তিন তরুণের কেক-ক্র্যাফট

আমুদে বাঙালির উৎসব তো বাহানামাত্র। আর বিশেষ দিনের আড়মোড়াটা যদি হয় কেকের ম–ম ঘ্রাণের সঙ্গে, তাহলে তো কথাই নেই।

উপলক্ষ কিংবা প্রয়োজনে কেক যেন এক টুকরো ভালোবাসা। এবারের ঈদে ঘরোয়া নাশতা কী হবে, তা নিয়ে নগরবাসী যে বেশ ব্যস্ত, তা বলাই বাহুল্য। এই সময়েই দেখা মিলল তিন তরুণ উদ্যোক্তার—যোয়া আহমেদ, বুশরা আমিন তাকওয়া ও নাজিফা আনজুমের। তাঁরা পরিচিত তাঁদের সুস্বাদু ও সুন্দর কেকের জন্য। তিনজনের ব্র্যান্ডগুলো হলো সো বেকড, কেকাহোলিক ও কেক টু বেক।

ছবি: সো বেকড

সো বেকডের প্রতিষ্ঠাতা যোয়া আহমেদ বর্তমানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ওয়েবএবল ডিজিটালে কর্মরত। নিজের আলাদা পরিচিতির স্বপ্ন দেখেন তিনি। এই লক্ষ্যে যোয়া আহমেদ এবং তাঁর বোন আমেনা আহমেদ মিলে শুরু করেন সো বেকড। যোয়া জানান, ২০২০ সালে কোভিড সংক্রমণের কারণে বাড়িতে অলস সময় কাটানোর পরিবর্তে তাঁরা দুই বোন কেক তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। মূলত সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেকের তৈরি খাবারের ছবি কিংবা রেসিপি শেয়ার করতে দেখে তাঁরাও উৎসাহী হয়ে শুরু করে দেন কেক তৈরির প্রক্রিয়া। পরবর্তী সময়ে দুজনের সঙ্গে একজন ডেলিভারি পারসন ও একজন সহযোগীর মিলিত প্রচেষ্টায় রূপ পায় সো বেকড।

বোন আমেনা আহমেদের সঙ্গে যোয়া আহমেদ
ছবি: সো বেকড

একলেয়ার্স থেকে শুরু করে পাউন্ড কেক, ম্যাঙ্গো পাই, বানোফি পাই, টার্টস তো আছেই, এ ছাড়া বিভিন্ন উপলক্ষ, যেমন জন্মদিন, মা দিবস কিংবা ঈদে কেক ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের কুকিজের অর্ডার নিয়ে থাকে সো বেকড। সাধারণত কেক ও কুকিজের ধরন কিংবা কাস্টমাইজেশন অনুযায়ী সেগুলোর দাম নির্ধারিত হয়ে থাকে। বর্তমানে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বেশি হওয়ায় খুব সাবধানতা অবলম্বন করেই অর্ডার নেওয়া ও প্রোডাক্ট ডেলিভারি করা হচ্ছে। আর সে ক্ষেত্রে সো বেকডকে পাওয়া যাবে এর ফেসবুক পেজে (https://www.facebook.com/so.baked.2020)। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে অনলাইনের পাশাপাশি অফলাইনে, অর্থাৎ আউটলেটের মাধ্যমেও এই উদ্যোগকে এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন তাঁরা।

ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী বুশরা আমিন তাকওয়া। ছোটবেলা থেকেই রকমারি খাবার তৈরির প্রতি তাঁর বিশেষ ঝোঁক ছিল। সেই ইচ্ছা থেকেই ‘এ’ লেভেল পরীক্ষার্থী ভাই রেদওয়ান উল আমিনকে নিয়ে ‘কেকাহোলিক’ প্রতিষ্ঠা করেন। তাকওয়া জানান, তাঁর মেজো খালাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে একবার নিজের জন্মদিনের কেক তৈরি করে বেশ প্রশংসা পেয়েছিলেন। এরপর থেকেই ইউটিউবে রেসিপি দেখে কিংবা পিন্টারেস্টের সাহায্য নিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের কেক তৈরি করে পরিবার, আত্মীয় কিংবা বন্ধুবান্ধবদের জন্মদিনের উপহার দিতেন। পরবর্তী সময়ে ২০২০ সালের মার্চ মাসে ভাইয়ের উৎসাহে ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডল (https://instagram.com/_cakeaholic?igshid=hc2uh9s4d5kd) খোলার মাধ্যমে কেকাহোলিকের যাত্রা শুরু।

ছবি: কেকাহোলিক

প্রথম দিকে এ পেজে তাঁরা নিজেদের কিংবা পরিচিতজনের কেক এবং আনন্দের মুহূর্ত শেয়ার করতেন। পরবর্তী সময়ে এর মাধ্যমে অন্যরাও কেকাহোলিকের কেক কিনতে আগ্রহী হন। তাকওয়া জানান, ২০২০ সালের জুলাই মাসে প্রথম একজন অপরিচিত ক্রেতা এ পেজ থেকে কেক অর্ডার করেন। এরপর থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ধীরে ধীরে নিজস্ব ফেসবুক পেজের (https://m.facebook.com/cakeaholic20/?_rdr) মাধ্যমে অর্ডারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এখানে সব ধরনের কেক চুলায় তৈরি করা হয়ে থাকে এবং সাধারণত ৬০০ গ্রাম ওজনের কেক থেকে শুরু করে ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের কাস্টমাইজড কেকেরও অর্ডার নেওয়া হয়। চকলেট, ভ্যানিলা, রেড ভেলভেট, ব্লু-বেরি ও বাটার স্কচ—এ পাঁচ ধরনের রেগুলার কেক তৈরি করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া আছে বিশেষ চার ধরনের কেক: রেড ভেলভেট, ওরিও, তিরামিসু ও ব্লু-বেরি মুজ। আবার অনেক সময় ক্রেতার অনুরোধে অন্যান্য ফ্লেভারের কাস্টমাইজড কেক তৈরি করা হয়। তা ছাড়া কাপ কেক ও পিনাটা কেকেরও বেশ চাহিদা রয়েছে বলে জানা গেল।

