টুকরো ও কোটার পদ্ধতি

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রীছবি: মো: মাছুদুর রহমান
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
ছবি: প্রথম আলো

কবি বুদ্ধদেব বসুর ওই খেদোক্তির সঙ্গে আমারও সহমত, ‘যে স্বর্গে ইলিশ মাছের বর্ণনা নেই, সেই স্বর্গে আমি যাই না!’ ইলিশ মাছ নিয়ে আমার যে পরিমাণে বাড়াবাড়ি আছে, তা স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা নেই। সেটাকে এক ধরনের গবেষণাও বলা যেত পারে। নতুন কিছু করা গেলে বাহবা, ব্যর্থ হলে শূন্য প্রাপ্তি, মানে মগজ ও সময় দুটোই মাটি। ইতিমধ্যে ইলিশ নিয়ে একটা কাজ এতটাই নতুন করেছি যে, বোধকরি সমগ্র বাঙালি ইতিহাসে প্রথম। বেহুদা আত্মপ্রচার মনে হলে সে বিষয়টা এখানেই থাক।

তবে প্রসঙ্গ সুযোগে একটা কথা বলে নিই-হাইব্রিড বা আধুনিক চাষের নামে আমাদের মাগুর, পাঙাশ, রুই-কাতলা, পাবদা, কৈ, পুঁটি, তেলাপিয়া এইসব মাছের জাত-ইজ্জত এরই মধ্যে সর্বস্ব খোয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট সরকারি এবং গবেষক মহলের কাছে বিনীত নিবেদন, মাছের এই মানবসৃষ্ট মহামারির মধ্যে ইলিশকে যেন নিরীক্ষার অসহায় করা না হয়।

শুনেছি, দ্রুত বৃদ্ধির কৌশলসহ পুকুরে ইলিশ চাষের নানা ‘চেষ্টা’ চলছে। ইলিশের এই বেইজ্জতি বাঙালি দেখতে চায় না। নিজের পায়ে নিজেরই এই কুড়োলটা হানা হবে বড়ই অপরিণামদর্শিতা। এই লেখাটার মূল প্রতিপাদ্য হলো, ইলিশ মাছের টুকরা এবং লোকবাংলার খাদ্যসাহিত্যে সেই বিভিন্ন টুকরার আলাদা আলাদা সব নাম। এবং গভীর ভাবনায় সেসব নামকরণের মধ্যে আশ্চর্য রকমভাবে শরীরতাত্ত্বিক বা বায়োলজির জ্যামিতি-সমর্থন।

মাছের টুকরা বানানোর বাঙালির আদিকথন হলো ‘মাছ কোটা’। আর এই মাছ কোটার আদি গার্হস্থ্য অস্ত্র হলো বঁটি। এবং সে বঁটি আজকের বঁটির মতো কেবলই ইস্পাত দিয়ে গড়া ফেলনা আকৃতির খেলনা নয়। সে বঁটির গ্রামীণ আভিজাত্যই আলাদা। বড় কাঠের বটেনির মাথায় লোহার খিল দিয়ে আঁটা খাঁড়ার মতো বিশাল বটি। বটেনির শেষ প্রান্ত অনেকটা পিঁড়ের মতো। তার ওপর গৃহিণী পুরোপুরি বসে ইলিশের আঁশ ছাড়িয়ে তারপর তাকে টুকরা করার ক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, বাঙালির লোকবিজ্ঞানে বঁটি যত ধারালো হবে, মাছ কোটা হবে তত নিখুঁত। তাতে মাছ থেঁতলে যায় না। ধোয়া, মসলা মাখানো, রান্না করায় বিশেষ সুবিধা। তাই যেমন দেখনাই, তেমনই সুস্বাদু। সুযোগে বলে দিই, ইলিশই একমাত্র মাছ, যার পিত্ত বাদে সবই খাওয়া যায়। এই কথায় বিতর্ক আসতে পারে যে, ধ্যাত, এ আবার কী কথা! এ কথা দায়িত্ব আর অভিজ্ঞতা নিয়েই বলা। কিন্তু সেই বিতর্ক নিরসনের বচসা এটা নয়। অতএব, সে কথাও না-বলা থাকল। সাইজ বা আকারভেদে কয়েক রকমভাবে কোটা হয় ইলিশ মাছ। এক সময় তো বিয়ের কনের জন্য কমন প্রশ্ন ছিল, সে ইলিশ মাছ কুটতে জানে কি না। এও এখানে প্রাসঙ্গিক অপ্রসঙ্গ, অতএব সে বিষয়টি বলার ক্ষেত্রে এখানে অনেকটাই মানা আছে।

