আমাদের নবান্ন

বাংলার মানুষের জীবনে অবিচ্ছেদ্য আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে ‘অগ্রহায়ণ মাস’ ও ‘নবান্ন’। অগ্রহায়ণ শব্দের অর্থ বর্ষ শুরুর মাস। আর অগ্রহায়ণের প্রথম দিনটিই বাংলাদেশে নবান্ন যাপনের দিন হিসেবে পরিচিত। দেশের প্রাচীনতম উত্সবগুলোর একটি নবান্ন উৎসব।

কার্তিক পেরিয়ে নীরবে আবির্ভাব ঘটে অগ্রহায়ণের। একসময় বাঙালির নতুন বছর শুরু হতো অগ্রহায়ণ মাস দিয়ে, তাই এ মাসের নাম হয়েছে অগ্রহায়ণ। এ মাসের প্রথম দিনে উদ্‌যাপিত নবান্নই বাঙালির ঐতিহ্যবাহী শস্যোত্সব। বাংলার কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়ে থাকে, নবান্ন তার অন্যতম। নবান্নের শব্দগত অর্থ ‘নতুন অন্ন’। নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসবই নবান্ন। সাধারণত, অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পরে এই উৎসব হয়। ঋতুবৈচিত্র্যে হেমন্ত আসে শীতের আগে। কার্তিক আর অগ্রহায়ণ মাস নিয়েই হেমন্ত ঋতু।

বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী অগ্রহায়ণ অষ্টম মাস হিসেবে বিবেচিত হলেও হেমন্ত ঋতুর দ্বিতীয় এ মাসের প্রথম দিনটিই বাংলাদেশের নবান্ন।

নবান্ন উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি জাতি-ধর্ম-বর্ণকে উপেক্ষা করে নবান্নকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে ওঠে। সামাজিক প্রথা, রীতি ও কৃত্যের পরিক্রমায় স্থানবিশেষে মাঘ মাসেও নবান্ন উদ্‌যাপনের প্রথা রয়েছে।

বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী অগ্রহায়ণ অষ্টম মাস হিসেবে বিবেচিত হলেও হেমন্ত ঋতুর দ্বিতীয় এ মাসের প্রথম দিনটিই বাংলাদেশের নবান্ন। বাংলার ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসব উদ্‌যাপন করার জন্য মেয়ে-জামাইসহ আত্মীয়দের নিমন্ত্রণ করে নতুন চালের পিঠা ও পায়েস রান্না করে ধুমধামের সঙ্গে ভূরিভোজের আয়োজন করা হয়। গ্রামের বধূরা অপেক্ষা করেন বাপের বাড়িতে নাইওরে গিয়ে নবান্ন যাপনের জন্য। পিঠা, পায়েস, মুড়ি-মুড়কি আর নতুন চালের ভাতের সুগন্ধে ভরে ওঠে মন।

কার্তিক মাসের শুরু থেকেই দেশের বিস্তীর্ণ জনপদে ধান কাটা শুরু হয়ে যায়। এ সময়ে কোনো বাড়িতে দেখা যায় ঢেঁকিতে চাল কোটা হচ্ছে পিঠার জন্য, কোনো বাড়িতে তৈরি হচ্ছে পায়েস। ধর্মাচারের অঙ্গ হিসেবে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের কৃত্য, প্রথা ও নানা রীতিতে নতুন অন্ন পিতৃপুরুষ, দেবতা, কাক ইত্যাদিকে উৎসর্গ এবং আত্মীয়স্বজনকে পরিবেশন করার পরেই গৃহকর্তা ও পরিবারবর্গ নতুন গুড়ে রান্নাসহ নতুন অন্ন গ্রহণ করে থাকেন। বিশেষ লৌকিক প্রথা অনুযায়ী নতুন চালের তৈরি খাদ্যসামগ্রী কাককে নিবেদন করা নবান্নের একটি অঙ্গ। প্রচলিত বিশ্বাস হচ্ছে, কাকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃত ব্যক্তির আত্মার কাছে পৌঁছে যায়।

বাংলার লোকছড়ায় এর দৃষ্টান্ত রয়েছে, ‘কো কো কো,/ আমাগো বাড়ি শুভ নবান্ন।/ শুভ নবান্ন খাবা, কাকবলি লবা?/ পাতি কাউয়া লাঠি খায়,/ দাড় কাউয়া কলা খায়,/ কো কো কো,/ মোর গো বাড়ি শুভ নবান্ন।’ কাকের উদ্দেশ্যে দেওয়া নৈবেদ্যকে বলে ‘কাকবলী’। অতীতে পৌষসংক্রান্তির দিনও গৃহদেবতাকে নবান্ন নিবেদন করার প্রথা ছিল। বিশ্বাস করা হয়ে থাকে, নতুন ধান উৎপাদনের সময় পিতৃপুরুষ অন্ন প্রার্থনা করে থাকেন। এ কারণেই পার্বণ কৃত্য অনুযায়ী নবান্নে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানও করা হয়ে থাকে কোথাও কোথাও। তবে এসব প্রাচীন প্রথা এখন আর খুব একটা দেখা যায় না।

