করোনাকালে রেস্তোরাঁ ব্যবসা

প্রতীকী ছবিছবি: সংগৃহীত

করোনাকালের এই দুর্যোগ মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে খাবার ও রেস্তোরাঁ ব্যবসায়, বিশেষ করে ফাস্টফুড বা কুইক সার্ভিস রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়। করোনার দিনগুলোয় সবাইকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে এবং বাড়িতে সময় কাটানোর কথা বলা হচ্ছে। তাই আগের সেই জমজমাট লোকসমাগম এখন আর ক্যাফে বা রেস্তোরাঁগুলোয় নেই। এই দুর্যোগের মধ্যেও কিছু রেস্তোরাঁ ও খাবারের দোকান তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে খাবার ডেলিভারি ও টেক অ্যাওয়ে ব্যবস্থা করেছে, কিছু রেস্তোরাঁ একদমই বন্ধ হয়ে গেছে। যেহেতু বেচাকেনা নেই, তাই অনেকে কর্মী ছাঁটাই করে খরচ কমাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু এভাবে কত দিন? খাবারের দোকান ও রেস্তোরাঁগুলো করোনাকালের এই দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে এবং করোনাপরবর্তী সময়ে ব্যবসার ধরন পাল্টাতে কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছে?

রেস্তোরাঁ ব্যবসার মালিক ও অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কোভিড-১৯ আমূল প্রভাব ফেলবে ভোক্তার খাদ্যরুচি ও চাহিদায়। দেশে সাধারণ ছুটি শেষ হওয়ার পরে কিছু রেস্তোরাঁ তাদের কার্যক্রম শুরু করে এবং সেখান থেকেই ধারণা পাওয়া যাচ্ছে ভোক্তার খাদ্যাভ্যাস ও চাহিদা আগের থেকে বদলে গেছে। মানুষের এখন সেই সুযোগ নেই যে তারা রেস্তোরাঁয় বসে সময় কাটাবে, বরং অর্ডার দিয়ে বাসায় খাবার এনে খাওয়াকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। তাই রেস্তোরাঁর মালিকদের করোনাকালের জন্য ‘স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা’ ও করোনাপরবর্তী সময়ের জন্য ‘দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা’র কথা ভাবতে হচ্ছে। একই সঙ্গে পরিকল্পনায় রাখতে হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়কেও।

ঢাকা শহরের একটি রেস্টুরেন্টের একজন ডেলিভারি ম্যান
ছবি: সংগৃহীত

করোনাকালে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা

করোনাকালে ব্যবসার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে কুইক সার্ভিস রেস্টুরেন্টগুলো গুরুত্ব দিচ্ছে ক্রেতা ও কর্মচারীদের নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা, ডিজিটাল ব্যবস্থায় অর্ডার নেওয়া বা নিজস্ব ই-কমার্স সাইটের উন্নয়ন, রেস্তোরাঁয় খাবার রান্না ও প্রস্তুতিতে আগের থেকে বেশি সাবধানতা অবলম্বন, ভোক্তার চাহিদা অনুযায়ী নতুন খাবারের মেনু যোগ করা বা কাঁচামাল সরবরাহ চেইন স্থিতিশীল রাখার দিকে। বিশ্বখ্যাত ফাস্টফুড চেইন বার্গার কিং বাংলাদেশ শুরু থেকেই তাদের কার্যক্রম আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালনা করছে।

স্বাস্থ্যবিধির সব মানদণ্ডকে অটুট রেখে বার্গার কিং খাবার পরিবেশন করে থাকে। প্রতিদিনের ডেলিভারি দেওয়ার ব্যাগ যেন পরিষ্কার থাকে, কর্মীদের শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক আছে কি না, কাজে থাকার সময় এসব পর্যবেক্ষণ করেই হোম ডেলিভারি সার্ভিস পরিচালিত হচ্ছে। ক্রেতা তার পছন্দ অনুযায়ী চাইলে ফোন করে খাবার অর্ডার করতে পারবে এবং রেস্তোরাঁয় এসে খাবার নিয়ে চলে যেতে পারবে।

করোনাপরবর্তী দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা

করোনা সংকটে ভোক্তার মানসিকতা ও আচরণের পরিবর্তন হয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

