পেটপূজা চলবে দেবীবন্দনার সঙ্গে

খাবার ছাড়া পূজা ঠিক জমে নাছবি: প্রথম আলো

খাবার ছাড়া পূজা ঠিক জমে না। ঝাঁ-চকচকে মন্দিরের রং-বাহারী সাজসজ্জায় উৎসবের আমেজ তৈরি হয় বটে, তবে পূজার আভিজাত্য প্রকাশিত হয় খাবারে। নিরামিষ, আমিষ, যত ধরনের মিষ্টির নাম আমরা জানি, তার প্রায় সবই; তারপর আছে পূজার জন্য বিশেষ বিশেষ খাবার। সব মিলিয়ে পুরো পূজার সময় আধ্যাত্মিক মুক্তির আবেশ যেমন থাকে, তেমনি থাকে স্বাদমুক্তিরও প্রাণান্ত প্রচেষ্টা, সাধ্যমতো।

প্রায় প্রতিদিন সকালের খাবারে থাকবে বিভিন্ন রকম মিষ্টি
ছবি: প্রথম আলো

দুর্গাপূজার ষষ্ঠী থেকে শুরু করে দশমীর বিষণ্নবেলা, আত্মার মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে ঘটে জিবেরও মুক্তি। পূজার প্রসাদ তো আছেই, সঙ্গে যোগ হয় প্রতিটি বাড়ির বৈচিত্র্যময় খাবারদাবারের ঘনঘটা। নারকেলের নাড়ু, মুড়ির মোয়া, বিভিন্ন পদের মিষ্টি, নিরামিষ–খিচুড়ির আধিপত্য থাকে খাবারের পাতে। যাঁরা পূজার আয়োজক নন, তাঁরা তিথি মেনে খাবারের ব্যবস্থা করেন ষষ্ঠী থেকে দশমীর দিন।

প্রায় প্রতিদিন সকালের খাবারে থাকবে মিষ্টিজাতীয় খাদ্য, সেটা নারকেলের নাড়ুই হোক আর রসগোল্লা কিংবা জিলাপি অথবা সন্দেশ। সপ্তমী বা অষ্টমীর দিন সকালে লুচি, বুটের ডাল, সবজি, মিষ্টি। দুপুরে সুগন্ধী চালের ভাত। সঙ্গে সবজি, ডাল, মাছ কিংবা মাংস। তবে বলে রাখা ভালো, যাঁরা পূজার আয়োজক, তাঁরা কিন্তু পূজার পুরো সময় নিরামিষ খাবেন একেবারে শাস্ত্রাচার মেনে। তবে দশমীর দিন সেই শাস্ত্রাচার মেনেই আমিষ খেতে পারেন। অথবা পূজার তিন বা আট দিন পর অষ্টমঙ্গলা শেষে নিরামিষ খাবেন।

মিষ্টি না হলে পূজার খাবার ঠিক জমে না
ছবি: প্রথম আলো

দুর্গাপূজার খাবারদাবারের মূল পর্ব দশমীর দিন। ষষ্ঠী থেকে নবমী যেকেউ নিরামিষ খেতে পারেন। কিন্তু দশমীর দিনটি হয়ে ওঠে আমিষের। মাছ-মাংসের হরেক পদের ব্যাপক আয়োজন থাকে দশমীতে। আত্মীয়স্বজনে মুখরিত বাড়ি আর ধূপের সুগন্ধ ছাড়িয়ে শরতের ফিনফিনে বাতাসে ছড়িয়ে পড়া কষা মাংসের সুগন্ধে দশমী জীবাত্মার অপার মুক্তির দিন। লাল পেড়ে সাদা শাড়ি আর বাহারি পদের খাবারের রঙে সেদিন রান্নাঘর এক অদ্ভুত ক্যানভাসে পরিণত হয়।

দশমীর সকালে খাবার পাতে দই ও চিড়া অবধারিত। কবজি ডুবিয়ে খাওয়া হবে ঘরে পাতা বা কিনে আনা দই, রসগোল্লার ঘন সিরা মিশিয়ে। খাওয়া হবে লুচি, সবজি আর পাঁচফোড়নের ঝাঁঝে রান্না করা বুটের ডালের সংগতে। দুপুরের পাতে কাঁসার থালায় সোনালি রঙের প্রেক্ষাপটে থাকবে জুঁইফুলের মতো ধবধবে সাদা ভাতের ওপর গাঢ় জাফরান রঙের খাসির কষা মাংস! অথবা পেঁয়াজ–জিরের সংগতে রান্না করা পাকা রুইয়ের ঝোল। অথবা কাতলার কালিয়া আর সুগন্ধী কাটারিভোগ চাল অথবা চিড়ায় রান্না করা মুড়িঘন্ট। প্রায় পুরো থালায় থাকবে মুড়মুড়ে করে ভাজা পাঁপড়। ডুবো তেলে ভাজা কারিপাতা দেওয়া খেসারির বড়া। থাকতে পারে সবজির নবরত্ন কিংবা অন্য কিছু। আর বিকেলটা? ছেড়ে দিন হাতের কাছে যা পাবেন তার ওপর।

