'বউ-শাশুড়ি'র গল্প

শারমিন লাকি
শারমিন লাকি

একটা সময় ছিল বাংলাদেশের অসংখ্য ঘরে ঢুকে পড়েছিল রান্না খাদ্য পুষ্টি বইটি। কেউ বিদেশ যাচ্ছেন বা বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছেন কোনো মেয়ে-ব্যাগে বা স্যুটকেসে অধ্যাপিকা সিদ্দিকা কবীরের এই বই যেন থাকতেই হবে। এই শতকের গোড়ার দিকে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে শুরু হয় ‘সিদ্দিকা কবীর’স রেসিপি’ নামের অনুষ্ঠান। রান্নাবান্নার অনুষ্ঠানে এটি যোগ করে নতুন মাত্রা। বেশ কয় বছর চলা এই অনুষ্ঠানে সিদ্দিকা কবীরের সঙ্গে উপস্থাপক হিসেবে ছিলেন শারমিন লাকি। এই দুজন হয়ে যান রান্নাবান্নার জুটি। শারমিন লাকি বলেছেন প্রয়াত সিদ্দিকা কবীরের সঙ্গে নানা স্মৃতির কথা। বর্ণিল খাবারদাবারের এ আয়োজনে সিদ্দিকা কবীরের বই থেকে কয়েকটি রান্না রাঁধলেন শারমিন লাকি

‘তুমি রুটি বানাতে পারো?’ অধ্যাপিকা সিদ্দিকা কবীরের এই কথা শুনে উপস্থাপক শারমিন লাকির কিছুটা রাগই হলো। ভাবলেন, বলে কী! পুরো পরিবারে তাঁর মতো গোল রুটি আর লুচি কেউ বেলতে পারেন না। চ্যালেঞ্জ নিলেন লাকি। রুটি বেলতে শুরু করলেন। পিঁড়ির ওপর রুটি গোল হয়ে ঘুরছে। এটা দেখে সিদ্দিকা কবীর খুব খুশি হয়ে বলেছিলেন, ‘শারমিন পাস। অন্য সাহায্যকারীর প্রয়োজন নেই আমার।’ 

আসলে এটা ছিল একটা পরীক্ষা। টেলিভিশনে ‘সিদ্দিকা কবীর’স রেসিপি’ অনুষ্ঠানের ৫০ পর্ব তখন পেরিয়ে গেছে। শারমিন লাকি তখন শুধু উপস্থাপনা করতেন। এই পরীক্ষায় উতরে গিয়ে পরের পর্বগুলোয় শারমিন লাকিই হয়ে গেলেন সিদ্দিকা কবীরের সহযোগী। অনুষ্ঠানে রান্নায় সহায়তাও করতে থাকলেন।

শারমিন লাকি
শারমিন লাকি


এই অনুষ্ঠান গড়ে দিয়েছিল দুজন মানুষের মধ্যে নিবিড় এক সম্পর্ক। একজনের নাম বললে আরেকজনের নাম চলে আসে এখন। শারমিন লাকি বলেন, ‘কাজ শেখার সময় সম্পর্কটা ছাত্রী-শিক্ষকের মতো ছিল। আবার বিজ্ঞাপনে আমরা হয়েছি বউ-শাশুড়ি। সিদ্দিকা কবীর আজ বেঁচে নেই। কিন্তু তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করে আমার সবকিছুতেই টের পাই
তিনি আছেন।’

