মিরপুরে মাটির হাঁড়ির গরুর মাংস খেয়েছেন কি

মিরপুরে মাটির হাঁড়িতে রান্না করা হয় গরুর মাংসছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

সপ্তাহখানেক আগে রাতে বাসায় ফিরে দেখি খাবার তখনো রান্না হয়নি। বাইরে খেতে যাব? কোথায় যাব? তখন মনে পড়ল আবেশ হোটেল ও রেস্টুরেন্টের কথা। ফেসবুক ও ইউটিউবে আবেশের বিফ হান্ডির ভিডিও ঘুরে বেড়ায়। ফেসবুক থেকে ফোন নম্বর জোগাড় করে কল করলাম। জানা গেল মিরপুর ১২ নম্বর, পল্লবীতে আবেশের দ্বিতীয় শাখা সারা রাত খোলা থাকে। আবেশের প্রথম শাখা মিরপুর ২ নম্বরে। সেটা রাত ১১টায় বন্ধ হয়ে যায়।

এখানকার মাংসের স্বাদে কোনো হেরফের হয় না
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

‘খাবার গরম থাকবে তো?’

—জি। সব সময় রান্না হয়। গরম ও টাটকা পাবেন।

রাত প্রায় একটার দিকে পৌঁছালাম মিরপুরের পল্লবী মেট্রোরেল স্টেশনের উল্টো দিকে বিআরটিসি বাস ডিপোতে আবেশ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট শাখা-২-এ। মেট্রোরেলের ১৬৯ নম্বর পিলার থেকে ইউটার্ন নিলেই আবেশ হোটেল। মধ্যরাত পেরিয়ে গেলেও রেস্তোরাঁ পুরো জমজমাট। কয়েকটি গাড়ি আর বেশ কিছু মোটরবাইক আবেশের সামনে। ভেতরটা ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে গমগম করছে।

আরও পড়ুন

হোটেলের সামনেই ছয় চুলার ওপরে মাটির হাঁড়িতে রান্না হচ্ছে গরুর মাংসের রেজালা, যা এখানে বিফ হান্ডি নামে পরিচিত। ২৪০ টাকা করে বাটি। খেতে বসলাম রান্না। স্টিলের বাটিতে গরুর মাংস পরিবেশন করতেই দারুণ এক সুগন্ধ নাকে ভেসে এল। মাঝারির থেকে একটু বড় আকারের তিন টুকরা গরুর মাংস, গোটা রসুন একটা, শুকনা মরিচ আর ঝোল। ভাতের সঙ্গে পাতে নিয়ে মুখে দিতেই চনমনে অনুভূতি। শর্ষের তেলের ঝাঁজ টের পাওয়া গেল ভালোই; মাটির হাঁড়ির একটা আলাদা স্বাদ তো রয়েছেই। সবচেয়ে ভালো বিষয় হলো মাংসের টুকরাগুলো সুষমভাবে সেদ্ধ। ব্যক্তিগত পছন্দে আরেকটু নুন-ঝাল বেশি হলে ভালো হতো, তবে বাড়তি লবণ আর মরিচ তো আছেই। প্রয়োজনে একটু ডলে নিলেই হয়।

চুলার ওপরে মাটির হাঁড়িতে রান্না হচ্ছে গরুর মাংসের রেজালা
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

১৪ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে আবার যাওয়া হলো। পল্লবীতে আবেশের সামনেই রান্না হচ্ছে গরুর মাংস। ছয় বা বারোমুখ চুলার একেকটা সেট। প্রতিটির ওপর একটি করে মাটির হাঁড়ি। গরুর মাংসই আবার। একই স্বাদ। খাবারের স্বাদ–গন্ধ একই রকম থাকা যেকোনো হোটেল-রেস্টুরেন্টের জন্য ইতিবাচক। এ নিয়েই কথা হলো আবেশ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের স্বত্বাধিকারী সুমন মিয়ার সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘আমি এখনো নিজে রান্না করি। মাংস রান্নার রেসিপি (প্রণালি) এখনো কারও কাছে প্রকাশ করিনি। হান্ডি বিফে ২২ পদের যে মসলা দিই, সেগুলো মিশ্রণের ফর্মুলাও এখনো শুধু আমার কাছেই। বেশি চুলায় (যেমন ২৮ চুলার সেট) একসঙ্গে রান্না হলে দু-একটা হাঁড়িতে সেদ্ধ একটু তারতম্য হতে পারে। কিন্তু স্বাদ একই থাকে। কোনো রান্নায় হাতের আন্দাজে আমি কোনো মসলা দিই না। পাল্লায় মেপে সবকিছু দিই। সে জন্য স্বাদে হেরফের হয় না।’

হান্ডি বিফে ২২ পদের মসলা দেওয়া হয়
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

গরুর মাংসের এই পদ দমে রান্না করেন সুমন মিয়া। ‘প্রতিটি হাঁড়িতে দুই কেজি মাংস ও এক কেজি মসলার মিশ্রণ—এই তিন কেজি বিফ হান্ডি একসঙ্গে রান্না করি। মাটির হাঁড়ির ঢাকনাটাও মাটির। সেটা আটা গুলে আটকে দিই। চুলায় তোলার ১০ মিনিট পর আগুন নিভিয়ে দিই। এ সময়ে চুলা গরম হয়ে ওঠে। এরপর আরও ১ ঘণ্টা ৫০ মিনিট মাংসটা হিটে (তাপে) মাংস রান্না হতে থাকে।’

