বাতাসে বিরিয়ানির ঘ্রাণ

বিরিয়ানি। একটা সময়ে ছিল বিয়ে বাড়ির খাবার। এরপর সেটা রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাবার উপলক্ষ হলো। মাঝে একটু থিতিয়ে এলেও রসনাবিলাসের নতুন ট্রেন্ডের সঙ্গে প্রযুক্তির মেলবন্ধন বিরিয়ানিপ্রিয়দের জন্য সোনায় সোহাগা হয়েছে।

ছবি: ইনস্টাগ্রাম

আশির দশকের শেষ থেকে নব্বইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত ঢাকার রেস্তোরাঁ মানচিত্রে ছিল চীনা দাপট। অনুস্বারের দ্যোতনাসমৃদ্ধ নাম আর আধো-আলো আধো-অন্ধকার চীনা খাবারের রেস্তোরাঁর জয়জয়কার। চীনা রেস্তোরার বিজ্ঞাপনও সোৎসাহে প্রচারিত হয়েছে টেলিভিশনে বছরের পর বছর। আর চৈনিক পদ খাওয়াটাই ছিল ট্রেন্ড।

এর পর শূন্য দশকে শুরু হয় ফাস্ট ফুড বিপ্লব। বার্গার, চিকেন ফ্রাই আর পিৎজার দোকান অভিজাত পাড়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে গড়ে উঠল মোড়ে মোড়ে। কাচের শো-কেসে বানরুটির ওপর সস আর মেয়নেজের সঙ্গে এক ফালি শসা বিছিয়ে রাখা দেশি পিৎজা আর বিস্কুটের গুঁড়া মাখিয়ে ডুবো তেলে ভাজা মুরগির ঠ্যাং থেকে শুরু করে বহুজাতিক চেইন পিজ্জা হাট এবং কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেনেরও প্রবেশ ঘটল বাংলাদেশে। আর এসবই দেশের রসনা পরিমণ্ডলে হয়ে উঠল হ্যাপেনিং।

ছবি: উইকিপিডিয়া

কিন্তু হঠাৎ করেই যেন ভিনদেশি খাবার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাজধানীবাসী এখন মশগুল বিয়েবাড়ির স্বাদের কাচ্চি বিরিয়ানিতে। শহরজুড়ে এখন একাধিক কাচ্চি বিরিয়ানির চেইন রেস্তোরাঁ, ফুড ডেলিভারি অ্যাপ থেকে ফেসবুক পেজভিত্তিক ক্লাউড কিচেন কিংবা হোম কুক; বাতাসে এখন শুধুই বিরিয়ানির ঘ্রাণ।

কাচ্চি বিরিয়ানি, যা আদতে কাঁচা মাংসের বিরিয়ানি। এই পদ্ধতিতে বিরিয়ানিতে যে মাংসটা ব্যবহার করা হবে, সেটা আগে থেকে রান্না করা নয় বরং টক দই আর নানান মসলায় জারিত করে রেখেই নরম করতে হবে। তারপর সেই মাংসের ওপর পরতে পরতে আধসেদ্ধ চাল আর নানান মসলা ছিটিয়ে হাঁড়ির মুখ বন্ধ করে আটকে দিতে হবে আটার লেই দিয়ে। এরপর বসিয়ে দিতে হবে কাঠকয়লার আগুনের দমে, হাঁড়ির ঢাকনার ওপরও দিতে হবে জ্বলন্ত কাঠকয়লা। অঙ্গারের নিবুনিবু আঁচে আস্তে আস্তে সেদ্ধ হবে মাংস, মসলা আর মাংসের নির্যাস শুষে নেবে লম্বা দানার চাল। এভাবেই তৈরি হয় কাচ্চি বিরিয়ানি। তবে পেশাদার বাবুর্চির হাতে নিশ্চয়ই আরও অনেক কৌশল আছে, যার গুণে তাঁদের রান্না কাচ্চি বিরিয়ানি হয়ে ওঠে স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়।

সুলতান’স ডাইনের বিরিয়ানি
ছবি: সুলতান’স ডাইনের ফেসবুক পেজ

ঢাকা শহরের বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে কমিউনিটি সেন্টারে যাঁরা রান্না করেন, যেমন কামাল হোসেন ক্যাটারিং, জব্বার বাবুর্চিসহ আরও যাঁরা এই পেশায় আছেন, তাঁদের কাচ্চি বিরিয়ানি অনেক সুস্বাদু হলেও ইচ্ছে হলেই খাওয়ার উপায় নেই। কারণ তাঁদের নেই কোনো রেস্তোরাঁ। কখন কে বিয়ে করবে আর দাওয়াত দেবে, সেই আশায় বসে থাকা ছাড়া ভালো মানের কাচ্চি বিরিয়ানি খাওয়ার খুব একটা উপায় ছিল না। কারণ কাচ্চি বিরিয়ানি এমন একটা খাবার, যেটা ঘরে সীমিত পরিসরে বানানো খুব ঝক্কির, আর শহুরে ফ্ল্যাটবাড়িতে কয়লার আগুনে রান্নাটা ঝুঁকিপূর্ণও।

সুলতান’স ডাইন, কাচ্চি ভাই কিংবা ক’তে কাচ্চির কল্যাণে এখন তাই আর বিনে দাওয়াতে হুট করে কারও বিয়ের অনুষ্ঠানে না ঢুকেও সম্ভব হচ্ছে ভরপেট বিয়ে বাড়ির কাচ্চি খাওয়া!

