গুড়ের কারবারে একবেলা

লম্বা হাতায় নেড়ে নেড়ে চুলায় আখের রস জ্বাল দেওয়া হচ্ছেছবি: লেখক

করোনার জন্য এবার বেড়াতে যাওয়া হয়নি। বেড়াতে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে মনটা। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এলে আর কোথাও যাওয়া হবে না অনেক দিন। এসব ভাবতে ভাবতে মনে হলো আশপাশে কোথাও ঘুরে আসি।

মাড়াই করার আগে নিয়ে আসা হয়েছে আখ
ছবি: লেখক

আমাদের চাঁপাইনবাবগঞ্জে শীত কিছুটা আগেভাগেই নামে। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ, জেঁকে না বসলেও শীত নেমেছে বেশ। সময়টা ঘোরাঘুরির জন্য আদর্শ বলা চলে। এক শুক্রবার ছুটির দিন বুঝে শীত মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সকাল সকাল। উদ্দেশ্য লোকালয় থেকে দূরে কোথাও যাওয়া। শহর থেকে যাত্রা শুরু। প্রায় ১৫ কিলোমিটার যাওয়ার পর পাকা রাস্তা শেষ। অটোরিকশা থেকে নেমে হাঁটা পথ ধরলাম।

আখ চলে যাচ্ছে মাড়াই মেশিনে
ছবি: লেখক

রুক্ষ পথ। গাছের পাতা মলিন। গোড়ালি ডুবানো ধুলা মাড়িয়ে চলতেই থাকি, পথ যেন কিছুতেই ফুরাতে চায় না। বড় মহেশপুর বয়লা বিলে এসে থামলাম। বিলের পানি শুকিয়ে গেছে। সেখানে এখন আবাদি জমি। যত দূর চোখ যায় আখ আর শর্ষের খেত, নৈসর্গিক গ্রামবাংলার সেই চিরচেনা রূপ।

কিছুটা সামনে যেতেই খেতের মধ্যে একখণ্ড ফাঁকা জমিতে চোখে পড়ল গুড় তৈরির কারবার। সেদিকেই এগোতে থাকলাম। আখচাষি আজহার ব্যস্ত খোলা আকাশের নিচে অস্থায়ী গুড়ের কারখানায়। কারখানা বলতে একটা আখ মাড়াইয়ের মেশিন, আখের রস জ্বাল দেওয়ার দুটি বিশাল কড়াই, গোটা ছয় শ্রমিক আর তৈরি শেষে গুড় মজুত রাখার জন্য ছনের তৈরি একটা কুঁড়েঘর।

আখ মাড়াইয়ের পর ছোবড়া আলাদা করা হচ্ছে
ছবি: লেখক

শ্রমিকদের কেউ কেউ আখ মাড়াই করে রস সংগ্রহ করছেন, কেউ আবার সে রস কড়াইয়ে এনে ঢালছেন। রস ঘন হয় গেলে তা ডাইসে রাখা হচ্ছে। গুড় হয়ে গেলে সেটি আরেকজন ঘরে নিয়ে এসে রাখছেন। আখের গুড় তৈরিতে সবাই বেশ কর্মব্যস্ত। রোদের তেজ নেই বলে শ্রমিকেরা ক্লান্তও হচ্ছেন কম। আখের রস থেকে বের হওয়া গাদ আলাদা করা হচ্ছে। আবার রস ঘন হলে তা ডাইসে রাখা হচ্ছে। ঠান্ডা হলে ডাইস থেকে গুড় আলাদা করে রেখা হচ্ছে। এই গুড় যাবে বাজারে।

কথা হয় আখচাষি আজহারের সঙ্গে। আজহাররা বংশপরম্পরায় এই আখের গুড় বানানোর কাজ করেন। বাবার থেকে পাওয়া এই ব্যবসায় তাঁর ছয় বছরের ছোট ছেলেটিও এখানে বাবাকে সাহায্য করে। কথায় কথায় আজহার জানালেন, খুব ভোরে শুরু হয় গুড় তৈরির কাজ। সারা দিনে ৪০০–৫০০ লিটার আখের রস জ্বাল দিয়ে সন্ধ্যা হতে হতে তার গুড় তৈরি হয় দুই থেকে তিন মণ।

আখের রস থেকে বের হওয়া গাদ আলাদা করা হচ্ছে
ছবি: লেখক

এক দিন পরপর স্থানীয় কানসাট বাজারে ২ হাজার ৫০০ টাকায় প্রতি মণ গুড় বিক্রি করেন তিনি। জানতে চাইলাম, ‘আখ চাষের খরচ, ছয়জন শ্রমিক সব মিলিয়ে কেমন লাভ থাকে আপনার?’ হাসিমুখে জানালেন, ‘ভালোই থাকে, এই কারবার দিয়েই তো ছেলেপেলে নিয়ে চলছি।’ তিনি জানালেন, কার্তিক থেকে চৈত্র পর্যন্ত চলে এই আখের গুড় তৈরির কাজ। কথার সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম আজহারের সহজ-সরল তৃপ্তিমাখা মুখ। মনে হলো, ভালোই আছেন তাঁরা।

ডাইসে রাখা হয়েছে আখের তরতাজা গুড়। এই গুড় যাবে বাজারে
ছবি: লেখক

খুব কাছ থেকে আখের গুড় তৈরির কারবারে গিয়ে মনটা ভালো হয়ে গেল। জ্বাল দেওয়া আখের রসের মিষ্টি গন্ধে ম–ম করছে চারদিক। আশপাশের জমিতে সদ্য গজিয়ে ওঠা বিস্তীর্ণ হলুদ শর্ষে ফুলের সারি দেখেও বেশ ভালো লাগল। অনেক দিন পর স্নিগ্ধ কোনো সৌন্দর্যের খুব কাছ থেকে ঘুরে এলাম।