সুমন মিয়া নিজে রেস্তোরাঁ শুরু করার আগে বাবুর্চি হিসেবে কাজ করেছেন ১৯ বছরের বেশি সময়। হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলায় তাঁর বাড়ি। ১৯৯৩ সালের দিকে ঢাকায় আসেন। ‘ক্লাস ফাইভের পরীক্ষা দেওয়ার পর ঢাকায় চলে আসি। পড়াশোনা চালানোর মতো টাকাপয়সা ছিল না।’ ঢাকায় এসে একটা রেস্তোরাঁয় কাজ জুটিয়ে নেন। সুমনের ভাষায়, ‘৫-১০ টাকা দিনমজুরিতে চাকরি শুরু। সেখান থেকে আজ এই জায়গায় আসছি। মন দিয়ে কাজ করতাম, দিনে ১৮-১৯ ঘণ্টা খাটতাম। লেগে থেকে কাজ করলে জীবনে আর কিছু লাগে না।’

আবেশ হোটেল ও রেস্টুরেন্টের
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

২০১৭ সালে নিজের রেস্তোরাঁ ব্যবসা শুরু করেন সুমন মিয়া। মিরপুর ২ নম্বর সেকশনে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কার্যালয়ের পেছনে চালু করেন আবেশ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, যেটি এখনো রয়েছে। শুরুতে সকালের নাশতা, দুপুরে ভর্তা-ভাজি-মাছ-মাংস—সাধারণ পদ দিয়েই শুরু হয়েছিল। ২০১৯ সালে কলকাতা বেড়াতে গিয়েছিলেন সুমন মিয়া। ‘সেখানে এক মুরব্বিকে দেখি হান্ডি মাংস রান্না করতে। মাটির হাঁড়িতে তিনি রান্না করছিলেন।’ চেখেও দেখেন সুমন মিয়া। তাঁর পছন্দ হয়।

করোনার মহামারির সময় সুমন মিয়ার মাথায় এল ব্যতিক্রম কিছু করার চিন্তা। সুমন বলেন, ‘নতুন কিছু, ব্যতিক্রম কিছু না করলে গ্রাহককে খুশি করা যাবে না।’ সেই বিফ হান্ডি খাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে চেষ্টা শুরু হলো। ২০২১ সালের মার্চ থেকে আবেশে শুরু করলেন বিফ হান্ডি রান্না। ‘প্রথম দিন দুই কেজি মাংস রান্না করলাম। পরের দিন চার কেজি। তৃতীয় দিন ছয় কেজি। গ্রাহক দ্রুতই পছন্দ করলেন। খেয়ে সবাই ভালো বলতে লাগল।’ আর এখন প্রতিদিন আবেশের দুই শাখা মিলিয়ে কত কেজির গরুর মাংস রান্না হয়? পুরোটা খোলাসা করতে চান না সুমন। তারপরও তাঁর কথার সূত্র ধরে অনুমান করা যায়, প্রতিদিন ২৫০ থেকে ২৮০ কেজি বিফ হান্ডির চাহিদা আছে আবেশ হোটেলের।

পল্লবীতে আবেশ হোটেলের দ্বিতীয় শাখার যাত্রা শুরু হয়েছে গত বছরের সেপ্টেম্বরে। দুই শাখাতেই এক রকম খাবার। বেশি চলা গরুর মাংসের হান্ডি ছাড়াও আবেশে থাকে মাটন হান্ডি (২ টুকরা, ২৪০ টাকা), দেশি মুরগি ভুনা (৩০০ টাকা), দেশি হাঁস ভুনা (২০০ টাকা), গরুর ভুঁড়ি ভুনা (১৫০ টাকা)। সঙ্গে সাদা ভাত, খিচুড়ি, পোলাও, রেশমি রুটি, পরোটা ইত্যাদি পাওয়া যায় আবেশে। ভুনাগুলো করা হয় লোহার বিশাল সব তাওয়ায়। মাংসের পদ বিক্রি শুরু হয় দুপুর ১২টা থেকে। সকালে থাকে নানা রকম নাশতা।

খাবার সময় গরম–গরম বেড়ে দেওয়া হয়
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

সুমন মিয়ার পরিবারে আছেন তাঁর স্ত্রী, তিন মেয়ে ও এক ছেলে। দুটি রেস্তোরাঁ চালানোর পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্যও খাবার সরবরাহ করেন। সেসবেও বিফ হান্ডির চাহিদা বেশি। সুমন মিয়া বলেন, ‘মাটির হাঁড়িতে গরুর মাংসের আসল রেজালা আমার এখানে পাবেন। মিরপুরে নির্দিষ্ট দোকান থেকে মাংস কিনি। দেশি মুরগি ও হাঁস নিজে দেখে কিনি।’ পল্লবীতে গ্যাসের চুলায় রান্না করলেও মিরপুর-২ আবেশে রান্না হয় লাকড়ির চুলায়, মাটির হাঁড়িতে।

সুমন মিয়ার রান্নার কাজে এখন ২২ থেকে ২৩ জন সহকারী রয়েছে। আর দোকানে কর্মরত ১০০ কর্মী। ভবিষ্যতে কী পরিকল্পনা? সুমন মিয়া বলেন, ‘জিরো থেকে এ পর্যায়ে আসছি। যত দিন পারব খাবারে মান ধরে আরও বড় জায়গায় কাজ করে যেতে চাই। পরিশ্রম করলে সফলতা আসবেই—এটা আমি মন থেকেই বিশ্বাস করি।’

আরও পড়ুন