সূত্রাপুরের এই বিরিয়ানিতে আছে ফলের রস ও ঐতিহ্য

‘আগে দর্শনদারি পরে গুণ বিচারি’, এই আপ্তবাক্য মেনে এ বিরিয়ানির কথা শুরু করি। প্রথম দর্শনেই এটা ‘শ্বেতশুভ্র’ বিরিয়ানি। বিরিয়ানির যে পোলাও, তা বেশ ঝরঝরে ও সাদা। বিরিয়ানির মধ্যে যে খাসির মাংসের টুকরা, সেটাও বেশ ঝকঝকে। সতেজ ভাব ধরা পড়ে চোখে। চেখেও একই অনুভূতি। সতেজ স্বাদ। এই বিরিয়ানির একটি ব্যতিক্রমী উপাদান ফলের রস।

ঢাকা যেমন বাংলাদেশের রাজধানী, পুরান ঢাকা তেমনি খাবারের রাজধানী। যে বিরিয়ানি দেখা ও চাখার কথা বললাম, সেটি পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে রহিম বিরিয়ানি হাউসে পাওয়া যায়। সূত্রাপুর থানার পেছনে ১৪/১ ওয়াল্টার রোডে এর ঠিকানা।

বিরিয়ানির দোকানের বয়স ৮৪-৮৫ বছর
ছবি: সুমন ইউসুফ

দেশভাগের আগে থেকেই চলছে এই বিরিয়ানি। ৪০-৪৫ বছর আগে যখন প্রথম নামফলক লাগে, তখন এর নাম করা হয় রহিম বিরিয়ানি হাউস। যাঁর নামে এই খাবারের দোকান, সেই আবদুর রহিমের বয়স এখন ৮২ বছর। এখন দোকান চালান তাঁর ছেলে আবদুল কাদের। ৪৭ বছর বয়সী আবদুল কাদের জানালেন, তাঁর বাবা আবদুর রহিমের চাচা কালু মিয়া এই বিরিয়ানি তৈরি শুরু করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই চাচার সঙ্গী রহিম। আবদুল কাদের বলেন, ‘আমার বাবার জন্মের আগে থেকেই এই বিরিয়ানির দোকান চলছে। আর সেটা সূত্রাপুরের এই সড়কেই। সেই হিসাবে এই বিরিয়ানির দোকানের বয়স ৮৪-৮৫ বছর তো হবেই।’

আবদুর রহিম এখন বয়সের ভারে অনেকটাই ন্যুব্জ। তারপরও দোকানে এসে বসেন। তবে মূল রান্নাটা এখন আবদুল কাদেরই করেন। সঙ্গে থাকেন ছোট দুই ভাই মাহবুব জামিল ও মাহবুব এলাহী। মাহবুব জামিলও রান্নাটা শিখে ফেলেছেন। কাদের বলেন, ‘আমার ভাই, আমার চাচা, আমার মামা, চাচাতো ভাই—সবাই মিলেই দোকান চালাই। প্রস্তুতি থেকে প্লেটে বিরিয়ানি বেড়ে দেওয়া পর্যন্ত সব কাজই পরিবারের পুরুষেরা মিলে করি।’

রহিম বিরিয়ানি হাউজের দায়িত্ব এখন আব্দুল কাদেরের হাতে
ছবি: সুমন ইউসুফ

সকাল সাতটা থেকে শুরু হয় বিক্রি। নয়টার মধ্যেই শেষ। রমজান মাসে সময়সূচি পাল্টে গেছে। বিকেল চারটা থেকে শুরু হয় রহিম বিরিয়ানির বিকিকিনি। ইফতারের আগেই শেষ হয়ে যায়। আবদুল কাদের জানালেন, প্রতিদিন দুই ডেকচিতে ৫৪-৫৫ কেজির মতো বিরিয়ানি রান্না হয়। তিনি বলেন, ‘চাহিদা আরও আছে, চাইলে সারা দিনই বিক্রি করা যায়, কিন্তু লোকবল কম, তাই আমরা পেরে উঠি না।’ আর তা ছাড়া বিরিয়ানির মূল রেসিপি তাঁর কাছে। তাই এক হাতে এক স্বাদ রাখতে বিরিয়ানির পরিমাণ নির্দিষ্টই রাখেন।

রহিম বিরিয়ানি হাউসের বিরিয়ানিতে আঙুর ও বেদানার রস দেওয়া হয় রান্নার সময়। আবদুল কাদের বললেন, ‘সুঘ্রাণের জন্য ফলের রস দিই। চুলা থেকে গরম-গরম যখন নামানো হয়, তখন এর ঘ্রাণটা পাওয়া যায়।’ খাওয়ার সময়ও ফলের হালকা স্বাদ পাওয়া গেল।

