অষ্টগ্রামের পনির

সময়টা মোগল শাসনামল। কিশোরগঞ্জের হাওর জনপদ অষ্টগ্রাম। মূল ভূখণ্ডে দত্তপাড়া নামে একটি বসতি অঞ্চল ছিল। বিস্তৃর্ণ হাওরের গবাদিপশু পালনের অনুকূল পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে দত্তপাড়ার কয়েকজনের হাতে তৈরি হওয়া পনির বাণিজ্যিক সম্ভাবনা জাগায়। ঐতিহ্যের এই গল্প অন্তত ৩০০ বছর আগের। সেই সময় কয়েক বছরের মধ্যে গুণ, মান ও বর্ণে এই পনিরের পরিচিতি দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু তা–ই নয়, জিবে জল আসা এই পনির একসময় ইউরোপের বাজারও দাপিয়ে বেড়ায়।

পনির তৈরি হচ্ছে
ছবি: লেখক

দেশ ও বিশ্ববাজারে দিন দিন চাহিদা বাড়লেও প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিকতার এই সময়ে অষ্টগ্রামের পনিরের প্রসার সংকুচিত হয়ে এসেছে। অষ্টগ্রামের কারিগরদের বড় একটি অংশ এখন ঢাকা, চটগ্রাম ও সিলেটে স্থায়ী বসতি করে পনির ব্যবসা খুলে বসেছে। তবে বড় একটি অংশ চলে গেলেও অষ্টগ্রামে পনির তৈরি বন্ধ হয়ে যায়নি। বিলীন হয়ে যায়নি পেশার পরিবারগুলোও। অসংখ্য প্রতিকূলতার মধ্যে এখনো বেশ কয়েকটি পরিবার সম্পূর্ণ হাতে তৈরি করে পনিরের স্বাদ ও মান ধরে রেখেছে। তাই তো রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ শৌখিন ব্যক্তিরা এখনো অষ্টগ্রামের পনিরের সন্ধান করেন এবং বাজার সম্ভাবনাও দেখেন। এককথায় দেশ-বিদেশে সুখ্যাতি অর্জন করা অষ্টগ্রামের পনির এখন হয়ে উঠেছে গোটা কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যের অন্যতম স্মারক।

১৩ উপজেলার জেলা কিশোরগঞ্জ। জেলার তিনটি হাওর উপজেলার একটি অষ্টগ্রাম। হাওরের অর্থনীতি কৃষি ও মৎস্য–নির্ভর। এই জনপদের জমি এক ফসলি। বর্ষার বিস্তৃর্ণ জলরাশি আর গ্রীষ্মে ফসলি মাঠ—এই হলো হাওরের বৈশিষ্ট্য। চারণভূমি আর সবুজ ঘাসের সমারোহের কারণে হাওরে পর্যাপ্ত গরু ও মহিষের পালন হয়। হাওরের গবাদিপশুর দুধের গুণগত মান উৎকৃষ্ট। পনির তৈরির প্রধান উপাদান দুধ। সেই কারণে অষ্টগ্রামে পনির তৈরির কাঁচামালের অভাব হয়নি কখনো।

বাঁশের ঝুড়িতে ঢোকানো হচ্ছে পনির
ছবি: লেখক

নিশান মিয়া মধ্য অষ্টগ্রাম কারবালাহাটি গ্রামের বাসিন্দা। পরিবারটির মধ্যে দাদা নূর আলী প্রথমে আসেন এই পেশায়। মৃত্যুর আগপর্যন্ত বাবা ফিরোজ আলীর আয়ের মাধ্যম ছিল পনির। ভালো–মন্দের মধ্যে বাবা-দাদার পেশায় এখনো টিকে আছেন নিশান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিশান ছাড়া অন্তত ১০টি পরিবার নিয়মিতভাবে পনির তৈরি ও বাজারজাত করে আসছে। এই পনির যাচ্ছে বঙ্গভবন ও গণভবনেও। বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের খাদ্যতালিকায় পনির অপরিহার্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। গত বছর একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী অষ্টগ্রামের পনির নিয়ে তাঁর ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেন এবং বিদেশ রপ্তানির সম্ভাবনার কথা বলেন।

অতিরিক্ত পানি ঝরিয়ে ফেলা হচ্ছে
ছবি: লেখক

নিশান বলেন, ‘এখন পনিরের চাহিদা অনেক। এর মধ্যে কিছু ভোক্তার প্রধান আগ্রহ অষ্টগ্রামের পনিরে। কারণ, আমাদের পনির জিবে জল আনে। বিশেষ করে দেশের কিছু ভিআইপির আকর্ষণীয় নজর আছে আমাদের দিকে। ফলে অনেক সময় চাহিদার বিপরীতে জোগান দিতে কষ্ট হয়।’

তৈরি পনির
ছবি: লেখক

অষ্টগ্রামের পনিরের বিশেষত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে নিশান জানালেন, এখাকার গরু ও মহিষ বছরের বেশির ভাগ সময় সতেজ ঘাস খাওয়ার সুযোগ পায়। সেই দুধের কারণে ক্রিম থাকে প্রচুর। ফলে পনির তৈরির পর সুন্দর রং আসে এবং স্বাদেও ভিন্নতা থাকে।
জানা গেছে, বর্তমানে এক কেজি পনির তৈরি করতে ১০ কেজি দুধের প্রয়োজন হয়। হাঁড়িতে দুধ গরম করে ছানা করা এবং ছেঁকে পনির তৈরি করতে হয়। সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ হয় ৬০০ টাকার মতো। ফলে ৭০০ টাকার নিচে বিক্রি করার সুযোগ থাকে না। কখনো কখনো এক হাজার টাকা কেজিদরে বিক্রি করা যায়।

ঢাকা, সিলেট, কিশোরগঞ্জ অষ্টগ্রামে উৎপাদিত পনিরের প্রধান বাজার। এখন অনলাইনেও বাজারের প্রসার হচ্ছে। অর্ডার আসছে মুঠোফোনেও।

কিশোরগঞ্জ-৪ (অষ্টগ্রাম, ইটনা ও মিঠামইন) আসনের সাংসদ রেজওয়ান আহাম্মদ। তিনি বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বড় ছেলে। পনিরের নিয়ে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবভন ও গণবভনে প্রায় আমাদের পনির নিয়ে কথা হয়। গুরুত্বপূর্ণ লোকজন অষ্টগ্রামের পনির পেলে খেতে আগ্রহ দেখান।’ পেশার প্রসারে কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করার কথা জানান সাংসদ।

অষ্টগ্রামের পনির
ছবি: লেখক

পনির তৈরি করে ভালো আছেন কারবালা হাটির রাসেল মিয়া। রাসেল জানালেন, ‘চাহিদা সব সময় এক থাকে না। কখনো কখনো আমাদের অর্থকষ্টে পড়তে হয়। যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে বাজারজাতের সমস্যা অনেক। তবে আশার দিক হলো, এখন যোগাযোগ সমস্যা কিছুটা কমে আসছে। অনলাইনেও এই ব্যবসার প্রসার ঘটছে। বিদেশ থেকে অর্ডার পাচ্ছি।’ রাসেলের বিশ্বাস, সুযোগ পেলে জিবে জল আসা অষ্টগ্রামের পনিরের স্বাদ দেশের গণ্ডি ছাপিয়ে বিদেশেও প্রভাব ধরে রাখবে।