রাসেলের চটপটি যে কারণে মন কেড়েছে ক্রেতাদের

১২ বছর ধরে মহাখালীর আমতলীতে ফুচকা বিক্রি করছেন মো. রাসেল আহমেদ
ছবি : অগ্নিলা আহমেদ

ছয় বছর বয়সে নানার চায়ের দোকানে কাজ শুরু করেছিলেন মো. রাসেল আহমেদ। শুরুতে নানার কাজে সাহায্য করতেন, এটা-সেটা এগিয়ে দিতেন, ক্রেতাদের কী লাগবে, তা দেখতেন। মধ্যবয়সে এসে সেই রাসেল এখন নিজেই পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। একহাতে সামাল দেন নিজের চটপটির ব্যবসা। সকালে ঢাকার বনানীর একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে শিশুদের কাছে বিক্রি করেন চটপটি-ফুচকা, বিকেলে বিক্রি করেন মহাখালীর আমতলীর ব্যস্ত এলাকায়। দিনে গড়ে দুই হাজার টাকা বেচাকেনা হয়। সব খরচ বাদ দিয়ে মাসে ২৫ হাজারের মতো লাভ থাকে। দূরদূরান্ত থেকে মো. রাসেলের চটপটি-ফুচকা খেতে আসেন অনেকে।

খাবার পরিবেশনায় পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার চেষ্টা করেন
ছবি : অগ্নিলা আহমেদ

২০১২ সাল থেকে মহাখালীতে ছোট একটি কার্টে চটপটি-ফুচকা বিক্রি করেন রাসেল। তার চটপটি আর ফুচকা হয়ে উঠে এ এলাকার মানুষের সন্ধ্যার প্রিয় নাশতা। সহকর্মীর জন্মদিন কিংবা প্রমোশনের ট্রিটও হয় রাসেলের ফুচকা দিয়ে। তাই তো সন্ধ্যা নামতেই রাসেলের দোকানে চেয়ার খালি পাওয়া মুশকিল হয়ে ওঠে।

মো. রাসেলের জন্ম, বেড়ে ওঠা—সবই ঢাকার মহাখালীর ওয়্যারলেস এলাকায়। এখানেই পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। এরপর নানা কারণে আর লেখাপড়া হয়নি। শুরু করেন কাজ।

দেশের বাইরে চলে গেছেন এমন মানুষও এখানে ফুচকা খেতে আসেন
ছবি : অগ্নিলা আহমেদ

ছোটবেলাতেই বাবাকে হারিয়েছেন। তাঁদের দুই ভাই-বোনকে নিয়ে নানার বাড়িতেই থাকতেন মা। আর সেই নানার সঙ্গেই মূলত রাসেলের কাজে হাতেখড়ি। শুরুতে অবশ্য কাজে তেমন মনোযোগ ছিল না। একটা সময় পর গিয়ে মনে হলো, কী করছেন তিনি! মা-বোনকেও ঠিকমতো দেখভাল করতে পারছেন না। তখনই ভাবলেন, নানার ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকলে চলবে না, নিজের কিছু করতে হবে।

সে সময় একজন পরামর্শ দিলেন, মহাখালীর যে এলাকায় রাসেলের বাস, সেখানে কোনো চটপটির দোকান নেই। চাইলে রাসেল চটপটির ব্যবসা শুরু করতে পারে। কিন্তু চায়ের দোকানের অভিজ্ঞতা থাকলেও চটপটি রাসেলের জন্য নতুন বিষয়। কীভাবে করবেন? সেই পরিচিত মানুষটিই বললেন, শুরু করলে ব্যবস্থা হবে। তখন চটপটির ব্যবসা বুঝতে গিয়ে তার ‘ওস্তাদে’র সঙ্গে পরিচয়। এই ওস্তাদ হলেন একজন চটপটি বিক্রেতা। প্রতিদিন ২০০ টাকা সম্মানী দিয়ে এক মাসের জন্য ওস্তাদকে সঙ্গে নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। মনোযোগ দিয়ে শিখে নেন চটপটি রান্না, মসলা তৈরি, ফুচকার জন্য বিশেষভাবে পুর তৈরির কৌশল। এক মাসেই পুরো ব্যবসার খুঁটিনাটি শিখে নেন রাসেল। এরপর নিজেই শুরু করেন চটপটি তৈরি।

পরিমাণমতো মসলার মিশ্রণের ওপরই নির্ভর করে চটপটি বা ফুচকার স্বাদ
ছবি : অগ্নিলা আহমেদ

রাসেল বলেন, চটপটি তৈরি আসলে কঠিন কিছু নয়। সব চটপটির মসলাই এক। মূল বিষয় হলো পরিমাণমতো মসলার মিশ্রণ। সেটা কে কীভাবে দিচ্ছেন, তার ওপরই নির্ভর করে চটপটি বা ফুচকার স্বাদ। যথাযথ পরিমাণে মসলার মিশ্রণই স্বাদ বাড়িয়ে দেয়। সে জন্যই একেক দোকানের চটপটির স্বাদ একেক রকম হয়।

