বাঙালির কাছে মাছের মুড়ো কেন লোভনীয়

মাছ ছাড়া বাঙালি জীবন ভাবা যায়? দৈনন্দিন জীবনে, সাহিত্যে, পুরাণে, কাব্যে, আচারে, অনুষ্ঠানে মধ্যমণি হয়ে আছে জলের এই মঙ্গলময় জীব। এহেন মাছের মাথা কি কখনো ফেলনা হতে পারে? সরস লেখায় মাছের মুড়োর তত্ত্বতালাশ করলেন বিশিষ্ট রন্ধনবিশেষজ্ঞ শর্মিলা বসুঠাকুর

মাছের মুড়ো দিয়ে নানা রকম রেসিপির প্রচলন আছে
ছবি: অধুনা

মাছের মাথা নিয়ে লেখার ফরমাশ পাওয়ামাত্র হুড়মুড় করে নানা স্মৃতি মনে ভিড় করে এল। মনে পড়ে গেল ছেলেবেলায় শোনা ছড়া— 

আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা

চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা

মাছ কুটলে মুড়ো দেব

ধান ভানলে কুঁড়ো দেব...

মায়ের ছেলেভোলানো ছড়াতেও মাছের মাথার লোভনীয় আশ্বাস। ছেলেবেলার ছড়া, দাদার বিয়ের তত্ত্বে ধান–সিঁদুরে সাজানো পেল্লায় মাথাওয়ালা রুই, মনসামঙ্গল কাব্যে উল্লেখিত নানা গল্প ও শ্লোক, মায়ের হাতের মুড়িঘন্ট, আরও কত–কী!

বাঙালি জীবনে মৎস্যভেদে মস্তিষ্কের ভেদ, তার পাকপ্রণালি, তার তরিবত—সবই পাল্টে পাল্টে যায়। কোন মাথাকে যত্ন–আত্তি করলে নিজস্ব স্বাদ–সৌরভ বজায় রেখে পরিপক্ব হয়ে উঠবে, কাকেই–বা আবার একেবারে নিজের মতো থাকতে দিতে হবে—মাছের মুড়োর গল্প বলতে গেলে এমন হাজারো খুঁটিনাটি মাথায় রাখতে হবে। মাথা বলে কথা!

এই যেমন ধরুন না, আমাদের রোজকার জীবনে যাকে ছাড়া চলে না, মধ্যবিত্ত সংসারে চিরসাথি, সেই রুই কিংবা কাতলা মাছের কথা, ছোটবেলায় যার নাম শুনেছি চারাপোনা। চারাপোনা শব্দটি নাকি উত্তর চব্বিশ পরগনার। ময়মনসিংহেই কিন্তু একে বলে পাইকা মাছ। চারাপোনার মাথার স্বাদ দারুণ! মুচমুচে মাথাভাজা কাঁটাসমেত খেয়ে ফেলা যায়।

চিকন চালের ভাতের ওপর রুই মাছের মাথা, আর কী চাই!
ছবি: অধুনা

চারা থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে রুই নামাঙ্কিত হওয়ার পর তার দেমাক, ঠাটবাটই বদলে যায়। সোনামুগ ডাল ও গোবিন্দভোগ চালের সঙ্গে তার ওঠাবসা। মাথা দিয়ে ডাল, চাল দিয়ে গরমমসলা সুবাসিত মুড়িঘন্টের মতো সাবেকি পদে তিনি শো স্টপার।

শুধু কি তা–ই? বাঙালি জীবনের সব শুভ কাজে রুই মাছ এবং মাছের মাথা লাগে। কারণ, মাছ বাঙালি জীবনে লক্ষ্মী শ্রীর প্রতীক; মঙ্গলচিহ্নও বটে। চৈত্রসংক্রান্তির চিনির তৈরি মঠেও মাছের শুভ উপস্থিতি। বাঙালি বিয়ের তত্ত্বে তেল–সিঁদুরে সাজানো জোড়া রুই তার সম্পূর্ণ গ্ল্যামার নিয়ে হাজির। বিয়ের পর বউভাতের দিন দুপুরে ঘি–ভাত পরিবেশনের সময় নতুন বউয়ের হাতে শ্বশুরমশাইয়ের পাতে মাছের মুড়োর পরিবেশনায় ভালোবাসার সম্পর্ক বুননের ছবি। এহেন অবস্থায় রুইয়ের মাথার দাম তো বাড়বেই। আবার জামাইষষ্ঠীতে জামাই বাবাজীবনের আপ্যায়নেও সেই আস্ত মুড়ো বিরাজমান। শিশু জন্মের আগে সাধ ভক্ষণেও ইনি অপরিহার্য।