করোনা সংকট কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রেস্তোরাঁ ব্যবসায় অবশ্যই ভোক্তার পরিবর্তিত মানসিকতা ও আচরণের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে, যা রেস্তোরাঁ ব্যবসার ভবিষ্যৎকে নতুন রূপ দেবে। তাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে স্বাস্থ্যবিধি, নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতায়। ভবিষ্যতে ক্রেতা ও ভোক্তা অনেক বেশি সচেতন হবে খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে, যেমন: খাবারে কী কী উপাদান দেওয়া হয়েছে, কাঁচামাল কোথা থেকে এসেছে, খাবার কীভাবে এবং কে প্রস্তুত করল ইত্যাদি। এ ছাড়া ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে খাবার অর্ডার করা, যোগাযোগহীনভাবে খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা, রেস্তোরাঁয় মানুষের ভিড়ে সময় না কাটিয়ে বাসায় বেশি সময় কাটানো ইত্যাদি পরিবর্তন ভোক্তার মধ্যে আসবে। তাই খাবারের ব্যবসায় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে রান্না করা খাবার ডেলিভারি দেওয়ার পাশাপাশি শুকনো খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের ব্যবস্থা রাখার কথা ভাবতে পারে।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা

একটি প্রায় ফাঁকা রেস্টুরেন্ট, ঢাকা
প্রথম আলো

করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। রেস্তোরাঁ ব্যবসায় পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে বার্গার কিং বাংলাদেশের জেনারেল ম্যানেজার মাশরুফ আহমেদ বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আমাদের গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী কর্মীদের বারবার হাত ধোয়ার নির্দেশনা রয়েছে। রেস্তোরাঁর সব সরঞ্জাম ও দ্রব্য সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে। আমাদের কোনো কর্মী যেন অসুস্থ অবস্থায় কাজ না করে, সে ব্যাপারে আমরা সদা সচেতন থাকি। আমরা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি আমাদের ভোক্তা, ক্রেতা ও কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তায় এবং তা নিশ্চিত করতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’ এ ছাড়া বার্গার কিং তার সব আউটলেট স্যানিটাইজার দিয়ে পরিষ্কার রাখার ব্যবস্থা করেছে, বেসিনে সর্বদা পরিষ্কার পানি সরবরাহ করা, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল সাবান রাখা ও কাগজের টাওয়েল রাখার ব্যবস্থা করেছে। কর্মীদের খাবার ধরার আগে ও পরে, ডেলিভারি করার আগে ও পরে স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বার্গার কিংয়ের মতো গ্লোবাল কুইক সার্ভিস রেস্টুরেন্ট বর্তমান বাস্তবতা ও ভোক্তার চাহিদার কথা ভেবে তাদের ব্যবসা পরিচালনায় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে, যা ভবিষ্যৎ রেস্তোরাঁ ব্যবসা ও শিল্পে পরিবর্তন নিয়ে আসবে বলে মনে হচ্ছে।

রেস্তোরাঁর অভ্যন্তরে সামাজিক দূরত্ব

‘রেস্টুরেন্ট পুনরায় খোলার সময় আমাদের প্রধান চিন্তার বিষয় ছিল সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা,’ বলছিলেন বার্গার কিংয়ের মহাব্যবস্থাপক মাশরুফ আহমেদ। বার্গার কিং ইতিমধ্যে গ্রাহকদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার সুবিধার্থে রেস্তোরাঁগুলোর মেঝে, চেয়ার ও টেবিলগুলোয় চিহ্ন দিয়ে রেখেছে। যদিও খাবারের ব্যবসার ধীরগতি অব্যাহত থাকায় দোকানের ভাড়া দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে, তাও বড় রেস্তোরাঁগুলো এখন আশা করছে, আগামী দুই মাসের মধ্যে ব্যবসা আবারও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। চীন ও ইউরোপের অনেক অংশ তিন থেকে চার মাস পরে আবার খুলেছে এবং প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ গ্রাহক রেস্তোরাঁগুলোয় ফিরেছে। তেমনি আমাদের এখানকার রেস্তোরাঁগুলো যেহেতু স্বাস্থ্যবিধি এবং সুরক্ষাব্যবস্থা মেনে নিচ্ছে, তাতে গ্রাহক ফিরবে আশা করা যায়।

অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে অনেক খাবারের ব্যবসা হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে, তাই এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে প্রধান ভূমিকা পালন করবে গ্লোবাল ফুড চেইনগুলো। পরিবর্তন আসবে রেস্তোরাঁর আউটলেট পরিচালনায়, খাবার সরবরাহ ব্যবস্থায়, মূল্য পরিশোধের পদ্ধতিতে, আউটলেট বাড়ানো বা কমানো, সাপ্লাই চেইন, নতুন পণ্য/সেবা সংযোজন, বাজারজাতকরণ চ্যানেল ও প্রচারণার ধরনে। রেস্তোরাঁ ব্যবসায় ও সর্বোপরি বৈশ্বিক অর্থনীতি দুর্যোগ কাটিয়ে উঠুক, সেটাই হলো আমাদের সবার প্রত্যাশা।