গরুর হাসির বিশ্বজয়

ফরাসিতে একটি কথা আছে, ‘লা ভাস কি রি’। এর আক্ষরিক অনুবাদ করলে হয় ‘যে গরু (গাভি) হাসে’। মোট ২২টি ভাষায় কথাটি ভাষান্তরিত করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২৩ কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলায় অনুবাদ খুঁজে না পেয়ে খানিকটা হতাশ হলাম।
গরুর হাসি—কেমন অদ্ভুত কথা! হাসি-তামাশা মানুষের একচেটিয়া অধিকার, তা ভাবার কারণ না থাকলেও গরু যে হাসতে পারে, তা কেউ কখনো বলেনি বা শোনেনি। তবে হ্যাঁ, পনির, অর্থাৎ চিজের জগতে ‘যে গরু হাসে’ এক উজ্জ্বল কাহিনি এবং এক বর্ণাঢ্য ও চমকপ্রদ ইতিহাস।

একেবারে প্রথম দিকের ‘যে গরু হাসে’ পনিরের গোলাকার মোড়ক
ছবি: জাদুঘর লা মেজোঁ দ্য লা ভাস কি রি

আজ থেকে প্রায় এক শ বছর আগে ১৯২১ সালের ১৬ এপ্রিল জন্ম নেয় একটি বিখ্যাত পনির, তার নাম ‘যে গরু হাসে’। গরু না হাসলেও সে পনির দীর্ঘ এক শতকের যাত্রাপথে খাদ্য রসনায় তৃপ্তি জুগিয়ে হাসি ফুটিয়েছে কোটি কোটি মানুষের মুখে।

এমন নামকরণের পেছনে খানিকটা ইতিহাস আছে। জুল বেল নামের একজন পনির প্রস্তুতকারী নিজের হাতে পনির তৈরি করে বিক্রি করতেন। তাঁর জীবনের ৩০টি বছর কেটেছে এই পনির নিয়ে। তখনো সমগ্র ফ্রান্সে পনির প্রস্তুত করার তেমন কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি; অর্থাৎ, কুটিরশিল্পের কারিগরিতেই তা সীমাবদ্ধ ছিল। জুল অবসর নিলে এ পারিবারিক প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নেন তাঁর ছেলে, লেওঁ বেল। কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হলে ৩৬ বছর বয়সের লেওঁ বেলের ডাক পড়ে যুদ্ধে অংশ নিতে। তিনি ছিলেন সেনাদের জন্য ‘টাটকা মাংস সরবরাহ’ ইউনিটে। সেনা অধিনায়কের নির্দেশ মেনে মাংস সরবরাহের ট্রাকগুলো চিহ্নিত করার জন্য খানিকটা মানুষের মুখের আদলে হাসি হাসি মুখের একটি গরুর মুখ আঁকা হয়। এর অঙ্কনশিল্পী ছিলেন বেনজামা রাবিয়ে।

যৌবনে সৈনিক লেওঁ বেল
ছবি: জাদুঘর লা মেজোঁ দ্য লা ভাস কি রি

একসময় যুদ্ধ শেষ হলো। লেওঁ বেল ফিরে এলেন পনির তৈরি এবং বিক্রির তাঁর পুরোনো পেশায়। সে সময় ফরাসিরা পনির তৈরি করতে গিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে নানা রকম কায়দা, কৌশল কাজে লাগিয়ে এ দেশের পনির প্রস্তুতকারীরা নিত্যনতুন পনির উৎপাদনে নিজেদের মেধা, শ্রম, অধ্যবসায় আর ঐকান্তিকতা নিয়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছিলেন।

ফ্রান্সে, বিশ শতকের শুরুতেই পনির উৎপাদনে প্রসার লাভ করে। তখনকার গণনা অনুসারে, হাজারের বেশি পনির ছিল এ দেশে। হাজার পনিরের ভিড়ে বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে নতুন কিছু করতে হবে। আর যেমন ভাবা তেমনই কাজ। লেওঁ বেল প্রথমে আধা নরম পনির উৎপাদন এবং বাজারজাত করতে শুরু করেন। এমন পনিরের একটা আলাদা চাহিদা ছিল। কারণ, সহজেই রুটিতে মাখানো যায় এবং অনেক রান্নায় ব্যবহার করা যায়। তা ছাড়া সাধারণ তাপমাত্রায় সংরক্ষণের সুবিধা ছিল। ১৯১১ সালে সুইজারল্যান্ডের ফ্রিটজ স্টেটলার প্রথম এই আধা নরম পনির তৈরির কৌশল এবং শিল্পোৎপাদন প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেন।