ছবি: প্রথম আালো

ইলিশ মাছ কোটা

বঁটিতে ফেলে কোটার সময় ইলিশ যেন হাত থেকে পিছল খেয়ে ফসকে না যায়, সে জন্য মাছের গায়ে এবং কোটনদারের হাতে খড়ির ছাই লাগানোর রেওয়াজ ছিল। লেজের দিক থেকে মাথার দিকে বঁটিতে ঠেলে ঠেলে তার আঁশ ছাড়ানোটা একেবারে দেখার মতো শিল্পচর্চা বলা যেতে পারে। যে কথা বলছিলাম, ছোট-মাঝারি-বড়—আকৃতি অনুসারে ইলিশ মাছ কয়েকভাবে কোটা হয় এবং নানা ভিন্নতায় তার টুকরা করা হয়। মাছের দেহ এবং অঙ্গের সঙ্গে মিল রেখে তার গ্রাম্যবৈজ্ঞানিক নাম শুনলে পরে বিস্ময় না মেনে পারা মুশকিল। রান্নারও ধরন আছে অনেক এবং মনকাড়া। এ অবশ্যি রেসিপির হিসেব। এবার তাহলে কুটতে বসা যাক—

সাধারণ কোটা

ইলিশের মাথা
ছবি: উইকিপিডিয়া

সাধারণ কোটা হলো আটপৌরে বা দৈনন্দিন সহজ কোটা। আঁশ ছাড়ানোর পর দেহ থেকে মাথা আর লেজ একেবারে ঘ্যাঁচ করে কেটে ফেলা। এখন হাতে যে ধড় বা দেহটা থাকল, তার ওপরের বা পিঠের দিককার টুকরাগুলোকে বলে গাদা, আর নিচের বা পেটের দিককার অংশ থেকে যে টুকরোগুলো হয়, তার নাম পেটি। পেটিতে মেদের পরিমাণ বেশি, কাঁটার পরিমাণ কম। গাদায় তেলের ভাগটা পেটির তুলনায় অনেক কম, কাঁটার পরিমাণ বেশি। পক্ষান্তরে পেটি ভরাট নয়, গাদা ভরাট।

এই ধড়ের নিচের অংশে থাকে পেট। এই পেটকে অনেকে জায়গায় কোল বলে। আগে সেখান থেকে নাড়িভুঁড়ি বা রুয়ো এবং ডিম (যদি থাকে) বের করে নিয়ে তারপর তাকে পাতালি-লম্বা করে দীর্ঘ দুটো টুকরা করে তাকে আবার ছোট ছোট টুকরা করা হয়। বলা তো হয়েইছে, ওপরের অংশের টুকরা গাদা, নিচের অংশের টুকরা পেটি। পেটি আর গাদা আলাদা কোটাকে অনেক জায়গায় ঝুড়াকাটাও বলে।

