আমাদের কফি কালচার

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

বাঙালি ঐতিহ্যগতভাবে ভাবে চা-নাশতার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হলেও এক দশকের বেশি সময় ধরে কফি আমাদের জীবনে, বিশেষ করে শহরের নানা এলাকায় বেশ ভালোভাবেই জায়গা করে নিয়েছে। এর আগেও কফির প্রচলন ছিল। কিন্তু তা ছিল সীমিত পরিসরে এবং মূলত ইনস্ট্যান্ট কফির ব্যবহারে। আমাদের সামাজিকতায় এবং সাহিত্যের বর্ণনায় এক কাপ চায়ের আবেদন যদিও চিরায়ত, তবে বৈশ্বিক ক্যাফে সংস্কৃতির প্রভাব, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্যোক্তাদের আয়োজনে ইতালীয় কায়দায় তৈরি এস্প্রেসো এবং এই ধারার নানাবিধ ক্যাফেইন প্রধান পানীয় এখন হয়ে উঠেছে আমাদের নগরজীবনের অংশ।

প্রতীকী ছবি
ছবি: ডেনিস জাগোরোদনিউচ, পেকজেলসডটকম

প্রতি বছর এক অক্টোবর বিশ্ব কফি দিবস হিসেবে পালন করা হয় সারা বিশ্বের কফিচাষি এবং কফি ভ্যালু চেইনের সঙ্গে যাঁরা জড়িত আছেন, তাঁদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য। ২০১৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিক কফি সংস্থার উদ্যোগে দিনটি পালিত হয়ে আসছে।

কফি বিশ্বের অন্যতম অর্থকরী ফসল। ২০১৯ সালে বিশ্বজুড়ে কফিবাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১০২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। কফি রপ্তানিতে শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর তালিকায় আছে ব্রাজিল, ভিয়েতনাম ও কলম্বিয়া। আর আমদানিতে এগিয়ে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ফ্রান্স।

প্রতীতী ছবি
ছবি: পেকজেলসডটকম

ইতিহাসবিদদের মতে, দশম শতাব্দীর কোনো এক সময়ে ইথিওপিয়ায় কফি আবিষ্কৃত হয়। কথিত আছে, একদিন এক রাখালের পালের কিছু ছাগল জামজাতীয় একধরনের ফল খেয়ে ফেলে। এর ফলে ছাগলগুলোর মধ্যে উদ্দীপকের প্রভাবে কিছু পরিবর্তন আসে। রাখাল তা লক্ষ করে এবং তার ভিত্তিতে সেই ফল ও বীজ নিয়ে গবেষণা শুরু করে। সেই জামজাতীয় ফলের বীজই ছিল কফি।

দশম শতকে আবিষ্কৃত হলেও, আধুনিক সভ্যতায় পানীয় হিসেবে কফি ব্যবহারের নজির পাওয়া যায় ষোলো শতকে মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে ইয়েমেনের ইতিহাসে। সতেরো শতকে মধ্যপ্রাচ্যের বাকি অঞ্চল, উত্তর আফ্রিকা ও ইউরোপে কফির প্রচলন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

কফির সঙ্গে সামাজিকতা, আড্ডা, কথোপকথনের একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে। এ কারণে যে জনগোষ্ঠীর কাছেই কফি পরিবেশন করা হয়েছে, সেখানেই কফি খুব দ্রুত জনপ্রিয় পানীয় হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের ভাবনা আর প্রথা অনুযায়ী কফি নিয়ে নানা রকম বিশ্বাস ও সংস্কার প্রচলিত হয়ে যেতে দেখা যায়। যেমন পেয়ালা থেকে কফি পড়ে গেলে আরব সমাজে তাকে সৌভাগ্যের ইঙ্গিত হিসেবে ধরা হয়।আবার গ্রিসের লোকেরা মনে করে এতে টাকা আসবে। তুরস্কে কফির কাপের তলানি থেকে ভাগ্যগণনার চল এখন বিশ্বজুড়ে সবার জানা।

প্রতীকী ছবি
অ্যান্ড্রু নীল, পেকজেলসডটকম

বাংলাদেশে কফির জনপ্রিয়তার বর্তমান জোয়ার শুরু হয়েছিল ২০০৫ সালে, যখন দক্ষিণ এশিয়ার একটি কফির ব্র্যান্ড ঢাকায় আনা হয় এবং নগরবাসীর কাছে ইতালীয় প্রযুক্তিতে উচ্চ চাপে কফির গুঁড়ায় গরম পানির প্রবাহ থেকে তৈরি এস্প্রেসো কফি পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তী পাঁচ-ছয় বছরে কফির চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে আরও বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ের উদ্যোগ গড়ে ওঠে এবং ঢাকার বাজারে কফির বাণিজ্যিক অবস্থান জোরদার হয়। বর্তমানে ঢাকায় ৫০টির বেশি প্রিমিয়াম কফি আউটলেট আছে। তা ছাড়া অনেক খাবার ও নাশতার দোকানেও কফি বিক্রির ব্যবস্থা রাখা হয়। এদের মধ্যে প্রায় ৬০ ভাগ এস্প্রেসো এবং ব্রুড কফি, বাকিরা ইনস্ট্যান্ট কফি পরিবেশন করে। বাংলাদেশে কফির বাজার বর্তমানে প্রায় ৬০ কোটি টাকার।