জাদুঘরে রক্ষিত শিল্পকর্ম
ছবি: জাদুঘর লা মেজোঁ দ্য লা ভাস কি রি

লেওঁ বেল সে প্রক্রিয়াকে আরও উন্নত করে তৈরি করলেন নিজের আধা নরম পনির। প্রথম দিকে তিনি নাম দিলেন ‘আধুনিক পনির’। খাবারের নামের সঙ্গে ‘আধুনিক’ কথাটিতে ভোক্তারা খুব বেশি আগ্রহ দেখাল না। তখন নতুন একটি নাম নিয়ে চিন্তা করছিলেন তাঁরা। একসময় হাসিতে তাঁর মুখ উজ্জ্বল হলো, স্মৃতিতে হাজির হলো হাসিমাখা সেই গরুর মুখটি। নাম দিলেন ‘যে গরু হাসে’।

নিয়মমাফিক প্রশাসনের কাছে আবেদন করে এমন নামটি নিয়ে নিলেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল, প্রচারের জন্য এবং প্যাকেটের গায়ে হাসিমাখা গরুর মুখটি আঁকা যাচ্ছিল না সহজে। ডাক পড়ল সেই অঙ্কনশিল্পী বেনজামা রাবিয়ের। তিনি ছবিটি এঁকে লেওঁ বেলকে দিলেন। লেওঁ ছবিটি নিয়ে প্রথমে তাঁর স্ত্রী আন-মারিকে দেখালেন। আন-মারি ছবিটি ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে দেখে স্বামীকে পরামর্শ দিলেন, হাসি হাসি গরুর মুখে খানিকটা মেয়েলি ছাপ ফুটিয়ে তুলতে। তিনি নিজেই সে উপায় বাতলে দিলেন, গরুর লম্বা দুই কানে এক জোড়া কানবালা এঁকে দিতে বললেন। এমন আইডিয়া শিল্পী এবং উদ্যোক্তা দুজনেই খুব পছন্দ করলেন। এদিকে ছাপাখানার যিনি কর্ণধার, তিনি কর্ণ নিয়ে চিন্তা না করলেও বর্ণ নিয়ে চিন্তা করলেন। তিনি বললেন যে লাল রং সবার চোখে পড়ে খুব তাড়াতাড়ি। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী হাসি হাসি মুখের কানবালা কানে গরুর রং হলো অনেকটা উজ্জ্বল লাল।

গোলাকার মোড়কে আলাদা আলাদা মোড়কে ত্রিকোণ টুকরা
ছবি: সংগৃহীত

আজ থেকে এক শ বছর আগে, সে সময় ব্যবসা-বাণিজ্যে ‘মার্কেটিং’ কথাটি তেমন জাঁকিয়ে বসেনি। সে সময় লেওঁ বেল গোলাকার প্যাকেটে পনিরের আটটি ত্রিকোণ টুকরা করে একটি পাতলা অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে মুড়ে দিলেন। প্রতি টুকরা থেকে অ্যালুমিনিয়ামের আবরণ সহজে খুলে ফেলার জন্য একটি লাল রঙের চিকন ও পাতলা ফিতা লাগিয়ে দিলেন। এতে খাবার বা রান্নায় ব্যবহারের আগে ফিতাটিতে একটু টান দিলেই সহজেই সাদা বর্ণের পনিরের টুকরাটি বেরিয়ে আসবে। অব্যবহৃত টুকরাগুলো অ্যালুমিনিয়ামের আবরণে থাকার কারণে সংরক্ষিত থাকে। এটা একটা বাড়তি সুবিধা।