ঘাড়ের দিকে মাথার নিচ থেকে একটু টুকরো বেরোয়, সে আসলে মাছের কাঁধ বা ঘাড় বলে এর নাম ‘ঘাইড়ে’। ঘাইড়ে হচ্ছে সবচেয়ে কাঁটাবহুল অংশ। স্বভাবত এটিকে মাছের সঙ্গে রান্না না করে কচুশাক বা অন্য কোনো ঘণ্টো জাতীয় সবজির সঙ্গে রেঁধে ভেঙে মিশিয়ে দেওয়া হয়। মাছ বড় আকৃতির হলে মাথাটাকে আড়াআড়ি কেটে দুই টুকরো করা হয়, আর ছোট হলে মাথাটাকে আস্ত রাখা হয়। একে বলা হয় মুড়ো। লেজের অংশ থেকে এক টুকরো মাছ বের করা হয়। ইলিশদেহের এই অংশ বেশ একহারা স্লিম বলে এই টুকরার সঙ্গে পিঠ-পেট বা গাদা-পেটি অখণ্ড রাখা হয়। তাই এর নাম গাদাও না, পেটিও না, বরং এক ছাওয়া। এই নামকে পদার্থবিদ্যা আর জ্যামিতির স্বীকৃতি দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। এখন যে থাকল লেজ, তার যে টুকরা, তাকে বলে পিছে। কোনো কোনো গ্রাম্য অঞ্চলে তাকে ‘ল্যাজা’ও বলা হয় বটে। পেটের ভেতর থেকে বেরোয় যে নাড়িভুঁড়ি তাকে বলে রুয়ো, যা আসলে পরিপাকতন্ত্র। এখান থেকে শুধু পিত্তটুকু (তেতো বলে) ফেলে দেওয়া হয়। আর ডিম, দুই অংশ জোড়া লাগানো। অনেকটা একটা খোলা বইয়ের মতো।

একছাওয়া কোটা

একছাওয়া কাটা বা পুস্তাকাটা ইলিশের টুকরো
ছবি: খালেদ সরকার

ইলিশের আকৃতি যদি খুব ছোট হয়, মানে জাটকার চেয়ে সামান্য বড়। তখন তাকে আর গাদা-পেটি আকারে কোটা হয় না। বরং পুরো মাছকে একছাওয়া বা গাদা-পেটি অখণ্ড রেখে কোটা হয়। এই কিসিমের কোটা পুরো মাছের সবগুলো টুকরা একছাওয়া হয় বলে এই পদ্ধতির কোটার নামই রাখা হয়েছে ‘একছাওয়া কাটা’। বলাই বাহুল্য, এই ধরনের কোটায় মাছের মাথাটি দুই ফালি না করে আস্তই রাখা হয়। একছাওয়া কাটা কেবল ছোট মাছ নয়, বড় মাছেও হয়। গাদা আর পেটি আলাদা করা হয় না। এই ধরনের কাটাকে কোথাও কোথাও পুস্তাকাটা বলা হয়।

তেরছা কোটা

বাঙালির মৎস্যসাহিত্য অনেক সমৃদ্ধ। সাধে কি আর বলে, ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’! বিশেষত ইলিশ মাছকে তেরছা কোটা করে টুকরা করার মধ্যে আশ্চর্য বুদ্ধিমত্তা এবং লোকবিজ্ঞানসমৃদ্ধ জ্যামিতিবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। কেননা, একই আকারের মাছকে ‘সাধারণ কোটা’ বা ‘আটপৌরে কোটা’ করে কুটলে তার টুকরোগুলো যত বড় বড় হবে, ‘তেরছা কোটা’ করে কুটলে সেই তারই টুকরোগুলো হবে বেশ খানিকটা বড় বড়! জ্যামিতির স্বাভাবিক নিয়মেই কলমকাটা বা একটু বাঁকা করে কাটলে তার ডায়া হয় সোজাসুজি কাটার ডায়ার চাইতে বড় বা বিস্তীর্ণ। ফলে মাছের টুকরোর আকৃতিটা বেশ বড় হয়ে যায়। কোনো কারণে বা অতিথি আপ্যায়নে পছন্দসই বড় মাছ পাওয়া না গেলে ইলিশের টুকরোকে এভাবে বৃহদাকার করা হয়। খুব সংগত কারণেই ধরে নেওয়া যায় যে এই বিজ্ঞানবোধটি এসেছে বাঙালি গ্রামীণ নারীর মাথা থেকে। কারণ সংসারে শতভাগ রান্নাবাড়ার কাজ তো তাঁকেই করে আসতে হচ্ছে শত শত বছর ধরে। এই পদ্ধতিতে কুটলে তার ভেতর মসলাপাতি ঢোকার তারতম্য হয় বলে সাধারণ কোটার তুলনায় এই কোটার মাছের স্বাদেও কিছুটা তারতম্য ঘটে।