শারমিন লাকি
শারমিন লাকি


রান্নাবান্নার নানা রকম বিষয় সিদ্দিকা কবীরের কাছ থেকে ভালোই শিখে নিয়েছিলেন শারমিন লাকি। কম তেল-মসলা দিয়ে রান্না করার পদ্ধতি তাঁর কাছ থেকেই শেখা। শারমিন লাকি নিজে মাছ খেতে ভালোবাসেন। বাজার থেকে নিজে মাছ কিনে আনেন। মিষ্টি নয়, বরং একটু ঝালজাতীয় খাবার তাঁর পছন্দ। চটপটি তাঁর প্রিয় খাবার। নিজে ২০ বছর ধরে মাংস খান না। লাকির হাতের ইলিশ-পোলাও, দই-ইলিশ ও দেশি মুরগির রোস্টের সুনামও আছে।
অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত সবাই সিদ্দিকা কবীরকে ‘মামানি’ বলে ডাকতেন। এটা হয়েছিল অনুষ্ঠানের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ধ্বনিচিত্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সারা যাকেরের জন্য। কারণ, সারা যাকেরের মামি ছিলেন সিদ্দিকা কবীর। তবে শারমিন তাঁকে আপা বলেই ডাকতেন। শারমিন লাকি বলেন, ‘তাঁর রান্না খাদ্য পুষ্টি বইটিতে তিনি আমাকে অটোগ্রাফ দেওয়ার সময় “সুহাসিনী” সম্বোধন করেছিলেন। সব সময় অনুপ্রেরণা দিতেন কাজ করার।
বলতেন, অডিও জগৎ ছেড়ে দিয়ো না। আবৃত্তি বন্ধ কোরো না।’
বাইরে থেকে অধ্যাপিকা সিদ্দিকা কবীরকে সবাই গম্ভীর মানুষ মনে করতেন। কাছে থেকে যাঁরা দেখতেন, তাঁরা জানেন যে সিদ্দিকা কবীর ছিলেন একেবারেই অন্য রকম। কখনো কোনো ভুল হলে তা স্বীকার করেও নিতেন সিদ্দিকা কবীর। ‘একবার রেসিপি দেওয়ার সময় উপকরণের নাম বলেছিলেন; কিন্তু রান্না করার সময় সেই উপকরণ দিতে ভুলে গিয়েছিলেন। এক দর্শক সেটা দেখে চিঠি লিখেছিলেন। সেটি সিদ্দিকা কবীর পড়ে শুনিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আমরা লজ্জিত। আমরা ভুল করলেও আপনি কিন্তু করবেন না এটা।’ বললেন শারমিন লাকি।
সিদ্দিকা কবীরের কোন রান্নাগুলো বেশি পছন্দ? শারমিন লাকি বললেন, ‘কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি! তাঁর হাতের পোলাও আর মাছের সব পদ কীভাবে যে এত ভালো হতো! আমাদের সব সময় কম তেল দিয়ে ছোট মাছ রান্না করতে বলতেন।’
মৌসুমী ভৌমিকের ‘আমি শুনেছি সেদিন’ গানটা প্রায়ই শুটিং স্পটে সিদ্দিকা কবীরকে গেয়ে শোনাতেন শারমিন লাকি। কোনো কোনো দিন রান্নার পর টিস্যুতে পেঁচিয়ে খাবার দিতেন লাকির ছেলে শায়েরের জন্য। শারমিন লাকির মতে, সিদ্দিকা কবীরের মতো ভালো ডেজার্ট কেউ বানাতে পারেন না। ফল দিয়ে ডের্জাট বানাতে বেশি ভালোবাসতেন। তার গাজরের কেক ছিল অসাধারণ! লাকি বললেন, ‘পৃথিবীর নামকরা অনেক রেস্তোরাঁর ডেজার্ট খেয়েছি। আমার মনে হয়েছে আপাই সেরা। তাঁর হাতের অরেঞ্জ মাফিনের স্বাদ ভোলা যায় না।’
সিদ্দিকা কবীরের সঙ্গে রান্নাবান্নার বাইরেও মজার কিছু ঘটনা রয়েছে শারমিন লাকির। বিজ্ঞাপনে তাঁরা বউ-শাশুড়ি হয়েছিলেন। অনেক দর্শক সেটাকে সত্যিই ভাবতেন। কোথাও গেলে কেউ কেউ বলেই বসতেন, ‘আপনার ছেলের বউকে নিয়ে আসেননি?’ শারমিন লাকি বললেন, ‘সিদ্দিকা কবীরের নিজের ছেলের বউ শর্মী রাগই করত মাঝেমধ্যে। তবে শর্মী আমার খুব ভালো বন্ধু।’ আবার অন্যদিকে একবার এক লোক সিদ্দিকা কবীরের কাছে শারমিন লাকিকে বিয়ে করার প্রস্তাবই দিয়ে বসলেন। লাকির শুধু স্বামী নয়, বড় সন্তানও আছে-শোনার পর সেই লোকটির চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল।
সিদ্দিকা কবীরের কাছ থেকে শারমিন লাকি শিখেছেন অনেক কিছুই। রান্নার বিষয়গুলো
যেমন, তেমনি খাদ্যের পুষ্টিগুণ ইত্যাদিও জেনেছেন। ‘ক্যালরি মেপে মেপে যে খেতে হয়,
তা আপার কাছ থেকেই শিখি। এখন তো
অনেকেই এটা করেন।’
সিদ্দিকা কবীরের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা বারবারই টের পাওয়া গেল শারমিন লাকির
সঙ্গে আলাপচারিতায়। বেশ বোঝা গেল তাঁর অনুভবে এখনো বিরাজ করেন অধ্যাপিকা সিদ্দিকা কবীর।