এই কালচে রঙের মনজুড়ানো তিক্ত আর অম্ল স্বাদের পানীয়ের চাঙা করা প্রভাব ছাড়া আরও যে বিষয়গুলো কফি সংস্কৃতিকে আমাদের শহরে জনপ্রিয় করে তুলেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো, এই পণ্য ঘিরে গড়ে ওঠা পরিবেশ ও সামাজিক আদান–প্রদান। একজন শহুরে মানুষ এখন চাইলেই তাঁর পছন্দের ক্যাফেতে বসে ধোঁয়া ওঠা কাপের অজুহাতে পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে মশগুল হতে পারেন আড্ডায় কিংবা পারেন জমে থাকা লেখালেখি বা দাপ্তরিক কাজগুলো এগিয়ে নিতে। অথবা পারেন আনমনে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে চারপাশের জীবনের আনাগোনা দেখতে।

ক্যাফের পরিবেশ এমন হয় যে আপনি সেখানে একা বসে থাকলেও একাকিত্বের বোধ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারবেন। বিশ্বের সব বড় শহরে কফি ঘিরে গড়ে উঠছে এ ধরনের কফি সংস্কৃতি। আমাদের দেশের শহরগুলো বিশেষ করে ঢাকা এখন তার বাইরে নয়। এভাবে সামাজিকতাকে প্ররোচিত করে বিধায় কফিকে বলা হয় ‘সোশ্যাল লুব্রিক্যান্ট’।

প্রতীকী ছবি
ছবি: অ্যান্ড্রু নীল, পেকজেলসডটকম

কফির বাণিজ্যিক সফলতার সঙ্গে সঙ্গে কফিপ্রেমীর সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও কফি নিয়ে কিছু ভুল ধারণা জনসাধারণের মধ্যে থেকে গেছে। এটা সারা বিশ্বের কফিপ্রেমীদের ক্ষেত্রে যেমন, আমাদের শহরের কফিপ্রেমীদের ক্ষেত্রেও তেমন প্রযোজ্য। এই যেমন কফির তিক্ততার সঙ্গে এর চাঙা করার ক্ষমতা বা ক্যাফেইনের পরিমাণের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং বেশি ঝলসানো ডার্ক রোস্ট কফি দিয়ে তৈরি পানীয়তে অনেক ক্ষেত্রেই তুলনামূলকভাবে কিছু কম ক্যাফেইন থাকে। আর মানের বিবেচনায় বলতে গেলে, লাইট রোস্ট কফি সচরাচর তুলনামূলকভাবে উৎকৃষ্ট জাতের কফিদানা থেকে তৈরি করা হয়। অন্যদিকে ডার্ক রোস্ট কফিতে তাপ প্রয়োগ করে কফিদানার গুণের মাত্রাগত হেরফেরকে ছাপিয়ে দেওয়া যায়।

কফির জনপ্রিয়তা গত এক দশকে যেভাবে বেড়েছে, এই ধারা চললে হয়তো কফি আমাদের চাঙা করা উষ্ণ পানীয়ের বাজারে আরও বড় জায়গা দখল করে নেবে। সেই সঙ্গে বাড়বে চা-সমর্থক ও কফি-সমর্থকদের তর্ক। সেই তর্ক নাহয় জমে উঠুক চা কিংবা কফির চুমুকে চুমুকে, হোক সেটা শহরের জনপ্রিয় কোনো ক্যাফের প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা পরিবেশে কিংবা আপ্যায়নের আমেজে ঘেরা কোনো বৈঠকখানায়। তবে সচেতন ভোক্তা হিসেবে আমাদের হয়তো কফিবাণিজ্যের কিছু অমনোরম দিক নিয়েও অবগত থাকা প্রয়োজন। যেকোনো বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক খাতের মতো কফি উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণেও অনেক নিপীড়ন জড়িত থাকে। আমাদের উচিত উৎস নির্বাচন ও কেনার ক্ষেত্রে সেসব ব্যাপারে সচেতন হওয়া, যেন আমাদের এ ধরনের বিনোদনমূলক ব্যয়গুলো কফির অনৈতিক সরবরাহের পথগুলোর অর্থের জোগান না হয়।

লেখক: আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ, পরিবেশ, উন্নয়ন এবং টেকসই সচেতন উদ্যোক্তা, পরিবেশবান্ধব খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান ফিউশন টার্মিনাল-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সহপ্রতিষ্ঠাতা, সঞ্চয়িতা, একটি ভেগান রেস্তোরাঁ।