জনপ্রিয় সব মোগল খাবার

তবেই না এতশত ব্যঞ্জন—চর্ব্য, চূষ্য, লেহ্য, পেয়—সবই সৃষ্টি হয়েছে, পরিবেশিত হয়েছে, সমাদৃত হয়েছে। আর আজও টিকে আছে সমানভাবে। পাচ্ছে কদর। আর স্মৃত হচ্ছে অবিকলভাবে।

ছবি খালেদ সরকার

গরম–গরম ধোঁয়া ওঠা কাচ্চি বিরিয়ানি, পাশে এক গ্লাস ঠান্ডা বোরহানি আর সামনে এক বাটি ফিরনি, আহা! ভেবেই বেশ রাজকীয় খাবারদাবারের কথা মনে পড়ে যায়। এই খাবারকে না বলে কার সাধ্য! এভাবেই যুগ যুগ ধরে পৃথিবীব্যাপী মোগল খাবার জয় করে চলেছে ভোজনরসিকদের মন। মোগল সাম্রাজ্য শেষ হওয়ার ২০০ বছর পরে এখনো মোগল নবাবদের শাণদার ইতিহাসের যে বিষয়টি আমরা সবচেয়ে বেশি স্মরণ করি, তা সম্ভবত খাবার। বিশ্বব্যাপী, বিশেষত এশিয়ার দেশগুলোতে বিশেষ জনপ্রিয় হলো মোগল ঘরানার খাবার। তেল-ঝাল-মসলার সংমিশ্রণে মোগল খাবার আসলেই মনে করিয়ে দেয় তাদের রাজকীয় জীবন আর খাদ্যসংস্কৃতি।

ছবি: খালেদ সরকার

তবে মোগল খাবারকে এই অঞ্চলের খাবার বলেই পরিচিত করা হলেও ইতিহাস কিন্তু বলে একদমই অন্য কথা। মোগল খাবারের উৎস আসলে পারস্য বা ইরান। মূলত মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবর দিল্লি সালতানাত প্রতিষ্ঠার পরও ভুলতে পারেননি তাঁর পিতৃপুরুষের ভূমি সমরখন্দকে, তাই উজবেক ও ইন্দো-পার্সিয়ান খাবার রান্নার ধরনের স্পষ্ট ছাপ পাওয়া যায় মোগল খাবারে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় মসলার সংমিশ্রণের পাশাপাশি আরও অনেক দেশি খাবারের প্রভাবে দিন দিন মোগল খাবার পেয়েছে তার আজকের রূপ। মোগল খাবারের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এর ঘ্রাণ। বিভিন্ন গোটা মসলা ও গুঁড়া মসলার সঠিক পরিমাণের মিশ্রণই দিতে পারে এই ঘ্রাণ। তাই মোগল খাবার তৈরির উপকরণের তালিকা হয় বেশ দীর্ঘ। রান্নার প্রতিটি ধাপেই মনে পড়ে নবাবদের স্বর্ণযুগের শৌখিন ভূরিভোজের গল্প।

হলুদ-মরিচ-জিরা তো আছেই, সঙ্গে আদা, পেঁয়াজ ইত্যাদির বাইরেও গরমমসলা, ধনিয়া, কাবাব চিনি, এলাচি-দারুচিনি-তেজপাতা অসংখ্য মসলা ব্যবহার করা হয় মোগল খাবার তৈরিতে। তবে মোগল খাবারে খুব সচেতনভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয় রসুনের ব্যবহার এবং এই রীতি এখনো আছে বর্তমান। মোগল খাবারকে আরও বেশি রাজকীয় রূপ দেয় যে মসলা তা হলো জাফরান। প্রচণ্ড দামি ও ঐতিহ্যবাহী এই উপকরণ স্বাদ ও রং—উভয় আনে অসাধারণভাবে। আর স্বাস্থ্যকরও।

ব্যবহার হতো নানা ধরণের মসলা
ছবি: উইকিপিডিয়া

মোগল খাবারের আরেকটি মজার ব্যাপার হলো, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সম্রাটদের রুচির প্রভাব ও তাঁদের সম্রাজ্ঞীদের জন্মস্থানের রসনা ঘরানার স্পষ্ট প্রভাব। যেমন হুমায়ুনপত্নী হামিদার হাত ধরেই মোগল রসুইঘরে প্রবেশ করে জাফরান ও শুকনা ফল। আবার হুমায়ুনের শরবতের শখের জন্যই মোগল খাবারের সঙ্গে ফলের রস ও তা ঠান্ডা করতে বরফের ব্যবহার শুরু হয়।