চাক কোটা

‘চাককোটা’ নামকরণের মধ্যেও বেশ একটা বোধের বহিঃপ্রকাশ লক্ষণীয়। ‘চাক’ মানেও আসলে কাটা বা কোটা। আবার গোল গোল চাকার মতো করে কাটলে তাকে চাক বলে। যেমন বেগুনের চাক ভাজি। তো ইলিশ মাছ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তাকে নুনের মমি করে রাখার যে বিজ্ঞান, তা কিন্তু বাঙালির হাজার বছরের সংরক্ষণ-জ্ঞান। প্রসঙ্গত, শুঁটকি মাছের প্রক্রিয়াকরণের লোকজ্ঞানের কথাটিও এখানে উল্লেখযোগ্য। লবণ দিয়ে আস্ত ইলিশ মাছকে অপচনীয় করে মাসের পর মাস সংরক্ষণের জন্য পিঠের দিকে সংযুক্ত রেখে আস্ত ইলিশকে পেটির দিক থেকে চাক চাক করে কাটা হয়। এই কাটাকে আইলচা কাটাও বলে। এভাবে কেটে তার নাড়িভুঁড়ি ফেলে দিয়ে বেশি পরিমাণে লবণ মাখিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে ইলিশের সংরক্ষণ বাঙালির বহুকালের জ্ঞান। ছত্রাক এবং পোকা নিরোধের নিশ্চয়তা বিধানের বিষয়টিকে অধিক নিশ্চিত করতে এই লবণের সঙ্গে পরিমিত পরিমাণে গুঁড়া হলুদ মেশানো হয়। নোনা ইলিশকেও সব সময় তেরসা পদ্ধতিতে কোটা হয়। একই সঙ্গে তাতে নুন-হলুদ যেন ভালোভাবে কার্যকর হতে পারে, সে জন্য চাকগুলোকে বেশ খানিকটা পাতলা পাতলা করে কোটা হয়। চাকগুলোর খাঁজে খাঁজে লবণ-হলুদ ঢুকিয়ে দেওয়া হয় বলে কোনো কোনো অঞ্চলে এই ‘চাক কোটা’কে ‘খাঁজ কোটা’ বলার চল আছে।

না-কোটা

ছবি: প্রথম আলো

না-কোটা পদ্ধতিটি হলো প্রায় না-কাটা বা ইলিশ মাছটিকে আস্ত রেখে রান্না করা। বড় ইলিশের ‘কোপ্তা’ বলতে যা বোঝায়, এটা তা নয়। আসলে সে খুব ছোট আকারের বা যাকে বলে ‘জাটকা’, সেগুলো আস্ত রেখে ভাজা হয় বা ঘন মাখোমাখো ঝোলে ঝোলা করে রান্না করা হয়। তো এই মাছের তো কোনো টুকরা করার প্রশ্ন নেই। তাই আলগোছে তার আঁশ ছাড়িয়ে পেটের দিকটায় সামান্য কেটে টিবি বা ঠাসা দিয়ে নাড়িভুঁড়ি বের করে ফেলা হয়। সঙ্গে দুই চোয়ালের ঢাকনা অংশটুকু কেটে ফেলে দেওয়া হয়। এই হচ্ছে খুব ছোট ইলিশের না-কোটার কোটা। এই ধরনের ছোট ইলিশ বা এর চেয়ে সামান্য বড় ইলিশকে কুষ্টিয়ার দিকে ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে আসা নাগরিকেরা ‘খোকা ইলিশ’ বলে আদুরে নামে ডেকে থাকেন।