ফলের রসের পাশাপাশি কাজু, চিনা ও কাঠবাদাম বেটে দেওয়া হয় বিরিয়ানিতে। কাদের বলেন, এই বিরিয়ানি রান্না করা হয় বাটা মসলা দিয়ে। দেশি পেঁয়াজ, রসুন, আদা, মরিচ ইত্যাদি সব বেটে নেওয়া হয়। তবে গরমমসলা (এলাচি, দারুচিনি ও লবঙ্গ) গোটা দেওয়া হয় বলে জানান কাদের।

রহিম বিরিয়ানি হাউসের হাফ বিরিয়ানিতে এক টুকরা আর ফুল প্লেট বিরিয়ানিতে দুই টুকরা খাসির মাংস থাকে। টুকরাগুলোর আকার বেশ বড়। কাদের বলেন, এক কেজি মাংস ১১ টুকরা করা হয়। আগে প্রতি কেজি মাংসে ৯ টুকরা করা হতো। দামের কারণে এখন টুকরা আগের থেকে একটু ছোট।’ তবে খেতে গিয়ে দেখা গেল, খাসির মাংসের টুকরা পোলাওয়ের সঙ্গে বেশ মানানসই। মোলায়েম আর বিভিন্ন মসলার টাটকা একটা স্বাদ মাংসে পাওয়া যায়।

বিরিয়ানিতে আঙুর ও বেদানার রস দেওয়া হয় রান্নার সময়
ছবি: পল্লব মোহাইমেন

এই বিরিয়ানির মাংসও বাটা মসলা দিয়েই ম্যারিনেট করা হয়। টক দইয়ের বদলে দেওয়া হয় দুধ। পুরো রান্নাই হয় লাকড়ির চুলায়। কাদেরের ভাষায়, এটা এক বড় বৈশিষ্ট্য। বিরিয়ানির রং এত সাদা কেন? ‘কোনো ধরনের কৃত্রিম রং দেওয়া হয় না। কোনো গুঁড়া মসলাও ব্যবহার করা হয় না,’ বললেন আবদুল কাদের। এসব কারণে এই বিরিয়ানিতে রঙের সামান্য ছটাও নেই। রান্নায় ব্যবহার করা হয় সয়াবিন তেল।

বিরিয়ানির সঙ্গে এখন লেবু, কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ দেওয়া হয়। তবে বছরের আড়াই মাস (ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত) বিরিয়ানির সঙ্গে টমেটোর খাট্টা পরিবেশন করা হয়। কয়েক রকম মসলা দিয়ে টমেটো মাখিয়ে ডাল ঘুটনি দিয়ে ধীরে ধীরে ঘুটে এই খাট্টা বানানো হয়। কাদেরের ছোট ভাই মাহবুব এলাহী জানালেন, টমেটোর স্বাভাবিক মৌসুমে এই পদ করা হয়। এরপর আর করা হয় না।

রোজার সময় বিকাল ৪টা থেকে শুরু হয় বিক্রি
ছবি: সুমন ইউসুফ

ওয়াল্টার সড়কের যে ঠিকানায় এখন রহিম বিরিয়ানি হাউস, আগে সেখানে ছিল না। একই সড়কের অন্য একটা ভাড়া দোকানে ছিল। ভাড়া দোকানের অভাবে মাঝখানে প্রায় সাড়ে চার বছর বন্ধ ছিল এই বিরিয়ানি। পছন্দমতো দোকান পাওয়ায় ২০২৩ সালের আগস্টে আবার নতুন আঙ্গিকে চালু হয়েছে বিরিয়ানির এই দোকান। দোকানে বেশ কয়েকজনের বসে খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে রমজানে শুধুই প্যাকেট বিরিয়ানি বিক্রি হয়। রহিম বিরিয়ানি হাউসের হাফ বিরিয়ানির দাম ১৫০ টাকা ও ফুল ৩০০ টাকা। কাদের বললেন, অনেকে মাংস ছাড়া শুধু পোলাও নিতে চান। সেভাবেও আমরা বিক্রি করি। পোলাওয়ের দাম ৫০ ও ১০০ টাকা।

দোকানের কাছেই একটি কমিউনিটি সেন্টারের চত্বরে বিরিয়ানির রান্নাবান্না চলে। এরপর টুকরিতে করে আসে দোকানে। কাদের বলেন, ‘টুকরি থেকেই শেষ হয়ে যায়। আমরা আসলে সকালেই দোকান করি। সকালের বিরিয়ানির স্বাদ আরও মজার।’