হুমায়ূনের লেখায় রসনাচিত্র

হুমায়ূন আহমেদছবি: প্রথম আলো

হুমায়ূন আহমেদের লেখার একটা অংশে এসেছে শুধু খাবারের বিবরণ। বাংলা সাহিত্যে খাবার আলাদাভাবে স্থান পাবে, এটা তো স্বাভাবিকই। কিন্তু ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’, ‘ইন্দুবালার ভাতের হোটেল’—এ ধরনের একদমই খাবারকে ঘিরেই বইপত্র এমন খুব বেশি আসলে আমার জানামতে নেই। তবে এই ব্যাপারে হুমায়ূন বেশ সূক্ষ্মভাবে একটা কাজ করে গেছেন। খুব কঠিন গল্পের মাঝে খুব হালকা চালে চলে এসেছে খাবারের কথা। চরিত্রদের স্বাভাবিক জীবনের প্রিয় খাবার আর একটু ভিন্ন রেসিপি—আমার মনে হয় সবই উনি লেখায় এনেছেন সহজ ভাষায় আলাদা করে কোনো বাড়তি কথার মারপ্যাঁচে না গিয়েই।

খুব সাধারণ ভাত মাছ আর ভর্তা থেকে মোগল খাবার—একেক বইয়ে একেকটা—বাদ যায়নি আসলে কোনো অংশই। ‘রাবণের দেশে আমি ও আমরা’তে লংকার খাবারের যে বিবরণ, তাতে স্পষ্ট হয়ে এসেছে ভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে কোনো সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হতে খাবারের প্রয়োজনীয়তা।

রাবণের দেশে আমি ও আমরা'র প্রচ্ছদ

রাবণের দেশে আমি ও আমরা আমেরিকার বার্গার শপ থেকে স্ট্রিট ফুড নিজের জবানিতে এসেছে অভিজ্ঞতার আলোকে খাবারের বিষয়ে অভিমত। কিন্তু এ তো গেল তাঁর নিজের ভ্রমণের সঙ্গে খাবারের বিবরণ। এ ছাড়া হুমায়ূনের লেখনীতে ‘বাদশাহ নামদার’ বইয়ে এসেছে বাদশাহ হুমায়ুনের খাবার আর শান-শওকতময় খাদ্যাভ্যাসের খুব গোছানো বর্ণনা। ওই এক বই হঠাৎ কোথা থেকে মোগলাই খাবার নিয়ে আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছিল বহুগুণে।

এর বাইরেও তাঁর নিজের জীবনের নানা স্তরে নানা সময়ে, কি বিপদে কি সুসময়ে—কী খেয়ে থেকেছেন, তার টুকরো বর্ণনাও বাদ যায়নি। বইয়ের নাম ঠিক মনে নেই। খুব সম্ভবত ‘কিছু শৈশব’-এর এক জায়গায় অভাবের তাড়নায় নিমপাতা ভাজি খেয়ে জীবন অতিবাহিত করেছেন এমন সুন্দর আর সরল স্বীকারোক্তি ছুঁয়ে গেছে যেকোনো হুমায়ূনভক্তের মন।

ইলিশসহ নানা ধরনের মাছের সুস্বাদু পদের বর্ণনা পাওয়া যায় হুমায়ূন আহমেদের লেখায়
ছবি: প্রথম আলো

আর এর বাইরে নলিনী বাবু বিএসসির মতো বইয়ের পুরোটাজুড়েই ছিল খাবারের নানা ধরন, রান্নার ধাঁচ, কোন মাছের সঙ্গে কোন ফোড়ন—মানে খাবারের এক পুরোদস্তুর এনসাইক্লোপিডিয়া। রাজসিক কি তামসিক—এইগুলো তো এই বই পড়ার আগে ভাবতেই পারিনি, জানতেও পারিনি। আমাদের মতো জেনারেশনের মানুষের বাক্সবন্দী জীবনে হুমায়ূন খুব সাধারণভাবেই এনেছেন অথেনটিক খাবারের বিশদ আলোচনা।