থেঁতলা কোটা

ইলিশের যে ‘থেঁতলা কোটা’ তাকে ঠিক কোটা বলা চলে না। আধাপচা বা পুরো পচা ইলিশের ঝুরিভাজা রান্না বাঙালি লোকখাদ্যের একটি উল্লেখযোগ্য পদ। পচা বিধায় কোনো রকমে কেটে ধুয়ে টুকরো টুকরো করে বেশি করে পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচা মরিচ ও হলুদ-তেল সহযোগে এই ঝুরি ভাজা রান্না করা হয়। কিছুটা ঝলসে গেলে খুন্তি বা নাকুড়ের গুঁতোয় মাছগুলোকে ভেঙেচুরে ভর্তার মতো করে দেওয়া হয়। তেলে ভাজার চূড়ান্ত পর্যায়ে নিতে হয় বলে এই রান্নায় মাছগুলোকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একনাগাড়ে নাড়তে হয়। এর ফলে তা আরও তুষতুষ হয়ে যায়। তাকে মাছের ‘কিমা’ও বলা চলে। শেষ পর্যন্ত গুঁড়া গুঁড়া হয়ে মাছের কাঁটা সব চানাচুরের মতো মটমটে মচমচে মুখরোচকে পরিণত হয়। পচা মাছ এত সুস্বাদু, এ বোধ হয় ইলিশ ছাড়া অন্য কোনো মাছের বেলায় খাটে না! বাঙালির ইলিশবোধ আশ্চর্যই বলতে হবে!

জ্বাল দেওয়া ইলিশ

জ্বাল দেওয়া ইলিশ হচ্ছে রান্নার অর্ধেক শেষ করে কয়েক দিনের জন্য সেই মাছ সংরক্ষণ করা। অনেকে শখবশতও কেবল জ্বাল দেওয়া ইলিশ খাওয়ার জন্য ওই আধাপ্রসেস করেন। বেশি করে কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ, লবণ দিয়ে সামান্য হলুদ সহযোগে এ কেবল সেদ্ধ ইলিশ। এতে কোনো রকম সবজি-তরকারি দেওয়া হয় না। যখন চূড়ান্ত রান্নায় চড়ানো হয়, তখন ইচ্ছেমতো আলু-বেগুন-কচু প্রভৃতি দেওয়া হয়। জ্বাল দেওয়ার জন্য যে ইলিশ, তাকেও স্বভাবত একটু পাতলা ফালি করে কোটা হয়। জ্বাল দেওয়া ইলিশ স্বাদে অপূর্ব। ঈষৎ নুনবাড়তি-নুনবাড়তি ঝোলা-পেঁয়াজি। এ ক্ষেত্রে যদি ইলিশের টুকরা মোটা হয়, তাহলে জ্বাল-উত্তর স্বাদ এবং চূড়ান্ত রান্না-পূর্ব সংরক্ষণ ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। জীবন-অভিজ্ঞতা থেকে বাঙালির এইসব লোকখাদ্যবিষয়ক জ্ঞান সঞ্চিত হয়েছে বটে।

শোলে কোটা

ছোট ইলিশকে জাটকা বা খোকা ইলিশ বলা হয়
ছবি: প্রথম আলো

শোলে কোটা কী এবং ইলিশকে শোলে কোটা, সেটাই বা কেন! শোল তো নিজেও একটা মাছ। সে আমলে পাকা বা বড় সাইজের শোল, গজার—এই জাতীয় মাছ খাওয়ার চল ছিল। শোল মাছের মাংসে আঁশগুলো শক্ত-মজবুত। তাই রান্নায় সেদ্ধ করার সুবিধার জন্য ওই মাছের টুকরোগুলোকে বেশ কচুকাটা ধরনের ছোট ছোট করা হতো। এবং সব সময় শোল মাছকে মাংসের প্রিপারেশনে রান্না করা হতো। অর্থাৎ ‘শোলে কোটা’ হলো স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ ছোট ছোট টুকরা করে কাটা।

