এই ঈদে আপনি কোন পোলাও খাবেন?

পোলাও শব্দটা শুনলেই চোখের সামনে ভাসে ধবধবে সাদা চালের ওপর বাদামি বেরেশতার নকশা আর নাকে আসে ঘি আর সুগন্ধি চালের রসায়নে জন্ম নেওয়া অদ্ভুত এক সুঘ্রাণ। আটপৌরে জীবন থেকে উৎসবের দিনটাকে আলাদা করে তোলে পোলাও। পিলাফ বা পোলাও শব্দটা যেখান থেকেই আসুক না কেন, এখন সেটা খুশির সমার্থক।

ছবি: খালেদ সরকার

পোলাও বলতে আমরা সাধারণত সাদা পোলাও বুঝি, যা খাওয়া হয় মুরগির কোরমা, রোস্ট অথবা মাটন রেজালার সঙ্গে।

ছবি: প্রথম আলো

সাদা পোলাওয়ের বাইরেও আছে আরও হরেক রকম পোলাও, ঈদের এই আনন্দ আয়োজনে স্বাদে খানিকটা বৈচিত্র্য যোগ করতে চিরায়ত পোলাওয়ে ঘটাতে পারেন খানিকটা পালাবদল। আর সেটা ভেবেই দেওয়া হলো কয়েক ধরনের পোলাওয়ের হদিশ।

ইয়াখনি পোলাও বা আখনি পোলাও

ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশে সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চল আর দেশের বাইরে ভারতের কাশ্মীর, পাকিস্তান, এমনকি বলকান অঞ্চলেও কাছাকাছি নামের এবং রেসিপির এই পদটির প্রচলন আছে। মূলত এই পোলাওয়ের উৎপত্তি পারস্যে, এরপর অটোমান সাম্রাজ্যের মাধ্যমে এই খাবার ছড়িয়েছে মধ্যএশিয়াসহ নানান অঞ্চলে।

ফারসি ভাষায় ইয়াখন মানে হচ্ছে মাংসের সুরুয়া, ইয়াখনি পোলাও মানে দাঁড়ায়, মাংসের সুরুয়ায় রান্না করা পোলাও। তবে সেই ইরান-তুরান ঘুরে বাংলাদেশে আসতে আসতে আদি অকৃত্রিম রেসিপিতে নিশ্চিতভাবেই যোগ হয়েছে স্থানীয় রান্নার প্রভাব এবং উপকরণ। তবে মূল পদ্ধতিটা একই। ছোট করে টুকরা করা মাংস, পেঁয়াজবাটা, রসুনবাটা, আদাবাটাসহ তেলে কষিয়ে নেওয়ার পর তাতে চাল, ছোট করে টুকরা করা আলু, ছোলা বা মটর সেদ্ধ, গাজর এসব কিছু মিশিয়ে রান্না করে নেওয়া হয়। আখনি পোলাও ঠিক বিরিয়ানি নয়, তাই এতে বিরিয়ানিতে চাল এবং মাংসের যে অনুপাত, সে রকমটা থাকে না আর মাংসের টুকরাও হয় ছোট। অনেকে সুতি কাপড়ের পুঁটলিতে গোটা গরমমসলা গরম পানিতে ফুটিয়ে সেই পুঁটলি তুলে নেওয়ার পর পানিটা ব্যবহার করেন আখনি রান্নায়। তাতে মসলার সৌরভ খাবারে মিশলেও দাঁতের নিচে এলাচি পড়ার অস্বস্তি হয় না!

ইলিশ পোলাও

ছবি: প্রথম আলো

বটমূলের পান্তা নয়, মুগ ডালের খিচুড়িও নয়; পোলাওয়ের সঙ্গে ইলিশের জুড়ির স্বাদ যাঁরা পেয়েছে, তাঁদের আসলে নরখাদক বাঘের মতো অন্য খাবারে অরুচি ধরবেই! চিনিগুঁড়া চালের সঙ্গে ইলিশের নিজস্ব ঘ্রাণের যে রসায়নটা তৈরি হয়, রান্নার পর ঢাকনা তুলতেই সেই সুবাস বেরিয়ে আসে। ফরাসি সৌরভ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো জানলে এই ফ্লেভারের পারফিউমই হয়তো বানিয়ে ফেলত!

ভালো ইলিশ মাছ, বড় বড় টুকরা করে কেটে টক দই দিয়ে মাখিয়ে রাখতে হবে। আর এই টুকরো হবে গাদা আর পেটিসহ। এরপর পেঁয়াজবাটা ও কুচি, আদাবাটা, রসুনবাটা, তেল, লবণে মসলা কষিয়ে মাছটা দিয়ে অর্ধেক রান্না করুন, চাইলে খানিকটা নারকেলের দুধও দিতে পারেন। এরপর মসলা থেকে মাছটা তুলে নিয়ে ইলিশের ঘ্রাণ যুক্ত মসলায় পোলাওয়ের উপকরণ মিশিয়ে পোলাও রান্না করুন। পোলাও হয়ে এলে ওপরে মাছের টুকরোগুলো বিছিয়ে দিয়ে ঢাকনা বন্ধ করে দমে রাখুন মিনিট কুড়ি। হয়ে যাবে ইলিশ পোলাও। আর রান্নায় যদি ইলিশের ডিম যোগ করতে পারেন, তাহলে তো কথাই নেই। স্বাদ আরও বেড়ে যাবে। একই পদ্ধতিতে ইলিশ ছাড়া রুই কিংবা অন্য বড় কোনো মাছ দিয়েও করা যাবে মাহি পোলাও।