ছবি: উইকিপিডিয়া

বিয়ে বাড়ির কাচ্চি বিরিয়ানিকে রেস্তোরাঁয় হাজির করার কৃতিত্বটা অনেকেই দেন খিলগাঁওয়ের ট্র্যাডিশন বিডি রেস্তোরাঁকে। তারাই জনপ্রিয় করে তোলে বিয়ে বাড়ির কাচ্চি বিরিয়ানির প্যাকেজ, যেখানে বিয়ে বাড়ির আদলে ডিশভর্তি বিরিয়ানির পাশাপাশি মুরগির রোস্ট, জালি কাবাব, সালাদ, আলু বোখারার চাটনি, জর্দা আর বোরহানির প্যাকেজ একজন খেতে পারেন ৬০০ টাকায়। দৃশ্যপটে দ্রুতই হাজির হয় সুলতান’স ডাইন নামের আরেকটি বিয়ে বাড়ির কাচ্চি বিরিয়ানির রেস্তোরাঁ, যারা তাদের প্রথম শাখা ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডে। সেখান থেকে এখন ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, মিরপুর, বেইলি রোড, গুলশান জয় করে সুলতান’স ডাইন পৌঁছে গেছে বন্দর নগরী চট্টগ্রামেও।

কাচ্চি ভাইয়ের বিরিয়ানি
ছবি: কাচ্চি ভাইয়ের ফেসবুক পেজ

এখানেও ‘ওয়েডিং বোনানাজা’ প্ল্যাটারে নেওয়া যাবে বিয়ে বাড়ির খাবারের ষোলো আনা স্বাদ। মুখে দিলেই মিলিয়ে যাওয়ার মতো নরম মাংস, সুসিদ্ধ আলু, বাসমতী চালের বিরিয়ানির সঙ্গে বোরহানি, কাবাব, রোস্ট, রেজালা, চাটনি, সালাদ, ফিরনি—সবকিছুই আসবে টেবিলে। চাইলে চেখে দেখা যাবে শুধু বিরিয়ানিও। অতিমারির এই সময়ে সশরীরে রেস্তোরাঁয় যেতে না চাইলেও অসুবিধে নেই, ফুডপান্ডা কিংবা ই-ফুডের মতো নানান ফুড ডেলিভারি অ্যাপ বিরিয়ানি পৌঁছে দেবে দোরগোড়ায়। অনেক সময় নানান ‘মাথানষ্ট’ অফারে রেস্তোরাঁর চেয়েও কম মূল্যে!

মিরপুর-১ সনি সিনেমা হলের মোড়ে অবস্থিত ‘ক’তে কাচ্চি’ হালফিলে নিয়ে এসেছে পেশোয়ারি পাক্কি বিরিয়ানি। কর্ণধার জাহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, বিহারি বাবুর্চির দীর্ঘদিনের সাগরেদের হাতযশে ঢাকার বুকেই মিলবে পেশোয়ারি কাচ্চি, যেটা পুরোটাই রান্না করা হয় ঘি দিয়ে, ‘আমাদের পেশোয়ারি পাক্কি বিরিয়ানিতে তেল একদমই ব্যবহার হয় না। পুরাটাই ঘি দিয়ে করা। সঙ্গে থাকে বিশেষ সব মসলা, যা পুরোটা ব্লেন্ড করে দেওয়া হয়। খাসির মাংস আমরা যাচাইবাছাই করে নিই, কোনো ভেড়া বা বকরির মাংস নিই না। কেজিতে ৮ পিস আর ১১ পিস করা হয়,’ জানিয়েছেন জাহিদ। ক’তে কাচ্চিতে আরও পাওয়া যাচ্ছে চিনিগুঁড়া কাচ্চি, রেগুলার বাসমতী কাচ্চি, গরুর মাংসের কাচ্চি, এমনকি ডায়েট কাচ্চিও!