আমকে বিশেষভাবে পরিচিত করে তুলেছে মোগলরাই
ছবি: উইকিপিডিয়া

এ ধারা অব্যাহত থেকে এরপরেও। ধারণা করা হয়, মোগল খাবারে জিরা ও ধনিয়ার ব্যবহার শুরু হয় শাহজাহানের সময় থেকে। এ ছাড়া এই অঞ্চলে আমকে বিশেষভাবে পরিচিত করে তুলেছে মোগলরাই। সম্রাটদের প্রিয় ফল হওয়ার বদৌলতেই এই অঞ্চলে বেড়েছিল আমের চাষ, যা কালক্রমে হয়ে উঠেছে জনপ্রিয়। এমনকি এই ধারাবাহিকতাতেই ভারত ও পাকিস্তান—এই দুই দেশেরই জাতীয় ফল আম, আর বাংলাদেশের জনপ্রিয়তা তো আমরা সবাই জানি। আম আমাদের জাতীয় ফল না হলেও আমগাছ কিন্তু জাতীয় গাছ। যেহেতু মোগল শাসকেরা প্রায় সবাই ছিলেন মুসলিম এবং তাঁদের স্ত্রীরাও ছিলেন মূলত মুসলিম। তবে হিন্দুও ছিলেন। তাই মোগল খাবারে গরুর মাংস এক প্রকার বাদই গেছে। এখন আমরা মোগল খাবারের অংশ হিসেবে যেসব গরুর কাবাব বা বিরিয়ানি খাই, তা মূলত মোগল ঘরানায় তৈরি হলেও মোগল ঐতিহ্যের সরাসরি অংশ নয়।

তাহলে প্রশ্ন আসে, মোগল খাবার আসলে কোনগুলো? এবার সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে।

মোগল খাবারের তালিকা

মোগল খাবার বললেই মাথায় আসে বিরিয়ানি। এক বিরিয়ানিতেই আছে এত এত রকমফের যে চমকৃত হতেই হয়। কাচ্চি, হায়দ্রাবাদি, লক্ষ্ণৌই বিরিয়ানির পাশাপাশি আছে সাদা পোলাও, কিমা পোলাও, মটর পোলাও, মোরগ পোলাওসহ আরও কত কী! পরোটার মধ্যেও দেখা যায় হাজার রকম, হাজার স্বাদ। সাদা পরোটা থেকে পনির বা কিমা পরোটা এবং সবার চেয়ে জনপ্রিয় মোগলাই পরোটা মোগলদের আবিষ্কার। কথিত আছে, মোগল সম্রাটদের খাবারের পরে হাত মোছার জন্য রুমাল হিসেবে ব্যবহৃত হতো আমাদের আজকের জনপ্রিয় রুমালি রুটি।

কাবাব ও মুর্গ মুসাল্লাম
ছবি: উইকিপিডিয়া

এবার আসা যাক কাবাবের কথায়। কাবাব যদিও মধ্যপ্রাচ্যের খাবার, তবে কাবাবের সবচেয়ে জনপ্রিয় রূপগুলো মোগল রসুই থেকেই এসেছে। আর পেয়েছে বিশ্বব্যাপী সমাদর। কাকরি, চাপলি, শিশ, শিক, সুতি, রেশমি, বিহারি, শামি আর তুনরি কাবাবের ধরন আসলে বলে শেষ করার মতো নয়। এর পাশাপাশি রোস্ট, রেজালা আর নিহারি তো আছেই। এ ছাড়া কোরমা, মোরগ মোসাল্লাম, ডাল মাখানি, আলু গোশত, তান্দুরি, টিক্কা, কোফতা, কোরমা—প্রিয় যে খাবারেরই নাম বলবেন, তার অধিকাংশই আসলে মোগল খাবারেরই অংশ। সমুচার মতো হালকা জলখাবারের সঙ্গেও এই অঞ্চলের মানুষকে পরিচিত করেছেন মোগল শাসকেরাই।

মোগলরা মূলত তাদের রন্ধনশৈলী দিয়ে সাধারণ খাবারেও এনেছে অসাধারণ বৈচিত্র্য। কথিত আছে, সম্রাট শাহজাহানকে যখন আগ্রা মহলে বন্দী করে রাখেন তাঁরই পুত্র আওরঙ্গজেব, তখন তাঁকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত খাওয়ার জন্য একটি খাবারের নাম বলতে বলা হলে তিনি বলেন মটর ডাল। তাহলেই ভেবে দেখুন, সাধারণ মটর দিয়ে মোগলরা কত স্বাদের ও বাহারের খাবার তৈরি করতে পারে যে বাদশাহ তাঁর শেষজীবনের জন্য বেছে নেন সামান্য মটর ডাল। আবার ধরুন, খিচুড়ির মতো সাধারণ খাবার বা হালিমের মতো নাশতা—সবই সেই মোগলদের সৃষ্টি, বয়ে চলেছে তাদেরই ঐতিহ্য।

ফালুদা
ছবি: উইকিপিডিয়া

এবার আসা যাক মিষ্টিতে। মোগলদের মতো মিষ্টি নিয়ে শৌখিনতার জুড়ি মেলা ভার। ফিরনি, ফালুদা, হালুয়া, জিলাপি, গোলাপজাম, কুলফি, ফিরনি, শাহি টুকরা—লোভনীয় সব মিষ্টি খাবার একের পর এক এসেছে মোগলদের থেকে। নানা রকম বাদাম, কিসমিস, ফল, খেজুরের মতো উপকরণের ব্যবহারে এসব মিষ্টি পায় আলাদা স্বাদ, আলাদা বৈচিত্র্য।

এসব খাবারের উল্লেখ পাওয়া যায় পৃথিবী বিখ্যাত খাবারের বই ‘নিমাতনামা’তেও। আর তাই এত বছর পরও এসব মোগল খাবার সমান জনপ্রিয়তায় টিকে আছে। ফুরিয়ে যাওয়া ইতিহাসের জৌলুশময় সেই সব দিনের সাক্ষী হয়ে আজও তৃপ্ত করে চলেছে রসনাবিলাসী মানুষকে।

লেখক: ছাত্রী, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়