পৃথিবী মাতানো মিষ্টান্ন

সুফলে কেকছবি: আনস্প্ল্যাশডটকম

সবার কথা বলতে পারব না, তবে আমি ও আমার মতো অনেকেই ‘ফ্রান্স’ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই চোখের সামনে একেক পর এক ডেজার্টের ছবি দেখতে থাকেন।  
আর এমনটা হবে নাই–বা কেন? আমার ছোট থেকে যা কিছু মজার ডেজার্ট-পেস্ট্রি আর কনফেকশনারি খাবার খেতে ভালো লাগত, একটু খুঁজেই দেখতাম তার অর্ধেকের বেশি আসলে উৎপত্তি ফ্রান্সে, ফরাসি ডেজার্টের প্রেরণায় তৈরি। এতে আসলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ডেজার্ট শব্দের উৎপত্তিই যখন ফরাসি শব্দ ‘দেসাভিয়া’ (আক্ষরিক অর্থ অনেকটা ‘টেবিল সাফ করা’) থেকে।  সেই দেশের খাওয়ার পরে পরিবেশনের ডেজার্টগুলো কতটা অসাধারণ হবে, তা তো বোঝাই যায়।

দৃষ্টিনন্দন সব ফ্রেঞ্চ কেক
ছবি: আনস্প্ল্যাশডটকম

মূলত ফরাসি সংস্কৃতি থেকেই বিশ্বের অনেক জায়গায় মূল খাবারের পরে ডেজার্ট খাওয়ার বিষয়টি জনপ্রিয়তা পায়। আর এই জনপ্রিয়তার পেছনে আছে ফরাসিদের তৈরি অসংখ্য সুস্বাদু মিষ্টি খাবার, যা ছড়িয়ে গেছে ইউরোপ মহাদেশের সীমানা ছাড়িয়েও বিশ্বের নানা প্রান্তে। মাখন, চিজের হাজারো বৈচিত্র্য আর সেসবের ব্যবহারবিধিই এসব মিষ্টান্ন পদের প্রাণ। এর সঙ্গে আছে খাদ্যরসিক মনের যথাবিহিত গুরুত্ব, পরম যত্ন ও নিবিষ্টতা।

ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে আসলে দেখা যায়, প্রায় সতের শ ও আঠার শ শতকে এসব ফরাসি ডেজার্টের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। মারি আঁতোয়ান কারেমকে ইতিহাসের প্রথম ‘সেলেব্রিটি ডেজার্ট শেফ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। মূলত তিনি কিংবা তাঁর মতোই নাম না জানা অনেক শেফের একান্ত চেষ্টায় ফরাসিদের মিষ্টান্ন পৌঁছে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়।

ক্রোসাঁ ও কফি
ছবি: পেকজেলসডটকম

যেই বয়সে ‘ক্রোসাঁ’ উচ্চারণ করতে পারতাম না, সেই বয়সেও এই খাবারের স্বাদ আর তার চেয়েও বেশি মিষ্টি ও বাটারি ঘ্রাণ মন ছুঁয়ে গিয়েছিল। এই যে এখন লিখতে লিখতে সেই সুন্দর ভালো লাগার গন্ধটা কেমন একটু স্মৃতিকোষে সৌরভ ছড়াচ্ছে। আর মনে করে মনও ভালো হয়ে যাচ্ছে। এই রকম শুধু আমাদের চেনাজানার মধ্যেই কয়েক শ ডেজার্টের নাম বলা যাবে, যেগুলো ফরাসি ডেজার্ট আর পেস্ট্রি আইটেম। এর বাইরেও নাম না জানা বা কম পরিচিত এমন খাবারের সংখ্যাও নেহাত কম নয়।

সবচেয়ে বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ ডেজার্ট হিসেবে ধরা হয় ‘ক্রিম ব্রুলে’কে। কাস্টার্ড আর পুডিং,এই দুইটা খুব চেনা খাবারের সঙ্গে অনেংকাশে মিল থাকলেও স্বাদের ধরন কিংবা বানানোর প্রক্রিয়া দুটিই বেশ আলাদা। ঘন ক্রিমের বেকড অংশের ওপরে কুড়মুড়ে ক্যারামেল টপ সব মিলিয়ে ভিন্ন টেকশ্চার আর দুই ধরনের মিষ্টির একদম নিখুঁত সমন্বয়, ক্রিম ব্রুলে জয় করে নিয়েছে সবার মন। বাংলাদেশেও এখন অনেক জায়গায় বেশ ভালো মানের ও রেসিপি বিবেচনায় খুবই সুন্দরভাবে তৈরি ক্রিম ব্রুলে পাওয়া যায়, যা তরুণদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়।