ভর্তার মত সাধারন খাবারের অসাধারন বর্ণনা দিয়েছেন তিনি
ছবি: প্রথম আলো

কখনো কখনো মৌরলা মাছ না চেনা আমি কি অদ্ভুতভাবে বইয়ের পাতায় পাতায় পড়ার সঙ্গের সঙ্গে স্বাদ পেয়ে গেলাম মৌরলা মাছের ঝোলের। আবার কালবাউশ ঠিক কেমন দেখতে, কতটা টাটকা কিংবা পদ্মার ইলিশ ঠিক কী দেখে চেনা যায়, কী সব শৌখিন ব্যাপার ভদ্রলোকের লেখায় এসেছে একদমই সাদামাটাভাবে। গল্পের আলোচনার মাঝেই হঠাৎ পেঁয়াজ দিয়ে মাংসের তরকারির এত সূক্ষ্ম বিবরণ চরিত্রের সঙ্গে পাঠককে করেছে অনেক বেশি সহজ আর সাবলীল।

খাবারের শুরুর পাতে যে তেতো আর শেষ পাতে যে অম্বল—এই জ্ঞানও হুমায়ূনের বই থেকেই পাওয়া। আর ইলিশ কীভাবে লবণ দিয়ে মাখিয়ে রেখে রান্না করতে হয় কিংবা খাসির কী যেন তরকারি—এইগুলো নিয়ে বিশাল কিন্তু একটুও একঘেয়ে না লাগা বর্ণনা বারবারই এসেছে তাঁর বইয়ে। সাধারণ ডে টু ডে ফুডস যাকে বলি সেই সব, পারিবারিক জীবনের খাদ্যাভ্যাস, মোটকথা তাঁর বইয়ের এক বড় অংশে কোনো না কোনোভাবে খাদ্য আর রসনাবিলাসের জায়গা ছিল ঠিকই।

পারিবারিক জীবনের খাদ্যাভ্যাসের বর্ণনাও রয়েছে তার লেখায়
ছবি: প্রথম আলো

হাঁসের গ্রিলের এত সুন্দর আর ডিটেইল রেসিপি ছিল ‘আমার আছে জল’-এ। আমার মনে হলো, আমিও একবার রান্না করে দেখতেই পারি কেমন হয়। আবার উদ্ভট ধরনের কোকের সঙ্গে ঝাল মরিচ মেশানো কিংবা ‘কুটু মিয়া’তে আসা আজব সব তেজি শরবত—কী আসেনি তাঁর লেখনীতে। ‘তন্দ্রাবিলাস’ বইয়ে এসেছে বাঙালির কমফোর্ট ফুডের কথা, এসেছে খাঁটি গাওয়া ঘি, পাতলা চালের ভাত আর আলু ভর্তার সঙ্গে ডালের বিবরণ, পড়লেও হঠাৎ খিদে লেগে যাবে—এতটাই বাস্তব আর কল্পনা করে নেওয়ার মতো ডিটেইল!

আসলে এত কথার শেষ কথা এইটাই, হুমায়ূন নিজেও খেতে ভালোবাসতেন, ভালোবাসতেন খাওয়াতে। আর জানতেন খাবারের মান যাচাই করতে। তাই তাঁর লেখায় খাবারের বিবরণ এতটাই স্পষ্ট। মনে না থাকলে মনে করিয়ে দিই, একবার কিন্তু তিনি মিষ্টির দোকানে বসে মিষ্টির নামকরণ করে এসেছিলেন ‘বালক পছন্দ’।

একটা মিস্টিরও নামকরণ করেন তিনি
ছবি: প্রথম আলো

কারণ, ওনার মনে হয়েছিল, এই মিষ্টির স্বাদ বালকদের খেতে ভালো লাগবে। তাহলেই বুঝুন, শেষ অব্দি খাওয়ার ব্যাপারে কতটা শৌখিন ছিলেন তিনি। আর তাই তো তাঁর লেখনীতেই বাঙালির রসনাবিলাস পেয়েছে আরও গভীর ও যত্নময় বিবরণ। তাই ভোজনরসিক পাঠকদের মনে এই হুমায়ূন বেঁচে থাকুক আরও অনেক দিন, আর ওনার বইয়ের খাবারের সূত্র ধরেই সম্পর্ক স্থাপিত হোক পাঠক ও চরিত্রের। বিশেষ দিনে বিশেষ মানুষকে স্মরণের রয়েছে নানা উপায়। তাই এভাবেই না হয় স্মৃত হন তিনি শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায়।

লেখক: শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়