বাংলার সব মানুষের অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসেবেই মুখ্যত নবান্ন সমাদৃত। নবান্ন উপলক্ষে পাড়ায় পাড়ায় ঘরের দাওয়ায়, বাড়ির উঠোনে, রাস্তার মোড়ে, স্কুলের আঙিনায় চলতে থাকে নবান্নের নাচ, নবান্নের গান, লোকগীতি, লালন গীতি, বাউলগান, সাপখেলা, বানরখেলা, লাঠিখেলা ইত্যাদি বাংলার প্রাচীন সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ। এ উপলক্ষে অঞ্চলভেদে পরিবেশিত হয় জারি, সারি, মুর্শিদি, পালা ও বিচারগান। আর মেলায় পাওয়া যায় নানা স্বাদের খাবার। ছোটদের বাড়তি আনন্দ দিতে গ্রাম্য মেলায় দেখা যায় নাগরদোলা, পুতুলনাচ, সার্কাস, বায়োস্কোপ, পালকিনাচ ও বড়দের জন্য যাত্রা-নাটকসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এ সময় প্রকৃতিতেও পরিবর্তন দেখা দেয়। অগ্রহায়ণ মাসেই ফসলের খেতে সোনালি হাসি ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় বাতাসে উড়ে বেড়ায় নতুন ধানের ঘ্রাণ আর ফুলের সৌরভ। এর সঙ্গে প্রকৃতিতেও পাওয়া যায় শীতল ছোঁয়া। সকাল-সন্ধ্যায় দেখা মেলে হেমন্তের মৃদু কুয়াশার।

অগ্রহায়ণ মাসে ফসলের খেতে সোনালি হাসি ছড়িয়ে পড়ে
ছবি: রজত কান্তি রায়

বাংলায় আনন্দের উৎসব হিসেবে নবান্ন ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের গণ্ডি পেরিয়ে এখন একই সঙ্গে লোক ও জাতীয় উৎসব। নবান্ন যখন সমাজের দশজনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে সম্পর্কিত, তখন ব্যক্তি বা পরিবারের ভূমিকার চেয়ে সামষ্টিক সমাজের একত্র আনন্দই এখানে মুখ্য। নবান্নের এই উৎসব ব্যক্তি, পরিবার, স্থান, কাল বা ধর্মের সীমানা দ্বারা আবদ্ধ না হয়েও এর সব কটিকেই ধারণ করে। অগ্রহায়ণ মাসে নতুন ফসল ঘরে তোলা উপলক্ষে কৃষকেরা এই উৎসব পালন করে থাকেন। সে সময় কোনো কোনো অঞ্চলে ফসল কাটার আগে বিজোড়সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে নিয়ে ঘরের চালে বেঁধে রাখা হয় এবং বাকি অংশ চাল করে পায়েস রান্না করা হয়।

নবান্ন, অগ্রহায়ণ এবং হেমন্ত নিয়ে বাংলার কবি-সাহিত্যিকদেরও আগ্রহের শেষ নেই যেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে/ জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে/ শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার/ রয়েছে পড়িয়া শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার/ স্বর্ণ শ্যাম ডানা মেলি।...’। ‘অঘ্রানের সওগাত’ কবিতায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘ঋতু খাঞ্চা ভরিয়া এল কি ধরণির সওগাত?/ নবীন ধানের অঘ্রানে আজি অঘ্রান হলো মাৎ।/ “গিন্নি পাগল” চালের ফিরনী/ তশতরি ভরে নবীনা গিন্নি/ হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীরে, খুশিতে কাঁপিছে হাত/ শিরনি রাঁধেন বড় বিবি, বাড়ি গন্ধে তেলেসমাত।’

বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। নবান্নকে কেন্দ্র করে অগ্রহায়ণের শুরুতেই আমাদের গ্রামবাংলায় চলে নানা নানা আয়োজন। হেমন্ত এলেই দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ ছেয়ে যায় হলুদ রঙে। এই শোভায় বিমোহিত কৃষকের মন আনন্দে নেচে ওঠে। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালির জীবনে নতুন বার্তা নিয়ে আগমন ঘটে অগ্রহায়ণের। নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি করা পিঠা, পায়েস, ক্ষীরসহ হরেক রকম সুস্বাদু খাবারের গন্ধে ভরে ওঠে চারপাশ। নবান্ন শস্যভিত্তিক একটি লোক–উত্সব। কৃষিভিত্তিক সভ্যতায় প্রধান শস্য সংগ্রহকে কেন্দ্র করেই এ উৎসব পালিত হয়ে থাকে। অধিক শস্যপ্রাপ্তি, বৃষ্টি, সন্তান ও পশুসম্পদ কামনা এ উৎসব উদ্‌যাপনের প্রধান কারণও বটে।


লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।