সিদ্দিকা কবীরের কিছু টিপস

সিদ্দিকা কবীর
সিদ্দিকা কবীর

· অন্য রান্নায় উপাদানগুলো অনুমান করে দেওয়া যায়। কিন্তু বেকিং করতে চাইলে সেসব উপাদান সঠিক পরিমাণে দিতে হবে। তা না হলে খাবারটি ভালোভাবে তৈরি হবে না।
· পোলাও রান্নার সয়ম দুই থেকে তিনবার বলক ওঠার পর ১৮ থেকে ২০ মিনিট ঢেকে রাখলেই পোলাও হয়ে যাবে।
· শাক-সবজি কাটার আগে ধুতে হবে।
· সবজি সেদ্ধ করতে চাইলে অল্প পানিতে করা উচিত। যতটুকু সময় প্রয়োজন, ততটুকুই দিন। বেশিক্ষণ ধরে জ্বাল দিলে খাবারের রং ও ভিটামিন নষ্ট হতে পারে।
· খাবার ঢেকে রান্না করা দরকার। হাঁড়ির মুখ খোলা থাকলে বাষ্পের সঙ্গে ভিটামিনও বেরিয়ে যায়।
· কোনো রান্নায় লবণ বেশি হয়ে গেলে আলু কেটে দিতে পারেন। ১০ বছর আগে এই বিষয় শারমিন লাকির জানা ছিল না। সিদ্দিকা কবীরের কাছেই প্রথম শোনেন।
· মাছ ও মাংসে তাড়াতাড়িই পচন ধরে। তাই কিনে আনার পরপরই রান্না করতে না পারলে প্যাকেটে মুড়িয়ে ফ্রিজে রেখে দেওয়া দরকার।
· বাসায় অতিথি এলে নিরীক্ষাধর্মী নতুন রান্না না করাই ভালো। যেটা ভালো পারেন, সেটাই করুন।


জিরা পানি

জিরা পানি
জিরা পানি


উপকরণ: জিরা গুঁড়া ১ চা-চামচ, আখের গুড় ২ টেবিল চামচ, চিনি ২ টেবিল চামচ, পানি ১ কাপ, তেঁতুলের ক্বাথ ২ চা-চামচ ও লেবুর রস ২ চা-চামচ।
প্রণালি: আখের গুড় ও চিনি পানিতে গুলিয়ে নিন। গুড়ের পানিতে তেঁতুলের ক্বাথ ও লেবুর রস মিশিয়ে ছেঁকে নিন।
জিরার গুঁড়া মিশান। জিরা মিশানোর ১০ মিনিট পর ইচ্ছা হলে আবার ছেঁকে নিতে পারেন। তবে জিরা দেওয়ার পর ছাঁকলে জিরার গন্ধ কমে যায়।
ঠান্ডা জিরা পানি গরমের দিনে পরিবেশন করা যায়।
মটর পোলাও