ক্রেতারা তাঁর টক অনেক পছন্দ করেন বলে জানান রাসেল। টকটাও যত্ন নিয়ে নিজের হাতে তৈরি করেন তিনি। সবকিছু তৈরিতে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার চেষ্টা করেন। তাঁর চটপটি খেয়ে মুগ্ধ এক ক্রেতার সুবাদে রাসেলের সুযোগ আসে বনানীর একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ক্যানটিনে চটপটি বিক্রির।

রাসেল জানান, যদিও খুব সহজে মেলেনি সুযোগ, তবে কয়েক দিন তাঁর চটপটি-ফুচকা খেয়ে দেখেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। তাঁর ফুচকার স্বাদ-পরিচ্ছন্নতা—সব পর্যবেক্ষণ করে তারা, তারপরই মিলেছে স্কুলের ক্যানটিনে জায়গা। এখন সকাল ১০টা থেকে দুপুর পর্যন্ত স্কুলের শিশুদের কাছে চটপটি-ফুচকা বিক্রি করেন রাসেল। এরপর বাসায় গিয়ে নিজে খেয়ে, ফ্রেশ হয়ে তারপর আসেন মহাখালীতে তাঁর পুরোনো জায়গায়। সেখানে বিকেল ৪টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে বিকিকিনি।

ভবিষ্যতে চটপটির বড় দোকান দেওয়ার ইচ্ছে রাসেলের
ছবি : অগ্নিলা আহমেদ

এসব কাজে রাসেলকে সহায়তা করেন তাঁর স্ত্রী। চটপটির জন্য ডাল সেদ্ধ করা কিংবা মসলা তৈরিতে রাসেলের মূল সহকারী তিনি। রাসেল জানান, কেবল ফুচকাগুলো কিনে আনেন তিনি। এ ছাড়া বাকি সবকিছু তাঁর বাসাতেই তৈরি করেন। বাজার থেকে প্রতিটা মসলা আলাদা করে কিনে বাছেন, পরিষ্কার করেন, তা দিয়ে চটপটি-ফুচকার মসলা বা টক তৈরি করেন তিনি।

রাস্তার পাশে নয়, রাসেলের ইচ্ছা ভবিষ্যতে চটপটির দোকান দেওয়া। সেখানে আরাম করে চেয়ার-টেবিলে বসে ফ্যানের বাতাসের নিচে চটপটি-ফুচকা খেতে পারবেন তাঁর গ্রাহকেরা।

সাভার, গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে তাঁর দোকানে চটপটি খেতে আসেন মানুষ। এমনকি অনেকে আছেন, দেশের বাইরে চলে গেছেন। সেখান থেকেও দেশে বেড়াতে এলে রাসেলের দোকানে আসতে ভোলেন না। অনেক ক্রেতা বোতল নিয়ে আসেন রাসেলের তৈরি টক নিয়ে যাওয়ার জন্য। এতটাই জনপ্রিয় তাঁর নিজের হাতে তৈরি টক, বিশেষ করে মিষ্টি টক, যেটি ফুচকার সঙ্গে পরিবেশন করা হয়।

রাসেলের নিজের হাতে তৈরি এই টক বেশ জনপ্রিয়
ছবি : অগ্নিলা আহমেদ

এ ছাড়া বিভিন্ন গায়েহলুদ বা জন্মদিনের মতো অনুষ্ঠানেও চটপটি-ফুচকার সমাহার নিয়ে যান রাসেল। তবে এ জন্য তাঁকে অন্তত দুই দিন আগে বলতে হবে। তাহলে সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে পারেন তিনি।

এখন স্ত্রী, দুই সন্তান আর মাকে নিয়ে রাসেলের সংসার। একমাত্র বোনের বিয়ে দিয়েছেন। এই চটপটির ব্যবসা করেই স্বাচ্ছন্দ্যে সংসারও চালাচ্ছেন। এখন আর অভাব নেই, মাকে দেখভাল করতে না পারার আক্ষেপ নেই। মহাখালীতেই বাসা ভাড়া করে থাকেন। এখন রাসেলের স্বপ্ন দুই সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করা।

রাসেল বলেন, কেউ যদি চটপটির ব্যবসা করে উন্নতি করতে চান, তাহলে সৎ হতে হবে। ক্রেতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে। কোনোভাবেই রাগ দেখানো যাবে না, খারাপ ব্যবহার করা যাবে না।

ভালো ব্যবহার করলে, হাসিমুখে কথা বললে ক্রেতা দোকানে দ্বিতীয়বার আসবেন, অন্যকেও আসতে বলবেন। এভাবেই ব্যবসার নাম ছড়াবে, সম্মান পাওয়া যাবে।