সবচেয়ে বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ ডেজার্ট ক্রিম ব্রুলে
ছবি: আনস্প্ল্যাশডটকম

বর্তমানে বাংলাদেশে আরও যে কয়েকটি ফ্রেঞ্চ ডেজার্ট ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় তার মধ্যে ম্যাকরন, সুফলে, ক্রেপ আর এক্লেয়ারসের কথা বলতেই হবে। এর বাইরে সারা বিশ্বে প্রচলিত এমন কিছু ডেজার্ট হলো ব্রিওশ, পাফ পেস্ট্রি, ক্যান্ডিড চেস্টনাট কিংবা পেস্তা চকলেট শামুক (লেসকাগো শোকোলা পিশতাস), টার্টের মতো খাবার। এসব ডেজার্ট কেবল স্বাদে নয়, রূপেও অসাধারণ।

ওহ, এত কথার ফাঁকে দেখুন তো ফরাসি বিস্কুট আইটেমগুলোর কথা বলাই হয়নি। মেরাং কুকি কিংবা মন্দিওঁ, মেডেলিন থেকে প্যাতা শ্যু—নানা নামের নানা খাবার প্রতিটিই স্বাদে আলাদা আর খুবই অসাধারণ। আর অ্যাসোর্টেড কেক-পেস্ট্রি তো আছেই, আছে মুজ কিংবা ক্রিমি ক্যামেল পুডিং। সব মিলিয়ে ফ্রেঞ্চ ডেজার্ট নিয়ে বলা শুরু করলে আসলে থামা কঠিন।

টার্ট
ছবি: আনস্প্ল্যাশডটকম

ফরাসি ডেজার্ট কী কারণে এতটা জনপ্রিয় বা এমন কী আছে এতে, যার জন্য বিশ্বজুড়ে ঠিক এতটা কদর, এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে।

এর উত্তর একটু জ্ঞানগর্ভ আলোচনা মনে হলেও আমার মনে হয় খাবার নিয়ে আগ্রহ থাকলে ভালোলাগার মতোই। প্রথমেই আসে খাবারের টেকশ্চারের বিষয়টি। পরম যত্ন ও প্রচুর সময় নিয়ে এই ডেজার্টগুলো তৈরি করা হয়। আগুনের তাপ, ওভেনের কম্পার্মেন্টের তাকের হিসাব থেকে শুরু করে খাবারগুলো ফ্রিজে রাখার সময় পর্যন্ত সবই খুব সচেতনভাবে অনুসরণ করা হয়। তারপর আসে খাবার সাজানোর বিষয়।

এক্লেয়ারস
ছবি: আনস্প্ল্যাশডটকম

এমন সব জিনিস দিয়ে ডেজার্টগুলো সাজিয়ে খুবই সুন্দরভাবে পরিবেশন করা হয়, যা হঠাৎ করে আমরা ভাবতেই পারি না। তার চেয়েও মজার ব্যাপার, এই যে একদমই ভাবাই যায় না, এমন একাধিক জিনিস মিলিয়ে দেওয়ার পরে খাবারের স্বাদে চলে আসে অসাধারণ একটা ব্যাপার। এককথায় বলতেই হয়, শিল্পকর্মের দেশ ফ্রান্স আক্ষরিক অর্থেই তাদের ডেজার্টকেও নিয়ে গেছে শিল্পের পর্যায়ে।

সে যাহোক, সেসব আলোচনার বাইরে থেকেও শুধু একজন খাবার নিয়ে থাকা সাধারণ ভোজনরসিক কিংবা সুইট টুথ মানুষ হিসেবেও ফরাসি ডেজার্ট ভালোবাসেন সবাই। আর এখানেই সার্থকতা এই খাবারের, যা শতাব্দী ধরে মাতিয়ে রেখেছে সবাইকে।

লেখক: শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়