রেদওয়ান ও বুশরা
ছবি: কেকাহোলিক

তবে ব্রাউনি ও ডোনাট এখন পর্যন্ত অফিশিয়ালি লঞ্চ না করলেও আগামী দিনে এর অর্ডার নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। কেকের দাম নির্ভর করে সাইজ এবং কাস্টমাইজেশনের ওপর। এখন পর্যন্ত চকলেট ওভারলোডেড কেক সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া এডিবল ফটো প্রিন্ট কেক ও বিভিন্ন থিম বেজড কেকের বেশ চাহিদা রয়েছে। আগামী দিনে নিজেদের আউটলেট প্রতিষ্ঠার আশাও রয়েছে তাঁদের। তাকওয়ার মতে, কেক ডেলিভারির সময় বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন প্রয়োজন। এই দায়িত্ব তাঁদের ডেলিভারি পারসন খুব যত্নসহকারে ও দ্রুততার সঙ্গে করে থাকেন। অবশ্য তাঁদের ডেলিভারি চার্জ তুলনামূলকভাবে একটু বেশি বলেও জানালেন তাকওয়া।

গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজের ছাত্রী নাজিফা আনজুম শত ব্যস্ততার মধ্যেও নিজের শখকে বিসর্জন দেননি। তাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি কেকের ব্যবসা শুরু করেন। আর বেশ অল্প সময়েই তাঁর উদ্যোগ ‘কেক টু বেক’ এখন অনেকেরই প্রিয় ডেজার্ট ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। নাজিফা জানান, ২০২০ সালে কোভিড সংক্রমণের কারণে যখন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়, তখন বাড়িতে বসে অলস সময় কাটাতে হয়েছে তাঁকে। সে সময়ে ছুটিকে মজাদার করে তোলার জন্য কেক তৈরির চেয়ে ভালো উপায় তার আর জানা ছিল না।

ছবি: কেক টু বেক

কারণ, ছোটবেলা থেকেই বেকিংয়ের প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ ঝোঁক। তার ওপর লকডাউন চলাকালে সোশ্যাল মিডিয়ায় সবার রেসিপি শেয়ার করা দেখে তাঁর পুরোনো শখ যেন আবার চাগিয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে পরিচিত-অপরিচিত অনেকেই তাঁর কেক ও অন্যান্য ডেজার্টের ভক্ত হয়ে ওঠেন। এভাবেই কেক টু বেকের পথ পাড়ি দেওয়া শুরু। নিজের শখের কাজে পুরোপুরিভাবে মনোনিবেশের জন্য তিনি ফেসবুক পেজের (https://www.facebook.com/Cake-2-Bake-103426064767169/) মাধ্যমে নিয়মিত অর্ডার গ্রহণ শুরু করেন। এ পদক্ষেপে তাঁর বন্ধুরা, বিশেষ করে মেডিকেল কলেজের বন্ধুরা খুব উৎসাহ দেন। নাজিফা জানান, ২০২০ সালের জুলাই মাসে এ পেজে প্রথম অর্ডার আসে।

নাজিফা আনজুম
ছবি: কেক টু বেক

সাধারণত চকলেট, ভ্যানিলা, ব্ল্যাক ফরেস্ট, হোয়াইট ফরেস্ট, ওরিও, চকলেট ফাজ, রেড ভেলভেট, কাপ কেক, পেস্ট্রি ও ডোনাটের অর্ডার নেওয়া হয়ে থাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন উপলক্ষে রেগুলার কেকের পাশাপাশি ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী নানা রকম থিমের কাস্টমাইজড কেকও তৈরি করে দেওয়া হয়। আর দামও নির্ভর করে আকার ও কাস্টমাইজেশনের ওপর। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নিজস্ব আউটলেট প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। প্রথমত মায়ের অনুপ্রেরণা, সঙ্গে বেকিংয়ে তাঁর একজন সহযোগী এবং একজন নিষ্ঠাবান ডেলিভারি পারসনের পূর্ণ সহযোগিতাই নাজিফার এই সাহসী উদ্যোগকে সফলভাবে এগিয়ে নেওয়ার প্রেরণা হয়েছে।

কেকের প্রেমে পড়েননি, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া বেশ দুরূহ। বিশেষ করে, তরুণ প্রজন্মের কাছে কেক তো প্রায় সব উপলক্ষেরই সঙ্গী। তাই করোনাক্লিষ্ট পৃথিবীতে সপরিবার আনন্দময় সময়ের সঙ্গী হতে পারে কেক। যেখানে উপলক্ষ না হয় গৌণ হয়ে যাক।