দেশে দেশে খ্রিষ্টীয় নববর্ষের খাবার

খ্রিষ্টীয় নববর্ষের কথা ভাবলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে টিভি পর্দায় দেখা ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যরাতে আমেরিকার নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারের বর্ণিল, আলোঝলমলে, হইচইয়ে ভরা কাউন্টডাউন আর আতশবাজিতে উদ্দাম আনন্দ উদযাপনের দৃশ্য। সেই ১৯০৪ সাল থেকে এই একই জায়গায় একইভাবে চলে আসছে এই জাঁকজমকপূর্ণ নববর্ষ পালনের রীতি। তাই আমেরিকার বর্ষবরণের গল্প আলাদা করে বলার দরকার আছে বৈকি।

আমেরিকার নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারের বর্ণিল, আলোঝলমলে, হইচইয়ে ভরা কাউন্টডাউন আর আতশবাজিতে উদ্দাম আনন্দ উদযাপন
ছবি: রয়টার্স

আবার বিশ্বায়নের এই দিনে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খ্রিষ্টীয় নববর্ষ পালনের ঘটা আমাদের এশিয়াতেও কিন্তু এখন কিছু কম নয়। ঐতিহ্যগতভাবে জাপানে বা ভারতের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সমাজে বহু যুগ ধরে খ্রিষ্টীয় নববর্ষের গুরুত্ব আছে। কিন্তু এখন চীন, হংকং, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ইত্যাদি দেশে তো বটেই; এমনকি আমাদের বাংলাদেশেও সাধারণ মানুষের মধ্যে অত্যন্ত আগ্রহ বেড়েছে নিউ ইয়ার পালনে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

আমেরিকান নববর্ষ মানেই মধ্যরাতে পানীয়র গ্লাস হাতে নতুন বছরের শুভকামনা বা টোস্ট করা। আর আমেরিকানরা প্রথাগতভাবে অবশ্যই নতুন বছরের প্রথম দিনে ব্ল্যাক–আইড পিজ নামের একধরনের বিনস বা ডালজাতীয় খাবার খেয়ে থাকেন। আমেরিকার স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় তাদের ইউনিয়ন সৈন্যরা এ বিনস খেয়ে দিনাতিপাত করেছেন বলে বিশ্বাস করে আমেরিকানরা। এ ছাড়া মনে করা হয়, এই খাবার নতুন বছরে সবার জন্য সাফল্য, সচ্ছলতা, উন্নতি নিয়ে আসবে।

নতুন বছেরর খাবার ব্ল্যাক–আইড পিজ, আলাবামা, আমেরিকা
ছবি: উইকিপিডিয়া

জানা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলের টেক্সাস, আলাবামা, ফ্লোরিডা, ভার্জিনিয়া ইত্যাদি প্রদেশ থেকেই উদ্ভব হয়েছে এই রীতির। আবার ভাঁজ করা টাকার আদলে সাজানো কলার্ড অথবা শর্ষের শাক থাকে আমেরিকানদের নৈশভোজের টেবিলে। বাসনা একটাই, যেন নতুন বছরে সম্পদের প্রাচুর্য আসে। সেই সঙ্গে তাঁদের বিশ্বাস অনুযায়ী, জীবনে উন্নতির প্রতীক শূকরের মাংস আর সোনালি রঙের কর্ন ব্রেড বা ভুট্টার আটা দিয়ে বানানো রুটি খেয়ে সবাই প্রার্থনা করেন নতুন বছরের সোনালি দিনের আশায়।

মেক্সিকো

রোসকা ডি রেস
ছবি: উইকিপিডিয়া

মেক্সিকোতে নববর্ষ মানেই রোসকা ডি রেস নামের এক অত্যন্ত উপাদেয় বড় রিং আকৃতির কেক বা রুটি। এতে বিভিন্ন ফলের মিষ্টিমধুর মোরব্বা, গুঁড়া করা চিনি, কিশমিশ ইত্যাদি দেওয়া হয়। বানানোর সময় এর ভেতরে লুকিয়ে রাখা হয় শিশু বয়সের যিশুখ্রিষ্টের আদলে গড়া ছোট্ট পুতুল। সবাই মিলে এই কেক খাওয়ার সময় যে এই পুতুল পায়, তাকে পরবর্তী রোববারে এলাকার গির্জায় গিয়ে সবাইকে ‘তামালে’ খাওয়াতে হয়। এই তামালে একেবারেই আমাদের চট্টগ্রামের জনপ্রিয় আতিক্কা পিঠার মতো। মেক্সিকান মা–বোনেরা পরম যত্নে একসঙ্গে বসে গল্পগুজব করতে করতে কলাপাতা বা ভুট্টার পাতায় ভুট্টার আটা, মাংস আর পনিরের পুর ভরে মুড়িয়ে এই ছোট ছোট তামালের প্যাকেট তৈরি করেন। এভাবে সব কটি তৈরি করে বিশাল হাঁড়িতে এগুলো সেদ্ধ বা ভাপ দেওয়া হয়। ছেলে–বুড়ো সবার কাছেই এই তামালে পিঠা খুব প্রিয়। বিশেষ করে নববর্ষের উৎসবে।

আর্জেন্টিনা

আর্জেন্টিনার খাদ্যতালিকায় এমনিতেও বিনস বা বিভিন্ন ডালজাতীয় খাবারের প্রাধান্য রয়েছে। অর্থকরী রবিশস্য হিসেবে আর্জেন্টাইন সমাজে তাই বিনসের আছে আলাদা কদর। নববর্ষের দিনে আর্জেন্টিনার সবাই বিনস–জাতীয় খাবার শখ করে খান। তাঁরা বিশ্বাস করেন, এতে তাঁদের জীবন ও জীবিকায় আসবে উন্নতি, আসবে প্রাচুর্য।

