দম মারো দমপোখত

আম্বুর দম বিরিয়ানি
ছবি: প্রথম আলো

আমাদের বিশেষ খাবারগুলোর মধ্যে দমপোখত এক অনন্য সংযোজন। জনপ্রিয় বিভিন্ন মাংসের দমপোখত আর দমপোখত বিরিয়ানি বহু যুগ ধরে রসনাবিলাসীদের মন জয় করে আসছে। আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত, বিয়েবাড়ির প্রধান আকর্ষণ কাচ্চি বিরিয়ানি এবং হালের জনপ্রিয় চিকেন বা মাটন দমপোখত বা দম বিরিয়ানি—সব কটিই একেবারে বিশেষ এক পদ্ধতিতে ‘দম’ দিয়েই রান্না করা হয়।

অনন্য স্বাদ-গন্ধের দমপোখত শব্দটিকে ব্যবচ্ছেদ করলে দেখা যায়, পারস্য ভাষায় ‘দম’ অর্থ প্রশ্বাস আর ‘পোখত’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে রন্ধনপদ্ধতি। ভারতীয় উপমহাদেশে এসে এই দমপোখত শব্দের অপভ্রংশ ঘটে গিয়ে কোথাও কোথাও একে ‘দমপোক’ও বলা হয়। তবে সেই সত্তরের দশকের বিখ্যাত ‘দম মারো দম’ গানের ‘দম’কে দিয়ে আবার কীভাবে রান্নাবান্নার কাজ করিয়ে নেওয়া যায়, তা এক চিন্তার বিষয় বটে!

দমপোখত বা দম দিয়ে রান্না বলতে কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই রান্নার পাত্রটিকে সব উপকরণসহ আটার গোলা দিয়ে সিলগালা করে তার দম আটকে দিয়েই লম্বা সময় ধরে অত্যন্ত ঢিমে আঁচে রান্না করা হয়। এর ওপরেও বন্ধ ঢাকনায় অঙ্গার বা জ্বলন্ত কয়লা দিয়ে রাখা হয় প্রায় পুরো সময়টাতে, যেন সব দিক থেকে সমান তাপ পায় হাঁড়ির খাবার। ভেতরে মাংস, আলু, পনির, মাছ, সবজি, বিরিয়ানি, পোলাও—যা–ই থাক না কেন, দম দিয়ে বা খাবারের নিজস্ব ভাপ হাঁড়ির ভেতরেই আটকে রেখে ঢিমে আঁচে লম্বা সময় ধরে এভাবে রান্না করলে যে অপূর্ব স্বাদ–গন্ধ পাওয়া যায়, তা অন্য কোনো রন্ধন পদ্ধতিতেই সম্ভব নয়। তাই তো যুগ যুগ ধরে প্রচলিত এ রন্ধনপ্রক্রিয়ার প্রতি বিশ্বব্যাপী সবারই আছে প্রবল আগ্রহ।

দমপোখত বিরিয়ানি রান্না হচ্ছে
ছবি: আফসানা সালাম

প্রতিটি অঞ্চলেই দম দিয়ে রান্না করা নিজস্ব বিশেষ ধরনের খাবারের প্রচলন আছে। যেমন আমাদের দেশের কাচ্চি বিরিয়ানি। উৎকৃষ্ট মানের খাসির মাংস, সুগন্ধি চাল, ঘি, ভেজে নেওয়া জাফরানি রঙে রাঙানো আলু আর বিচিত্র সব মনমাতানো মসলায় আটার গোলা দিয়ে ডেক বা ডেকচির মুখ আটকে নিয়ে কাঠকয়লার আগুনে ডেক বসিয়ে ওপর থেকেও কাঠকয়লা রেখে রান্না করা হয় কাচ্চি বিরিয়ানি। সব দিক থেকে উত্তপ্ত ডেকের ভেতরে নিজস্ব রস আর দম বা ভাপে বিরিয়ানি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত রান্না করা হয়। ভেতরের রূপ, রস আর গন্ধ বের হতে না দেওয়ায় মসলা আর মাংসের স্বাদ–গন্ধ অনন্যসাধারণ হয়ে ওঠে চালের সঙ্গে মিশে। আটার গোলা সরিয়ে ঢাকনা খুললেই যে সুগন্ধ বেরিয়ে আসে, তা বেশ দূর হতেও পাওয়া যায়।

কাচ্চি বিরিয়ানির পাশাপাশি দম দিয়ে রান্না করা বিভিন্ন মাংসের পদ, যেমন চিকেন দমপোখত, মাটন দমপোখত, পাক্কি দম বিরিয়ানি (যেখানে মাংস ও চাল দুই–ই আগে রান্না করে পরে একসঙ্গে ডেকচিতে নিয়ে দম দেওয়া হয়), কাশ্মীরি দম আলু, পনির দমপোখত ইত্যাদি খাবারও খুবই উপাদেয় ও জনপ্রিয়। উত্তর ভারতে বিভিন্ন ডালজাতীয় খাবার এবং হায়দরাবাদে মাছের বিশেষ বিভিন্ন পদও দম দিয়ে রান্না করা হয়। আমাদের দেশসহ পুরো উপমহাদেশেই সহিহ তরিকায় পোলাও রান্না করতে চাল ফুটে এলে ঢাকনার নিচে সুতি কাপড় দিয়ে ঢেকে ঢিমে আঁচে রেখে ওপরে জ্বলন্ত কাঠকয়লা দিয়ে দম দেওয়া হয়। এতে করে চালের দানাগুলো যেমন ঝরঝরে হয়, তেমনি পোলাওয়ের স্বাদ–গন্ধও বহুগুণ বেড়ে যায়। চালের জর্দা রান্না করতেও এভাবে শেষ দম দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

