পৃথিবীজুড়ে নববর্ষের বৈচিত্র্যময় খাবার

খাদ্যরসিক হিসেবে বাঙালির বেশ সুনাম আছে বৈকি। বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই থাকে আমাদের দেশে। প্রিতিট উৎসেবই যেন আমাদের রসনাবিলাসের বাসনা আর সুখাদ্য ভোজনের কামনা অনুষ্ঠানের অন্য সব ব্যাপারকে ছাপিয়ে যায়। আমাদের মতো অন্য সব দেশেও কিন্তু প্রতিটি উৎসবের সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বিশেষ বিশেষ খাদ্য ও পানীয়ের ইতিহাস এবং সংস্কৃতি। নববর্ষের উৎসবই–বা তার ব্যতিক্রম হতে যাবে কেন! চলমান বছরের দুঃসহ অভিজ্ঞতাকে পাশে রেখেই নববর্ষের উৎসবমুখর উত্তেজনাময় সময়ের একদম কাছে চলে এসেছি আমরা। একেক দেশের মজার মজার ঐতিহ্যবাহী খাবার আর পানীয়ের জাদুর গালিচায় চেপে চলুন আমরাও বেরিয়ে পড়ি বিশ্বভ্রমণে।

প্রাচীন রোমান সভ্যতার যুগে এবং বর্তমানেও পাশ্চাত্য সমাজে, বিশেষ করে খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের মধ্যে নতুন বছরের সামাজিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব খুব বেশি। তাই প্রথমে ইউরোপের কথায় আসা যাক।

ডেনমার্ক, সুইডেন ও নরওয়ে

ডেনমার্কে কাচের প্লেট–বাটি ভাঙার মধ্য দিয়ে নববর্ষ উদ্‌যাপন করা হলেও এটা ভাবার অবকাশ নেই যে নতুন বছরকে বরণ করতে সে দেশে পেটপূজার কোনো কমতি হয়। ক্রানসাকা নামের এক সুন্দর কেক থাকে তাদের ভোজের মধ্যমণি হয়ে। পর্যায়ক্রমে ব্যাস কমতে থাকা রিং আকৃতির ড্যানিশ পেস্ট্রি একের পর এক বসিয়ে পর্বতের মতো আকৃতি দেওয়া হয়। সঙ্গে ব্যবহার করা হয় মারজিপান নামের বাদাম–চিনির পেস্ট আর পছন্দের পানীয়।

ক্রানসাকা কেক
ছবি: উইকিপিডিয়া

স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ ডেনমার্ক, সুইডেন ও নরওয়ে আমাদের পছন্দের তালিকায় থাকা উচিত। কেননা, তারা আমাদের পায়েসের আরেক রূপ রাইস পুডিং দিয়ে নববর্ষ পালন করে!

রাইস পুডিং
ছবি: উইকিপিডিয়া

তার মধ্যেও আছে এক মজার রীতি। একটি মাত্র কাঠবাদাম বা আমন্ড দেওয়া হয় সেই পায়েস রান্না করার সময়। সবাই মিলে রাইস পুডিং খেতে গিয়ে যে সেই বাদাম পাবে, মনে করা হয় তার ভাগ্যে নতুন বছর আনবে নতুন চমক। ড্যানিশ ক্রানসাকা কেকও দুই প্রতিবেশী দেশ সুইডেন ও নরওয়ের নববর্ষের অন্যতম আকর্ষণ। এ ছাড়া মৎস্যপ্রিয় এই তিন দেশেই সিরকা ও লবণ পানিতে জারিত করা মাছ স্মোকড হেরিং আর মাংসের বল দিয়ে নববর্ষের প্রীতিভোজের আয়োজন করা হয়ে থাকে।

স্পেন

টক আঙুর অশুভ আর মিষ্টি আঙুর শুভ বলে বিশ্বাস করে স্পেনের মানুষ
ছবি: পেকজেলস ডট কম

সবচেয়ে মজার রীতি আছে স্পেনে। এই দেশে রাত বারটার ঘণ্টা বাজতেই নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে ১২টি ঘণ্টার তালে তালে টপাটপ ১টি করে আঙুর খায় সবাই। ১২ মাসের জন্য বরাদ্দ ১২টি আঙুরের মধ্যে টকগুলো খারাপ আর মিষ্টিগুলো ভালো মাসের বার্তা নিয়ে আসে। স্পেনে আঙুরবাগানের অবারিত বিস্তৃতিই হয়তো এর কারণ। বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এই রীতি এখন স্প্যানিশ ভাষাভাষী অন্য দেশগুলোতেও ছড়িয়ে গেছে।