প্রতিবছর সাইকেলে সমগ্র ফ্রান্স একবার ঘুরে আসার আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা চলার সময়ে এই পনিরের প্রচারের জন্য জোর উদ্যোগ নেওয়া হতো এবং ১৯৩৩ সাল থেকে ‘ট্যুর দ্য ফ্রান্স’–এর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক হলেন লেওঁ বেল। ১৯৫০ সালের দিকে চলচ্চিত্রে বিজ্ঞাপনের রেওয়াজ শুরু হলে তার সুবিধা নেন তিনি। ১৯৬৮ সালের দিকে টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে সহজেই ভোক্তাদের মনোযোগ কাড়তে সমর্থ হয় বেল শিল্প গ্রুপ। এভাবেই লেওঁ বেল পরিণত হন ফ্রান্সের পনির–রাজ্যের এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী আইকনে। মাখন মাখন আধা নরম পনিরের সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে সে সময় থেকে। আর তাই ১৯২৯ সালে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে প্রথম বিদেশ যাত্রা হয় যুক্তরাজ্যে। এর শাখা–প্রশাখা সেখানেও গজাতে শুরু করে। ইংরেজি ভাষাভাষীদের দেশে গিয়ে ‘যে গরু হাসে’ অনূদিত হয়ে গেল ‘দ্য লাফিং কাউ’ নামে।

রন্ধনশিল্পের অন্যতম অনুষঙ্গ ‘যে গরু হাসে
ছবি : সংগৃহীত

তবে এমন চলার পথ মোটেই নির্বিঘ্ন ছিল না। ‘যে গরু হাসে’ পনিরের সাফল্য দেখে কিছু লোভী উদ্যোক্তা এর অনুকরণে, ‘নীল গরু’, ‘সবুজ গরু’, ‘উৎফুল্ল গরু’ এবং ‘সিরিয়াস (গম্ভীর) গরু’ নাম দিয়ে একই ধরনের পনির বাজারে ছাড়ে। তবে সেসব পনির ভোক্তাদের কাছে তেমন পাত্তা না পেলেও, ‘সিরিয়াস গরু’ সিরিয়াস সমস্যা করেছিল। লেওঁ বেলকে মামলা করে এমন আজব নকলের বিরুদ্ধে পুরো পাঁচ বছর লড়াই করতে হয়েছিল। অবশেষে উচ্চ আদালতের রায়ে ‘গরুর হাসি’র জয় হয়।

১৩৬টি দেশে এই পনির উৎপাদন হয়। বর্তমানে এই ব্র্যান্ডের ৬০০ প্রকার নানা স্বাদের, ঘ্রাণের পনির বাজারে পাওয়া যায়। প্রতি সেকেন্ডে ১২৫টি টুকরা, অর্থাৎ প্রতিদিন এক কোটি টুকরা চালান হয় পনিরপ্রেমীদের উদার উদরে। কোকা–কোলার পরই সমগ্র পৃথিবীতে ‘যে গরু হাসে’, এমন জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।

সেই থেকে শুরু হয় বিশ্বজয়ের দুর্বার যাত্রা। সে যাত্রা আজও গতি হারায়নি। আজ ১৩৬টি দেশে এই পনির উৎপাদন হয়। বর্তমানে এই ব্র্যান্ডের ৬০০ প্রকার নানা স্বাদের, ঘ্রাণের পনির বাজারে পাওয়া যায়। প্রতি সেকেন্ডে ১২৫টি টুকরা, অর্থাৎ প্রতিদিন এক কোটি টুকরা চালান হয় পনিরপ্রেমীদের উদার উদরে। কোকা–কোলার পরই সমগ্র পৃথিবীতে ‘যে গরু হাসে’, এমন জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।

প্যারিস থেকে ৪০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে আর জেনেভা থেকে ১৫০ কিলোমিটার উত্তরে গিয়ে খানিকটা পশ্চিমে ফ্রান্সের সেই ছোট্ট শহর লো-ল্য-সাউনিয়ে আজ পনিরের তীর্থে পরিণত হয়েছে। এখান থেকেই এমন বিস্ময়কর যাত্রা শুরু হয়েছিল যে গরু হাসে নামের বিশ্বখ্যাত পনিরটির। এখানেই ২০০৯ সালে ‘লা মিজো দ্য লা ভাস কি রি’ নামে একটি জাদুঘর স্থাপিত হয়েছে। এ জাদুঘরে সযত্নে সংরক্ষিত হয়েছে সব নিদর্শন। প্রতিবছর দেশ-বিদেশের ৬০ হাজার দর্শনার্থী আসেন এখানে এমন কিংবদন্তি গরুর হাসির বিশ্বজয়ের অসাধারণ এবং অবিশ্বাস্য সাফল্যের বর্ণাঢ্য ইতিহাস জানতে।