ব্রাজিল

স্প্যানিশ ও পর্তুগিজদের মতো তাই ব্রাজিলেও নববর্ষে আঙুর খাওয়া হয়
ছবি: পেকজেলস ডট কম

ব্রাজিলে সামাজিকভাবে ইউরোপীয় প্রভাব অনেকটাই বেশি। স্প্যানিশ ও পর্তুগিজদের মতো তাই এখানেও নববর্ষের ১২টি ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে ১২টি আঙুর বা আনারদানা খাওয়া হয়। এ ছাড়া নববর্ষের দিন চাল-ডাল থাকে সবার খাবার টেবিলে। কারণ, তাঁদের ধারণা, চাল ও ডাল অর্থনৈতিক উন্নতির প্রতীক। এ ছাড়া এদিন সন্ধ্যায় সবাই মিলে বিভিন্ন রকমের ফলের রস দিয়ে তৈরি ককটেলসহ পানীয় পান করা হয় সাম্বা নাচের তালে তালে সমুদ্রসৈকতে।

জাপান

তশিকশি সোবা নুডলস
ছবি: উইকিপিডিয়া

জাপানে গরম গরম স্যুপ বা সুস্বাদু ব্রথে ডোবানো ‘তশিকশি’ নামের বিশেষ ধরনের সোবা নুডলস খাওয়ার মাধ্যমে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়া হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইয়া লম্বা লম্বা এই সোবা নুডলস খেতে হবে টুকরা না করে। সবাই মিলে নববর্ষের দিনে বসে দুই কাঠির কারসাজিতে সুড়ুত সুড়ুত করে টেনে খাওয়া এই নুডলসের দৈর্ঘ্য দীর্ঘ আর সুখী–সমৃদ্ধ জীবনের ছবি তুলে ধরে জাপানিদের মনে।

কোরিয়া

তেওকগুক স্যুপ
ছবি: উইকিপিডিয়া

আমাদের মেড়া পিঠার মতো কোরিয়ায় চালের গুঁড়া দিয়ে ভাপে বানানো হয় রাইস কেক। এই রাইস কেক মাংস, ডিম, সামুদ্রিক শেওলা ও সবজি দিয়ে বানানো সুস্বাদু তেওকগুক স্যুপ নববর্ষের দিন পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে খাওয়াটাই কোরীয় রীতি। নতুন বছরে এই স্যুপ খেয়েই আরেক বছর জীবন পাওয়ার আশা রাখেন কোরীয়রা। এমনকি সে দেশের বয়োবৃদ্ধ মানুষেরা এই বলে গর্ব করেন যে আমি এই এতবার তেওকগুক খেয়েছি জীবনে!

ভারত

ভারতের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সমাজে খ্রিষ্টীয় নববর্ষ অন্যতম প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। বিভিন্ন কেক, কুকিজ ও পুডিংয়ের পাশাপাশি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা অবশ্যই মাছ, চাল ও ডালের তৈরি খাবার রাখেন নতুন বছরের প্রীতিভোজে। কারণ, তাঁদের ধারণা অনুযায়ী এই খাবারগুলো জীবনে সমৃদ্ধি আর উন্নতি নিয়ে আসে।

বাংলাদেশ

আমাদের বাংলাদেশে খ্রিষ্টীয় নববর্ষের খুব প্রাচীন কোনো ঐতিহাসিক দলিল না পাওয়া গেলেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই খুব উৎসবমুখর পরিবেশেই ‘নিউ ইয়ার’ উদযাপন করা হয়। কার্ড ও উপহার বিনিময়, নতুন বছরের প্রথম প্রহরে কেক কেটে খাওয়া, একটু ভালো খাওয়াদাওয়ার পাশাপাশি তারকাখচিত হোটেলগুলোতে সব সময়ই বিদেশি নাগরিক ও উচ্চবিত্ত সমাজের অনেকেই নিউ ইয়ারের আগের রাতে নাচ, গান, প্রীতিভোজ আর কাউন্টডাউনের আয়োজনে অংশ নিয়ে থাকেন।

থার্টি ফার্স্ট নাইটে ঢাকা
ছবি: প্রথম আলো

আবার সেই সঙ্গে হাল সময়ে প্রচলন হয়েছে পারিবারিকভাবে বা বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে থার্টি ফার্স্টের রাতে খোলা জায়গায় বা ছাদে বারবিকিউ করার। কয়লার আগুনে ঝলসানো মুরগি, গরু, খাসি আর মাছের কাবাবের উপাদেয় স্বাদকে আরও পূর্ণতা দেয় নতুন বছরের সূচনায় সবাই মিলে কেক কেটে খাওয়া। তবে করোনার সংক্রমণ রুখতে এবং উচ্ছৃঙ্খলতা এড়াতে এবার আমাদের সবারই সচেতনভাবে লোকসমাগমের বড় আয়োজন থেকে বিরত থাকা উচিত। এর চেয়ে পারিবারিক আবহে বিভিন্ন দেশের এসব নিউ ইয়ার স্পেশাল খাবার থেকে নিজেদের নৈশভোজের মেনু সাজিয়ে ঘরেই নিরাপদে নতুন বছরের আনন্দ নিই যেন সবাই নতুন দিনের আশায়।