদের একটি পরিবারের অংশ মনে করেন
ছবি: সংগৃহীত

টোখায় চাকু উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত শ্রমিক এবং মালিকেরা সবাই নিজেদের একটি পরিবারের অংশ মনে করেন। একে অপরের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে তাঁরা জড়িত। এটি নেপালি সংস্কৃতির আরেকটি সুন্দর দিক। পরিবারগুলো একসঙ্গে মিলেমিশে থাকে। ১০ বছর বয়সী একটি ছোট ছেলে চাকু প্যাক করতে সাহায্য করছিল। এই গ্রামে এ ধরনের দৃশ্য খুবই স্বাভাবিক। এভাবেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নেওয়ারদের চাকু তৈরির সংস্কৃতিকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে নিয়ে যায়।

মানুষ মূলত শীতকালে চাকু খেতে বেশি ভালোবাসে
ছবি: সংগৃহীত