মোরগ পোলাও

ছবি: প্রথম আলো

সাদা পোলাওয়ের জাজিমে সেদ্ধ ডিমের বালিশে শুয়ে থাকা হালকা মসলা মাখা মুরগির গোশত। মোরগ পোলাও স্বাদে ঢাকাই খাবারের এক অনন্য সৃষ্টি, যে খাবারের মিশে আছে মোগল থেকে আর্মেনিয়ান ইতিহাস। পুরান ঢাকার অলিগলি থেকে তারকা হোটেল, ১০ টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা দামের মোরগ পোলাও বিক্রি হয় এই শহরে। মোরগ পোলাও বিক্রি করে অনেক বাবুর্চিই হয়ে উঠেছেন কিংবদন্তি।

নান্না মিয়ার মোরগ পোলাও, ঝুনুর মোরগ পোলাও, ইসলামপুরের শানু পালোয়ানের মোরগ পোলাও—কত বাহারি নামের আড়ালে আছে নামহীন অনেক দোকান, যাঁদের রান্নাও চমকে দেবে আপনার জিবকে। পুরান ঢাকার ওয়ারীর বনগ্রামে তানভীর নামের এক লোক বিক্রি করেন ১০ টাকায় মোরগ পোলাও। তাঁর ক্রেতা হচ্ছে কারখানা, দোকানে কাজ করা শ্রমজীবী কিশোররা। মুরগির মাংসের ছোট টুকরা, অর্ধেকটা ডিম আর খানিকটা পোলাও; ১০ টাকায় তানভীর এভাবেই হাসি ফোটাচ্ছেন গরিব শিশু–কিশোরদের মুখে।

বাসন্তী পোলাও

ছবি: প্রথম আলো

এপার বাংলায় পোলাও মানেই যেমন সাদা পোলাও, পোলাও বলতেই বোঝায় বাসন্তী পোলাও। নামেই বলে দিচ্ছে, রংটা ঠিক ধবধবে সাদা নয়, একটু হলদে আভা ছড়ানো। কারণ, এতে দেওয়া হয় দুধে গুলানো জাফরান। না পেলে অবশ্য সামান্য হলুদ গুঁড়াতেও কাজ চলে যায় কিংবা এডিবল কালার! ঘি, কাজু, কিসমিস আর গোটা গরমমসলায় পেঁয়াজ–রসুন ছাড়াই রান্না করা যায় হালকা মিষ্টি স্বাদের এই পোলাও। নিরামিষভোজী হলে মটর-পনিরের তরকারির সঙ্গে বাসন্তী পোলাওয়ের সংগতটা হবে দারুণ আর আমিষ পছন্দ হলে সঙ্গে রাখুন মাটনকষা।

তাওয়া পোলাও

ছবি: ইনস্টাগ্রাম

মুম্বাইয়ের বহুল প্রচলিত স্ট্রিট ফুড তাওয়া পোলাও। ‘বাস্তব’ ছবিতে সঞ্জয় দত্তকে দেখা যায় বন্ধুকে নিয়ে ভ্যানগাড়িতে করে পাওভাজি আর তাওয়া পোলাও বিক্রি করতে। তাওয়া পোলাও আসলে দেশীয় স্বাদের ফ্রায়েড রাইস। আগে থেকে রান্না করে রাখা ভাতকে পাওভাজির মসলা আর টমেটো, ক্যাপসিকাম, কাঁচা মরিচ, ধনেপাতাকুচি দিয়ে পরিবেশন করা হয় তাওয়া পোলাও। পাওভাজি বানানোর বড় তাওয়াতে নেড়েচেড়ে এই পোলাও বানানো হয় বলেই হয়তো এর নাম তাওয়া পোলাও। চাইলে বাড়িতেও ভাতের সঙ্গে হলুদগুঁড়া, মরিচগুঁড়া, জিরাগুঁড়, ধনেগুঁড়া, পেঁয়াজকুচি মিলিয়ে কড়াইতে চড়া আঁচে নেড়ে নেড়ে ভেজে বানিয়ে নেওয়া যেতে পারে তাওয়া পোলাও। মেশাতে পারেন ক্যাপসিকামকুচি, মটরশুঁটি সেদ্ধ, টমেটোকুচি আর ওপরে ছড়িয়ে দিতে পারেন ধনেপাতাকুচি আর লেবুর রস।

চিড়ার পোলাও

ছবি: রাজীব আহমেদ

চাল নয়, চিড়া দিয়েও হয় পোলাও। ভেজানো চিড়া শুকিয়ে তেলে পেঁয়াজকুচি রসুনকুচি, কাঁচা মরিচ ফালি, ডিম দিয়ে মুচমুচে করে ভেজে নিলেই হয়ে যাবে চিড়ার পোলাও, যেটা দুপুরে ভাতের বদলে খাওয়া না গেলেও মেঘলা বিকেলের ভারী নাশতা হিসেবে দিব্যি জমে যাবে।