বাঙালির কাছে রুই মাছের মুড়ো যে কত লোভনীয়, তার প্রমাণ সাহিত্যেও পাওয়া যায়। নৌকাডুবি উপন্যাসে রমেশ ইস্টিমারের খালাসিদের কাছ থেকে রুই মাছ কিনে কমলাকে দেয়। কমলা রান্না করে রুইয়ের মুড়ো রমেশের পাতে দিলে, রমেশ বলে, ‘এ তো স্বপ্ন নয়, মায়া নয়, মতিভ্রম নয়, এ যে সত্যিই মুড়ো, যাকে বলে রোহিত মৎস্য তাহারই উত্তমাঙ্গ।’

রুইয়ের তুলনায় কাতলা মাছের মাথা এবং শরীরের ওপর দিকটা ভারী ও চওড়া। চোখ বড় বড়, একটু বুদ্ধিহীন যেন। তুলনায় রুই সুশ্রী।

এ তো গেল আচার–অনুষ্ঠানের কথা। মাছের মাথা, তেল, কাঁটার কথা বলতে গেলেই যে রান্নার কথা না বললেই নয়, বহুদিন ধরে যে বাঙালি রান্নাঘর আলো করে রেখেছে, ভোজনরসিকেরা যার প্রেমে হাবুডুবু, অনুষ্ঠানবাড়ির দুপুরের মেনুতে যার অমোঘ উপস্থিতি একান্ত কাম্য, তিনি হলেন ছ্যাঁচড়া। হ্যাঁ, এত খারাপ নাম হওয়া সত্ত্বেও এর প্রেমে সবাই পাগল। নামে কীই–বা আসে–যায়! বিয়ে, পইতে, অন্নপ্রাশন, মৎস্যমুখীসহ নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে তরিবত করে রান্না হয় এই পদ। রুই, কাতলা, ভেটকি মাছের মাথা, তেল, কাঁটা, আলু, পটোল, ঝিঙে, কুমড়া, বেগুন, শাক ও নানা আনাজপাতি দিয়ে পাঁচফোড়ন শুকনা লঙ্কা ও তেল–মসলায় স্নাত এই ছ্যাঁচড়া দিয়েই এক থালা ভাত খাওয়া যায়।

বাজার, রান্না ও খাওয়াদাওয়া–সংক্রান্ত আমার যে অতি সামান্য বোধ, তার উৎস পারিবারিক প্রেক্ষাপট, বিভিন্ন বইপত্তর, দেশ–বিদেশ ভ্রমণ আর নিয়মিত বাজারে যাওয়া। বাজার আমার কাছে একটা বেড়ানোর জায়গা। ফর্দ মিলিয়ে বাজার করাটাই শেষ কথা নয়, বাজার করতে করতে ছবি, বাবলু, হান্নান, গব্বর ও সনজীদাদের সঙ্গে গড়ে ওঠা আত্মিক সম্পর্ক আমাকে ঋদ্ধ করে। শাকওয়ালি মাসি, মাছ বিক্রেতা, ডাঁটা বিক্রেতা প্রতিদিনের মোকাবিলায় পরিবার হয়ে উঠেছে। বাবলুই তো আমাকে শিখিয়েছে চ্যাপটা গড়নের বোয়াল নদীর আর গোলগাল গড়ন হলে তার বেড়ে ওঠা পুকুরে। বোয়াল মাছ নিয়ে ঘটিদের, মানে পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের যতই উন্নাসিকতা থাক না কেন, পূর্ব বাংলার মানুষ হয়ে তেলাল বোয়ালের কদর করব না, তা–ও আবার হয় নাকি! বোয়ালের অহংকারের জায়গা তার লেজ। বোয়ালের মাথা নিয়ে সাধারণত কারও তেমন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু আমার ঠাকুমা বোয়াল মাছের মাথা দিয়ে অসাধারণ এক লাউঘন্ট বানাতেন, যার স্বাদ জিবে আজও লেগে আছে। বোয়ালের মাথার সুঘ্রাণে সুবাসিত হয়ে উঠত কচি লাউ।