মটর পোলাও
মটর পোলাও

উপকরণ: মটরশুঁটি দেড় কাপ, পোলাওয়ের চাল ৪ কাপ, আদাবাটা ২ চা-চামচ, টকদই (ঐচ্ছিক) আধা কাপ, দারুচিনি ২ সেন্টিমিটারের ২ টুকরা, এলাচি ৪টি, ঘি আধা কাপ, গরম পানি ৭ কাপ ও লবণ স্বাদ অনুযায়ী।
প্রণালি: ঘিয়ে আদা, দারুচিনি ও এলাচি দিয়ে নেড়ে গরম পানি দিন। পানি ফুটে উঠলে চাল ও লবণ দিয়ে নাড়ুন। ফুটে উঠলে মটরশুঁটি ও দই দিন (মটরশুঁটি খুব কচি হলে ১০ মিনিট পর দিতে হবে)। মৃদু আঁচে ২০ থেকে ২২ মিনিট ফুটিয়ে নিন (ঢাকনা খোলা যাবে না)। চুলা থেকে নামিয়ে রাখুন। ১৫ থেকে ২০ মিনিট পর ঢাকনা খুলবেন।

কাটা মসলায় মাংস

কাটা মসলায় মাংস
কাটা মসলায় মাংস


উপকরণ: মাংস স্লাইস করে কাটা ২ কেজি, পেঁয়াজের স্লাইস ২ কাপ, আদা মিহি কুচি ২ টেবিল চামচ, রসুন কুচি দেড় চা-চামচ, শুকনা মরিচ ১২টি, এলাচি ৮টি, দারুচিনি ২ সেন্টিমিটারের ৬ টুকরা, তেজপাতা ২টি, গোলমরিচ ১ চা-চামচ, তেল সোয়া কাপ, সিরকা আধা কাপ, টকদই ১ কাপ ও লবণ স্বাদ অনুযায়ী।
প্রণালি: গরুর সিনা ও রানের মাংস চর্বি ছাড়িয়ে টুকরা করে কেটে, ধুয়ে পানি ঝরান। হাঁড়িতে মাংস এবং সব উপকরণ একত্রে মাখিয়ে নিন। ঢাকনা দিয়ে মৃদু আঁচে দুই-তিন ঘণ্টা রান্না করুন। মাংস সেদ্ধ হলে এবং পানি শুকালে খুব মৃদু আঁচে এক ঘণ্টা দমে রাখুন।

গাজরের কেক
গাজরের কেক

গাজরের কেক
উপকরণ: গাজর ১ কেজি, ডিম ২টি, চিনি ১ কাপ, তেল আধা কাপ, ময়দা ২ কাপ, লবণ আধা চা-চামচ, বাই কর্বোনেট অব সোডা (খাওয়ার সোডা) ১ চা-চামচ, বেকিং পাউডার ২ চা-চামচ ও দারুচিনির গুঁড়া ১ চা-চামচ।
প্রণালি: গাজর খোসা ছাড়িয়ে সবজি কুরুনি দিয়ে মিহি করে কুরিয়ে নিন। ময়দা, বেকিং পাউডার ও খাওয়ার সোডা একত্রে চেলে রাখুন। ওভেনে ১৯০০ সেন্টিগ্রেড (৩৫০০ ফারেনহাইট) তাপ দিন। একটি বাটিতে চিনি ও তেল একত্রে নিয়ে ফেটান। এরপর একটা একটা করে ডিম দিয়ে ফেটতে হবে। গাজরের সঙ্গে দারুচিনি ও লবণ মিশিয়ে ফেটানো মিশ্রণে দিয়ে মিশিয়ে নিন। ময়দা দুই-তিনবারে দিয়ে হালকা হাতে মেশান। ২৮ × ১১ × ৭ সেন্টিমিটার আয়তাকার প্যানে এক ঘণ্টা বেক করুন।

প্রতিবেদনটির মডেল হয়েছেন ও রান্নাগুলো রেঁধেছেন শারমিন লাকি

ছবি তুলেছেন: কবির হোসেন
সহযোগিতা: আমারি ঢাকা