তুরস্ক

তুরস্কে নববর্ষ মানেই পরিবারের সবাই মিলে আনারদানা খাওয়া
ছবি: পেকজেলস ডট কম

তুরস্কে নববর্ষ মানেই পরিবারের সবাই মিলে আনারদানা খাওয়া। আনারদানা বা ডালিম তাদের কাছে উর্বরতা ও প্রাচুর্যের প্রতীক। তুর্কি সমাজে এই আনারের ফল ঘিরে নববর্ষের এক মজার নিয়ম প্রচলিত। তারা নববর্ষের সকালে যার যার দোরগোড়ায় জোরসে আছাড় মারে সুপক্ব আনার ফল বা ডালিম। যার ডালিম যত ভেঙেচুরে রং ছড়িয়ে–ছিটিয়ে একাকার হয়, তাদেরই নাকি সৌভাগ্যের পাল্লা বেশি ভারী হয় নতুন বছরে।

হল্যান্ড

আমাদের দেশের আটা ও গুড়ের মজার গুলগুল্লা পিঠার মতো কিশমিশ দেওয়া ডুবো তেলে ভাজা কেক বলকে ডাচ ভাষায় বলা হয় অলিবল বা তেলের গোল্লা। ঠেলাগাড়িতে অলিবল স্তূপ করে নিয়ে নতুন বছর বাইরে হইচই করতে থাকা ছেলে–বুড়ো সবার কাছে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করা হয়।

অলিবল
ছবি: উইকিপিডিয়া

অস্ট্রিয়া

অস্ট্রিয়ায় শূকরের মাংস এতই জনপ্রিয় যে রেড পাঞ্চ বা মসলাদার শুরা ও শূকরছানার আস্ত রোস্ট খাওয়া হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে নতুন বছরের খাবার টেবিলে শোভা পায় মারজিপান দিয়ে বানানো ছোট্ট শূকরছানা আকৃতির মিষ্টান্ন বা মারজিপান শুয়েন।

জার্মানি

বার্লিনা
ছবি: উইকিপিডিয়া

নববর্ষের মিষ্টিমুখ করতে জার্মানিতে সবার পছন্দের তালিকার শীর্ষে আছে বার্লিনা। বার্লিনা হচ্ছে জ্যাম বা অন্য যেকোনো মিষ্টির পুর দেওয়া, চিনির পাউডার ছিটানো ডোনাট। এ ছাড়া মারজিপান বা চিনিমিশ্রিত কাঠবাদামবাটা দিয়ে বানানো শূকরছানা আকৃতির মিষ্টি প্রতিবেশীদেশ অস্ট্রিয়ার মতো এখানেও সমান জনপ্রিয় নতুন বছরের অনুষ্ঠান উদযাপনে।

আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড

আইরিশ ও স্কটিশ ইংল্যান্ডের এই দিলখোলা ও আমুদে জাতি দুটি নতুন বছর খুব ধুমধাম করে পালন করে। স্কটিশরা ৩১ জানুয়ারি মধ্যরাতে হুইস্কিসহকারে শুভকামনা জানাতে নতুন বছরের আনন্দ শুরু করে। এর সঙ্গে শুরু হয় ‘ফার্স্ট ফুটিং’ পালন করা। এটি হলো নতুন বছরের প্রথম প্রহরে প্রতিবেশী ও আত্মীয়–বন্ধুদের বাড়িতে খাবার ও পানীয় নিয়ে যাওয়া।

আইরিশ রুটি ফাল
ছবি: উইকিপিডিয়া

আইরিশ রুটি জগদ্বিখ্যাত। ফলে সহজেই অনুমান করা যায়, তারা তাজা বেক করা রুটির মাতাল করা ঘ্রাণেই নতুন বছরকে বরণ করে নেবে। ইতিহাস বলে, নববর্ষের দিন আইরিশ মায়েরা মাখনে মাখা ওভেন থেকে বের করা গরম রুটি দরজার বাইরে রেখে দিত, যেন ছেলেপেলেরা নিয়ে খায়।

ইতালি

ইতালিতে লেন্টিল বা রবিশস্য–জাতীয় খাদ্য সচ্ছলতার প্রতীক। এই লেন্টিল ডালের সঙ্গে কটেচিনো সসেজ মিশিয়ে বানানো ঐতিহ্যবাহী স্টু–জাতীয় খাবার দিয়ে তাই এই দেশে নতুন বছর পালন করা হয়।

গ্রিস

ভাসিলোপিটা
ছবি: উইকিপিডিয়া

ভাসিলোপিটা নামের এক মজার কফিকেক দিয়ে গ্রিসে নববর্ষ উদযাপন করা হয়। কাঠবাদামে ভরা এই কেকের ভেতরে একটি চকচকে টাকার কয়েন দিয়ে বানানো হয় এই কেক। খেতে গিয়ে যার ভাগ্যে এই কয়েন পড়বে, তার ভাগ্য খুলে যাবে, নতুন বছরে এমনটাই বিশ্বাস করা হয় গ্রিক সমাজে।

ফ্রান্স

ফ্রান্সে নতুন বছরের নৈশভোজে সব রকম সুখাদ্যের শেষে গেচো নামের এক মজার মিষ্টান্ন পরিবেশন করা হয়। বিভিন্ন রকমের ফল ও ক্রিমের লেয়ারে সাজানো এই কেক সারা বিশ্বেই সবার কাছে প্রিয়।