দশমীতে আমিষ রান্না হবে। মাটন রোগান জোশ
ছবি: প্রথম আলো

বলে রাখি, প্রতিটি বাড়ির খাবারদাবারে কিছুটা পার্থক্য থাকে। থাকে পারিবারিক ঐতিহ্য। সেসব মেনে কিছু সিক্রেট রেসিপি রান্না হয় পূজায়। আর হবে কিছু প্রথাগত খাবারের আয়োজন। যেমন জানা যায়, বিক্রমপুরের জমিদার যদুনাথ রায়ের পরিবারে পূজার সময় প্রতিদিন খাওয়া হতো ইলিশ মাছ। এটা ছিল তাঁদের পারিবারিক প্রথা। কোনো কোনো বাড়িতে পূজার সময় বলি দেওয়া হতো পশু। সে পশুর মাংস নিরামিষ বলে খাওয়া হতো প্রতিদিনই। এ রকম বিভিন্ন প্রথা আছে পরিবারভেদে।

তবে পূজার খাবার বিষয়ে কিছু শাস্ত্রীয় কথাবার্তা বলে রাখা ভালো। শাস্ত্রমতে দুর্গাপূজা তিন ধরনের হয়। প্রথমটি হলো সাত্ত্বিক, দ্বিতীয়টি তামসিক এবং তৃতীয়টি রাজসিক।
সাত্ত্বিক দুর্গাপূজা হয় জপ, যজ্ঞ ও নিরামিষ ভোগ দিয়ে। কাজে বোঝাই যায়, এ ধরনের পূজায় নিরামিষ খাবার ছাড়া অন্য কোনো খাবার স্থান পায় না। সাত্ত্বিক পূজার প্রচলন এখনো আছে বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। তামসিক দুর্গাপূজা নির্দিষ্ট ছিল ভারতের প্রাচীন জনগোষ্ঠী কিরাতদের জন্য। এই কিরাতরা পেশায় ছিল ব্যাধ, অর্থাৎ মাংস বিক্রি যাদের পেশা। ফলে, তামসিক দুর্গাপূজায় মাংস খাওয়াই ছিল প্রধান। বাকি থাকল রাজসিক দুর্গাপূজা।

মাটন চাপ
ছবি: প্রথম আলো

রাজসিক দুর্গাপূজা নিয়ে দুটি কথা বলে রাখি। তাহলে দুর্গাপূজায় খাবারদাবারের বিষয়টি বোঝা যাবে ভালো।

রাজসিক শব্দটির অর্থ রজোগুণাত্মক, রজোগুণ-সম্বন্ধীয়, দর্প-গর্ব প্রভৃতি মনোভাববিশিষ্ট। হিন্দুধর্মে বিশ্বাস আছে, মানুষের গুণ তিনটি। এগুলো হলো সত্ত্ব, তমঃ ও রজঃ। সোজা কথায় বলতে গেলে, সত্ত্ব গুণ হলো ভালো, তমঃ গুণ খারাপ আর রজঃ হলো এই দুটির মাঝামাঝি। আরও বিশেষ কিছু ব্যাপার আছে। খাবারদাবারের আগে সেগুলো আলোচনা করতে গেলে গুরুভোজন হয়ে যেতে পারে বলে আপাতত বাদ থাকল। তবে না বোঝার কোনো কারণ নেই যে আমরা জীবাত্মারা প্রায় সবাই রজোগুণের অধিকারী। একটুখানি গর্ব, একটুখানি ভালোমানুষি, একটুখানি লোভ, একটুখানি বৈরাগ্য ইত্যাদি ভালোমন্দ মেশানো যে গুণ, আমরা সেই রজোগুণেরই অধিকারী।

ফলে, রাজসিক দুর্গাপূজার ব্যাপারটা এই সবকিছুর সম্মিলন, নেতিবাচকতা বাদ দিয়ে। রজঃ থেকে রাজা। আর রাজাগজাদের কাজকারবারই অন্য রকম। রাজরাজড়ারা পূজা করবেন আর সেখানে ভূরিভোজের ব্যাপক আয়োজন থাকবে না, সেটা ভাবা যায় না। রাজসিক পূজায় পশুবলি ও আমিষ ভোগের প্রথা যেমন আছে, তেমনি নিরামিষ ভোগ দিয়েও পূজার প্রচলন আছে। স্বাভাবিকভাবে এ ধরনের পূজা যাঁরা আয়োজন করে থাকেন, তাঁরা শাস্ত্রাচার বাঁচিয়ে দুধরনের খাবারই খেয়ে থাকেন।

মাটন বিরিয়ানি
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত দুর্গাপূজার বেশির ভাগই রাজসিক পূজা। ফলে, খাবারদাবার ছাড়া এ অনুষ্ঠান কল্পনা করাটাই কষ্টকর।