কিংবদন্তির খাবারদাবার

এ টি এম শামসুজ্জামান
কোলাজ, প্রথম আলো

অভিনেতা আরফান আহমেদের সঙ্গে পুরান ঢাকার দেবেন্দ্র দাস লেন গলির মুখে যখন পৌঁছাই, তখন সকাল সাড়ে ৯টা। কথা ছিল আমরা সে সময়েই পৌঁছাব তাঁর বাসায়। আরফান আহমেদ তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী। একটি অডিও নাটকে কণ্ঠাভিনয়ের প্রস্তাব তিনি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁকে আনতেই যাওয়া তাঁর পুরান ঢাকার দেবেন্দ্র দাস লেনের বাড়িতে। সময়টা প্রায় পাঁচ বছর আগে, ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসের ১১ তারিখ। তখন তাঁর বয়স প্রায় ৭৫ বছর এবং তখনো তিনি টেলিভিশনে দুর্দান্ত কাজ করে চলেছেন। তিনি আবু তাহের মোহাম্মদ শামসুজ্জামান, সবাই আমরা যাকে এ টি এম শামসুজ্জামান নামেই চিনি।

প্রথমত তিনি ‘প্রায় ভেজিটেরিয়ান’। মাংস খান না বললেই চলে। প্রতি ঈদে এক বা দু টুকরো গরুর মাংস খাওয়া তাঁর দীর্ঘদিনের অভ্যাস। সারা বছর আর খান না। মাটন বছরে একবার থেকে দুবার খেয়ে থাকেন। মাটনের মধ্যে তাঁর পছন্দ মগজ বাদে শুধু মাথা। মাছ খান বেশি। ইলিশ প্রিয় মাছ। প্রচুর শাকসবজি খান। বলা যায় সবজিই তাঁর প্রধান খাবার ছিল।

কথায় কথায় তিনি জানান, অবসরে তিনি বই পড়েন। ধর্মীয় বই থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ-সজনীকান্ত সব। ধীরাজ ভট্টাচার্যের বিখ্যাত দুইখানা বই ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ এবং ‘যখন নায়ক ছিলাম’ তাঁর সংগ্রহে দেখে আমি তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ, ছাপা বই হিসেবে বই দুখানা এখন রেয়ার। ‘বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ’ আর ‘শনিবারের চিঠি’র পুরো সেট তাঁর সংগ্রহে ছিল। আরও বেশ কিছু বই ছিল যেগুলো আমাকে আকর্ষণ করে এবং নতুন করে এ টি এম শামসুজ্জামানকে চিনতে সহায়তা করে।

নিজের বাসায় পত্রিকা পড়ছেন এ টি এম শামসুজ্জামান। ১১ নভেম্বর ২০১৫
ছবি: লেখক

আমার চিরকালের দুর্বলতা খাবারদাবারের প্রতি। সে আগ্রহ মেটাতেই আমি এ টি এম শামসুজ্জামানের কাছে জানতে চাই তাঁর প্রিয় খাবার কী। তিনি জানালেন, প্রথমত তিনি ‘প্রায় ভেজিটেরিয়ান’। মাংস খান না বললেই চলে। প্রতি ঈদে এক বা দু টুকরো গরুর মাংস খাওয়া তাঁর দীর্ঘদিনের অভ্যাস। সারা বছর আর খান না। মাটন বছরে একবার থেকে দুবার খেয়ে থাকেন। মাটনের মধ্যে তাঁর পছন্দ মগজ বাদে শুধু মাথা। মাছ খান বেশি। ইলিশ প্রিয় মাছ। প্রচুর শাকসবজি খান। বলা যায় সবজিই তাঁর প্রধান খাবার ছিল।

এ টি এম শামসুজ্জামানের প্রতিদিনের জীবনচক্র ছিল একেবারে বাঁধা, যদি তিনি বাসায় থাকতেন। একটু এলোমেলো হতো শুটিংয়ের জন্য বাড়ির বাইরে থাকতে হলে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর এক গ্লাস পানি পান করেন। তারপর আপেল একটা। ঘণ্টাখানেক পর নাশতা হিসেবে খান রুটি বা বানরুটি আর চা। দুপুরে প্রচুর সবজি। যেহেতু শুটিংয়ে থাকতে হতো বেশির ভাগ সময়, তাই ইউনিটের খাবারই খেতে হতো। তবে ইউনিটে তার জন্য চায়নিজ ভেজিটেবল রাখাটা বাধ্যতামূলক ছিল বলা চলে। সঙ্গে খুবই সামান্য ভাত। আর খাবারদাবারের ক্ষেত্রে আচার ছিল তাঁর প্রিয়। বাসায় দুপুরে খাওয়ার সময় তাঁর আচার না হলে চলত না। ইউনিটে ব্যবস্থা না থাকলে অবশ্য চালিয়ে নিতেন।

এ টি এম শামসুজ্জামান এর লাইব্রেরির একাংশ
ছবি: লেখক

খাবার নিয়ে তাঁর সহবত আমাকে ভীষণ আকৃষ্ট করেছিল। যে নাটকে কণ্ঠাভিনয়ের জন্য তিনি স্টুডিওতে গিয়েছিলেন, সেখানে খাবারের আয়োজন ছিল কাচ্চি বিরিয়ানি, চিকেন গ্রিল, সালাদ, মিষ্টি। তাঁর জন্য চায়নিজ সবজি আর সাদা ভাত।

প্রচুর ভিড়ের মধ্যে তাঁর জন্য একটা সিট রাখা হয়েছিল বিশেষভাবে। কিন্তু রেকর্ডিংয়ের অন্যদের বাদে তিনি একা বসে খেতে আপত্তি জানিয়েছিলেন সেবার। অথচ তাঁর তিনটায় যাওয়ার কথা ছিল শিল্পকলা একাডেমিতে—কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের দেওয়া লাইভ টাইম অ্যাচিভমেন্ট গ্রহণে। তিনি তারপরও খেলেন না। অপেক্ষা করলেন। আমাদের সবার বসার জায়গা হওয়ার পর সবাই একসঙ্গে খেয়েছিলাম সেদিন। তারপর তিনি পুরস্কার গ্রহণ করতে গিয়েছিলেন।

আজ এ টি এম শামসুজ্জামানের মৃত্যুর দিনে প্রায় পাঁচ বছর আগের একদিনের সে স্মৃতি মনে পড়ে গেল। তিনি শুধু অভিনেতাই ছিলেন না। ছিলেন সব বিষয়ে একজন দুর্দান্ত মানুষ। পরপারে ভালো থাকুন কিংবদন্তি।