তো ইলিশ মাছকে দুটি কারণে শোলে কোটা বা ছোট ছোট টুকরা করে কাটা হতো। প্রথম কারণ হলো, ইলিশ যদি স্বাভাবিক বড়র চেয়ে আরও বড় হয়, তখন তার গাদা এবং পেটির আকারগুলো হয় অস্বাভাবিক ধরনের বড় এবং মোটা। তখন ওই মাছটাকে শোলে কোটা কুটলে ১০ টুকরোর জায়গায় কমপক্ষে ২০ বা তার চেয়ে বেশি হলো মাথাপিছু বরাদ্দের পরিমাণটা পুষিয়ে যেত। আর দ্বিতীয় কারণ হলো, ইলিশটা তত বড় নয়, কিন্তু তা দিয়ে পুষিয়ে আপ্যায়ন করতে হবে অধিকসংখ্যক লোককে। তখন টুকরোর সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ইলিশকে শোলে কোটা করা হতো। এ কৌশলও বাঙালি নারীদেরই আবিষ্কার মানতে হবে। শোলে কোটায় মাছের টুকরোর আকার ছোট ছোট হওয়ায় তাতে মসলার প্রবেশ এবং মাখামাখিটা বেশ জমাটি হয় বলে মাছের স্বাদও বাড়ে।

বিবিধ

ইলিশ মাছের বিভিন্ন অংশের ও ধরনের টুকরোর নাম তো বলা হয়েছে। যেমন মাথা, ঘাইড়ে, গাদা, পেটি, একছাওয়া এবং পিছে বা লেজা। ডিম এবং নাড়িভুঁড়ির কথাও বাদ পড়েনি। তবে বাদ পড়েছে ফুলকার কথা। ফুলকা হচ্ছে ইলিশের দুই চোয়ালের নিচে নরম শজারুর কাঁটার মতো। দেখতে লাল ফুলের মতো বলেই বুঝি এর নাম ফুলকা। এ রকমও শোনা যায় যে ইলিশ এ দিয়ে তার শ্রবণের বা কানের কাজ করিয়ে নেয় বলে এর আরেক নাম ‘কানকো’। কোনো কোনো এলাকার মানুষ একে বলে ‘চোপড়া’। সাঁতার কাটার জন্য এর লেজের সঙ্গে থাকে হাল, পিঠে, বুকেও থাকে দাঁড়ের মতো। এগুলোর নাম কী জানি না। আর ওর সারা গায়ে যে রুপার সিকির মতো অসংখ্য চাকতি, ওগুলোর নাম আঁশ। কেউ বলে চোঁচা। কোনো এলাকার লোকেরা বলে চলটা।

এই চলটা বা আঁশ বা চোঁচা চূড়ান্তভাবেই ইলিশের ফেলনা অংশ। বাংলা সাহিত্যে বা বাঙালি জগতে কোথাও এর খাওয়ার বা ব্যবহারিক কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। আমার এ-সংক্রান্ত গবেষণা ধরনের পাগলামিতে এই আঁশকে মসলাসহযোগে ভাসা তেলে ভেজে চানাচুরের মতো করে খেয়ে দেখেছি, অপূর্ব সুস্বাদ। তেলে ছাড়লে মচমচে হওয়ার মুহূর্তে ওগুলো মুড়িয়ে গিয়ে চিকন চালের মতো হয়ে যায়। তার ভেতরে লেজ-পিঠ ও পেটের ওই পাখনা বা দাঁড়, হালগুলো দেওয়া হয়েছিল। মচমচে চানাচুরের মতো তার স্বাদও সত্যিই অপূর্ব। তাহলে এই সিদ্ধান্তে আসা যায়, ইলিশ মাছের কিছুই ফেলনা নয়। জানা মতে, শুধু বাকি থাকল তার পিত্ত। সেটা তেতোর একশা। এখন পর্যন্ত সেটা অখাদ্যই বটে। সব মিলিয়ে আমার কাছে মনে হয়, ইলিশ মাছ রাজা নয়, বরং রানি। তাই আমার বিবেচনায় সে প্রিয়তমেষু নয়, বরং প্রিয়তমাসু।