ইলিশের মাথা নানা সবজি দিয়ে ঘণ্ট করা যায়
ছবি: সুমন ইউসুফ

ছেলেবেলা থেকেই জেনে এসেছি, প্রাণিজগতের পুরুষেরা সব সময় মেয়েদের তুলনায় দেখতে ভালো হয়। সিংহ, ময়ূর, রেইনফরেস্টের প্রজাপতি সবাই। ব্যতিক্রম ইলিশ। গড়নের দিক থেকে পুরুষ ইলিশ সরু, লম্বাটে; স্ত্রী ইলিশ বেশ গোলগাল। পেটের দুই পাশের ধনুকের মতো গড়ন, যা ইলিশের জাত নির্ধারণ করে, তা স্ত্রী ইলিশের বেলায় যাকে বলে অধরা মাধুরী। এহেন মাছের মাথার স্বাদ নিয়ে যা–ই বলা যায়, কম হয়ে যায়। নানা সবজি দিয়ে ঘন্ট; পুঁইশাক, কচুশাক, শাপলা দিয়ে শুক্ত, শেষ পাতে টক—সর্বত্র তার অনন্য উপস্থিতি। বুদ্ধদেব বসু ইলিশের মাথা দিয়ে লাউঘন্টর কথাও বলেছেন।

এবার একটা মজার গল্প বলি। আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন ছিলেন দারুণ খাদ্যরসিক। কুমিল্লায় থাকাকালে সারা রাত জেগে লেখালেখি করতেন, ভোরের দিকে খিদে পেত। কাঠের আঁচে মায়ের হাতের পোলাও খেয়ে ঘুমাতে যেতেন। ওনার মাছ খাওয়া নিয়ে মজার গল্প আছে। আইড় মাছ তাঁর খুব প্রিয় ছিল। বাজার থেকে আইড় মাছ আনা হয়েছে এবং মাথাসমেত গোটা মাছ রান্না হবে—এমনটাই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বামুন ঠাকুর ভুল করে মুণ্ডুচ্ছেদ করে ফেলেছে। অন্দরমহল তটস্থ। বউমারা থরহরি কম্প। সেনবাড়ির সেজ বউমা স্মার্ট এবং বুদ্ধিমতী। কার্পেট সেলাইয়ের সুচ দিয়ে মাছের দ্বিখণ্ডিত মাথা জোড়া দেওয়া হলো। শুধু তা–ই নয়, খাওয়ার সময় গল্পচ্ছলে সেলাইয়ের সুতাও কোন ফাঁকে বের করে নিলেন, বাবামশাই টেরও পেলেন না। কাজেই মাছের মাথা নিয়ে মোটেই হেলাফেলা নয়।

রুই, কাতলা, ভেটকি, ইলিশ ও আরও নানা মাছ তো আছেই, বড় বড় গলদার পেলব, লাল ঘিসমেত মাথাকে ভুলি কী করে? মসলার প্রলেপে চালের গুঁড়া, ময়দার ফুরফুরে আবরণে এই মাথা ভাজার ভোজবাজিও কি কম? ধূমায়িত সাদা ভাতের কোলে মুচমুচে মাথা ভাঙামাত্র লাভা স্রোতের মতো নির্গত মাখন মসৃণ আগুনরঙা ঘিলুতে নিমেষে ভাতের রং পরিবর্তন। মাথার ম্যাজিক।

আসলে বাঙালির যাপনচিত্রে মাছের কথা বলে শেষ করা যাবে না। দৈনন্দিন জীবনে, সাহিত্যে, পুরাণে, কাব্যে, আচারে, অনুষ্ঠানে জলের এই মঙ্গলময় জীব মধ্যমণি হয়ে বসে আছে। তাকে তো আদর দিতেই হবে, কদর করতে হবে। আর তা করা যাবে যথাযথ রান্নার মাধ্যমে। রান্না মানে কিন্তু শুধুই পাকপ্রণালি নয়, চাই একটা নির্মল মন।

ওই যে স্বামী বিবেকানন্দ, যিনি খাদ্যরসিক এবং রন্ধনপটু ছিলেন, বলেছিলেন, ‘যে ভালো রাঁধতে পারে না, সে ভালো সাধু হতে পারে না। মন শুদ্ধ না হলে ভালো সুস্বাদু রান্না হয় না।’

তাই তো প্রবাদ আছে—

কে রাঁধে গো?

কয়লা, কড়াই, খুন্তি?

না, রাঁধে তোমার মনটি?