দমে রান্না হচ্ছে বিহারের বিখ্যাত আহুনা মটন
ছবি: শঙ্খ দত্ত

যে খাদ্যদ্রব্যই এই দম দেওয়া পদ্ধতিতে রান্না করা হোক না কেন, সঠিক ও সুস্বাদু দমপোখত ডিশের জন্য চাই উপযুক্ত ডেক বা ডেকচি। এত লম্বা সময় ধরে রান্না করতে হয় বলে তলায় যাতে ধরে না যায়, সে জন্য ভারী তলাযুক্ত ডেক নিতে হবে। এ কাজে তাপ পরিবাহী ডেক ভালো। যেমন তামার তৈরি ডেক ব্যবহার করলে সব দিকে সমানভাবে তাপ ছড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি নিশ্চিত করা যায়। তবে খাবারে অম্লজাতীয় কোনো উপকরণ থাকলে যেন তামার সঙ্গে বিক্রিয়া না ঘটে, সে জন্য টিনের আবরণযুক্ত তামার ডেকই সবচেয়ে ভালো দমপোখত রান্নার জন্য। এ ছাড়া খেয়াল রাখতে হবে যেন পাত্রটি বেশি ছড়ানো না হয়। এতে করে ভেতরের ভাপ বা দম ভেতরেই ধরে রাখার কাজটি আরও ভালোভাবে করা যাবে।

গ্যাসের চুলায় দমে রান্না বেশ কঠিন একটা ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে কাঠকয়লার আগুনে ওপর ও নিচ থেকে তাপ দিয়ে লম্বা সময় ধরে দম দিলে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়। কিন্তু বাসাবাড়িতে গ্যাসের চুলায় তাওয়ার ওপরে ডেক বসিয়ে ভালোভাবে আটকে ওপরে ফুটন্ত গরম পানির পাত্র বা পারলে কাঠকয়লার জ্বলন্ত অঙ্গার রেখে ঢিমে আঁচে অনেকক্ষণ রাখলেও যথেষ্ট ভালো ফল পাওয়া যায়। আবার অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে খুব ভালোভাবে ঢেকে আটকে নিয়ে ওভেনে অল্প আঁচে লম্বা সময় রাখলেও দম পোখতের কাজ হয় বেশ অনেকটা। উপকরণের ধরন অনুযায়ী তেল বা ঘিয়ে কিছুটা ভুনে বা ভেজে নিয়ে তারপরও ডেক আটকে দম দেওয়া হয় অনেক ক্ষেত্রে। পরিবেশনের ঠিক আগে আগে আটার বাঁধুনি খুললে সুবাসে ম–ম করে উঠবে চারদিক। অনেক সময়ে পরিবেশনের স্থানে অতিথিদের সামনেই দমপোখত বিরিয়ানি বা অন্য ডিশের ডেকচির পর্দা উন্মোচন করা হয়।

দমপোখতের সময় নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে রসাল আর মনমাতানো স্বাদ–গন্ধে অনন্য হয়ে ওঠার পূর্বশর্ত হচ্ছে উৎকৃষ্ট মানের উপকরণের ব্যবহার। ঐতিহ্যবাহী দমপোখত পদগুলোতে খুব তীক্ষ্ণ স্বাদযুক্ত মসলা ব্যবহৃত হয় না, বরং সুগন্ধি মসলাপাতির ওপরে জোর দেওয়া হয়।

তবে দমপোখতের সময় নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে রসাল আর মনমাতানো স্বাদ–গন্ধে অনন্য হয়ে ওঠার পূর্বশর্ত হচ্ছে উৎকৃষ্ট মানের উপকরণের ব্যবহার। ঐতিহ্যবাহী দমপোখত পদগুলোতে খুব তীক্ষ্ণ স্বাদযুক্ত মসলা ব্যবহৃত হয় না, বরং সুগন্ধি মসলাপাতির ওপরে জোর দেওয়া হয়। সাধারণ রন্ধনপ্রণালির মতো নেড়েচেড়ে চেখে দেখা, ঢাকনা খুলে সিদ্ধ হলো কি না, লবণ–ঝাল ঠিক আছে কি না, তা দেখার কোনো উপায় নেই দমপোখতে। একবার দমে দিয়ে সেই আটার সিলগালা খুললে তবেই বোঝা যাবে মাংস বা চাল সুসিদ্ধ হলো কি না বা নিচে পোড়া লেগে গেল কি না। তাই দমপোখত রান্নায় বিশেষ মুনশিয়ানার দরকার হয়, যা কি না মূলত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই অর্জন করা সম্ভব।

মনমাতানো দমপোখতের খাদ্যরসিকদের কাছে সব সময়ই এক অন্য রকম আবেদন আছে। এখন এই ইন্টারনেটের যুগে, শুধু রেস্টুরেন্ট নয়, বাড়িতেই অনেকে বিভিন্ন দমপোখত ডিশ বানিয়ে থাকেন পরিবারের সবাই বা বন্ধুবান্ধবকে চমকে দেওয়া আপ্যায়ন করতে।