‘ক’তে কাচ্চি’র বিরিয়ানি
ছবি: ‘ক’তে কাচ্চি’র ফেসবুক পেজ

বার্গার দিয়ে ঢাকাবাসীর মন জয় করা ম্যাডশেফও এসেছে কাচ্চি বিরিয়ানির ব্যবসায়। বনানীতে ‘পাগলা বাবুর্চি’ নামের রেস্তোরাঁ দিয়ে যাত্রা শুরু করেছে বার্গার খাইয়ে পাগল বানিয়ে দেওয়া ম্যাডশেফ বাহিনী। পাগলা বাবুর্চির হাতের ম্যাড কাচ্চি খাওয়ার জন্য নেওয়া যাবে পাগলা প্ল্যাটার অথবা মস্ত বড় প্ল্যাটার, যেগুলোতে আছে দুজনের অথবা চারজনের জন্য কাচ্চি বিরিয়ানি, জালি কাবাব, রোস্ট, রেজালা বোরহানি ইত্যাদি।
পাগলের খেলা থেকে মেঘের ভেলায় অর্থাৎ ক্লাউড কিচেনেও পৌঁছে গেছে বিরিয়ানির বাতাস। সুন্নাহ-ই কাচ্চি সে রকম একটি ক্লাউড কিচেন। তাদের নির্দিষ্ট কোনো রেস্টুরেন্ট নেই, ফেসবুক পেজ বা ওয়েবসাইট দেখে প্রি-অর্ডার করতে হবে। সাদিক অ্যাগ্রোর ব্যবসার শুরুটা ক্যাটল ফার্মিং আর ডেইরি প্রডাক্টস দিয়ে। তারাও এসেছে বিরিয়ানি ব্যবসায়, তাদের ফেসবুক পেজ থেকে প্রি-অর্ডার ভিত্তিতে পাওয়া যাবে ভুট্টি গরুর মাংসের কাচ্চি বিরিয়ানি।

‘ফুড সার্ভিং বাই জিনাত’-এর মাটন কাচ্চি
ছবি: ‘ফুড সার্ভিং বাই জিনাত’-এর ফেসবুক পেজ

এ ছাড়া অনেক হোমকুকই ফেসবুক পেজ ভিত্তিক বুটিক ক্যাটারিং পরিচালনা করেন। জিনাত আবেদিন এমনই একজন নারী উদ্যোক্তা, যাঁর ফেসবুক পেজ ‘ফুড সার্ভিং বাই জিনাত’-এর খাবার চেখে দেখেছেন অনেকেই। জিনাতের হাতের শাহি মাটন কাচ্চি বিরিয়ানিও দারুণ সুস্বাদু, সঙ্গে সিগনেচার পানীয় পেস্তাবাদামের শরবতটাও অত্যন্ত লোভনীয়।

পুরান ঢাকার হাজী, হানিফ, নান্না কিংবা মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের বোবার বিরিয়ানি, কামাল বিরিয়ানির মতো প্রথাগত বিরিয়ানির দোকানগুলো অনেক দিন ধরেই ব্যবসা করলেও একটা নির্দিষ্ট ছকের বাইরে যেতে পারেনি। একই বৃত্তে আবর্তিত একসময়ে বিশ্বমাতানো ফখরুদ্দীনের বিরিয়ানি। বরং ফখরুদ্দীনের প্রয়াণ, নতুন প্রজন্মের হাতে ব্যাটন চলে যাওয়ার পাশাপাশি সময় পরিবর্তনের সঙ্গে মানের হেরফের হয়েছে যথেষ্ট। হয়তো ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে রাখতে আর দাম হাতের নাগালে রাখতেই তাপানুকূল রেস্তোরাঁ আর উর্দিপরা ওয়েটারের চাইতে কাঠের বেঞ্চ আর গামছা হাতের ‘মামা’দের আমলেই রয়ে গেছে। তবে স্টার হোটেলের কাচ্চি এখনো একটা মানে আছে। অবশ্য তাদের সব আউটলেটেই রয়েছে আলাদা কিচেন। ফলে বাবুর্চি আলাদা হওয়ায় স্বাদের রকমফের হয়ে থাকে।

ছবি: ইনস্টাগ্রাম

এর মধ্যে অবশ্য একটা নাম বলতেই হয়, মোহম্মদপুরের ইকবাল বাবুর্চি। তাঁর কোনো আউটলেট নেই। অর্ডার দিলে পৌঁছে দেন। ন্যূনতম ১০ জনের জন্য অর্ডার করতে হয়। বেশি হলে তাঁদের লোক এসেই সার্ভ করে দেন। ঢাকায় থাকা অনেক বিদেশি ইকবালের কাচ্চি বলতে অজ্ঞান। তবে সেটা কেবল নামে নয় বরং সত্যিকারের স্বাদেও।

মাঠে অনেক পরে নামলেও কাচ্চি ভাই, সুলতান’স ডানের মতো ‘কাচ্চি চেইন’ বিরিয়ানির ব্যবসাকে নিয়ে গেছে নতুন উচ্চতায়। যোগ হয়েছে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের শক্তি আর ডেলিভারি সার্ভিসের প্রযুক্তি। ডায়েট সচেতন শহুরে নাগরিকদের কাছে তাই কাচ্চি বিরিয়ানি এখন ট্রেন্ডিং। যে শহরে দিনে ৩৯টা করে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটছে, সেখানেই কিনা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বিয়ে বাড়ির কাচ্চি!