প্রথম আলোকে যা বললেন কিশোয়ার

প্রথম আলো কার্যালয়ে কিশোয়ার চৌধুরী
ছবি: সাইফুল ইসলাম ও দুর্জয় বাংলাদেশ

আতিথ্যে দরাজদিল কামরুল হোসেন চৌধুরী ওএএম। খেতে ও খাওয়াতে পছন্দ করেন এই অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী বাংলাদেশি। একসঙ্গে চার চুলায় রান্না যেন তাঁর বাঁ হাতের খেল। বাবার এ গুণাবলি কোনো এক দিন যে বিশ্বমাঝে ছড়িয়ে দেবেন তাঁর মেজ মেয়ে, বাবা বা কন্যা কেউই সেভাবে এটা ভাবেননি। আর পাঁচটা বাচ্চার মতোই স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেছেন কিশোয়ার চৌধুরী। ইতিহাস আর নৃতত্ত্ব তাঁকে টানে। পড়েছেন মেলবোর্ন, লন্ডন ও হাইডেলবার্গ। পেশায় তিনি গ্রাফিক ডিজাইনার।

কিশোয়ার মনে করেন, বাবা ছাড়াও নানির সূত্রে এ গুণ তাঁর মধ্যে এসেছে

আর রান্নাটা তাঁর সহজাত। কিশোয়ারের ধারণা, বাবা ছাড়াও নানির সূত্রে এ গুণ তাঁর মধ্যে এসেছে। এভাবেই নিজের পেশার বাইরে রান্নার প্রতি আগ্রহ আর আবেগ থেকেই তিনি অংশ নিয়ে ফেলেন রান্নার বিশ্বমাতানো প্রতিযোগিতা মাস্টারশেফের অস্ট্রেলিয়া সংস্করণে। ফলাফল কী, সে আর নতুন করে জানানোর কিছু নেই।

মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় রানারআপ হওয়ার সুবাদে তিনি এখন রন্ধনজগতের ডাকসাইটে তারকা। সম্প্রতি ঢাকা এসেছিলেন কিশোয়ার চৌধুরী। ঢাকায় অবশ্য তিনি মাঝেমধ্যেই আসেন। কখনো থেকেছেন দীর্ঘদিন। তবে এবারের আসাটা একটু অন্য রকম। কারণ, মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় রানারআপ হওয়ার পর প্রথম এলেন কিশোয়ার। ফলে যেখানেই গেছেন, পেয়েছেন বিশেষ সমাদর। তাঁকে একঝলক দেখার জন্য উদ্বেল হয়েছে মানুষ। গেল বুধবার প্রথম আলো অফিসে বসে সে কথাই শোনাচ্ছিলেন তিনি। ব্যস্ত সফরসূচির মধ্যেও কিছুটা সময় বের করে নিয়েছিলেন আমাদের জন্য। ঝটিতি কথোপকথনে কিশোয়ার জানান, ‘আমার পরিবর্তন তেমন হয়নি। তবে মানুষ আমাকে একটু অন্যভাবে নিচ্ছে। তা বলে আমি নিজে কিন্তু গুটিয়ে যাইনি। বরং স্বাভাবিক থেকেছি। একদিন ভোরে আমার স্বামীর সঙ্গে স্টার কাবাবে গিয়ে নাশতা করেছি। কারওয়ান বাজারে বাজার করেছি। তবে মাস্ক থাকার জন্য হয়তো অনেকেই চিনতে পারেনি।’

ফুচকার অভিনব পরিবেশনা

‘আমার এবারের আসার পেছনে একটা উদ্দেশ্যও আছে,’ বলেন কিশোয়ার। ‘আমি এসেছি দুর্জয় বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে। তাঁরা চান রন্ধনশিল্পকে অন্যতর মাত্রায় উপস্থাপন করতে, উদ্‌যাপন করতে। আর আমার দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের উপকরণের ব্যবহারে বাংলাদেশের ব্যঞ্জনকে ফাইন ডাইনিংয়ে পরিবেশন করা। সন্দেহ নেই, আমার জন্য এটা ছিল চ্যালেঞ্জিং।’

‘ডিসপ্লেসমেন্ট’ শিরোনামের এ আয়োজনে অতিথি ছিলেন ১১৫ জন। তাঁরা উপভোগ করেছেন কিশোয়ারের রন্ধনজাদু। কিশোয়ারের সঙ্গে এ প্রকল্পে সহযোগিতা করেছেন মোট ১২ শেফ। অন্যান্য দায়িত্বে ছিলেন আরও ৪৭ জন। সূচনা থেকে শেষপাত—কিশোয়ার পরিবেশন করেন পঞ্চব্যঞ্জন। অর্থাৎ সেদিনের লাঞ্চ ছিল ফাইভকোর্স।

শুরু হয় ফুচকা দিয়ে। এ ফুচকা পরিবেশিত হয়েছে রোস্ট করা কমপ্রেসড বিটরুটের সঙ্গে ফেটা ক্রেমো আর বাছাই করা মাইক্রো হার্ভসের সম্মিলনে।

সবুজ ঝোলে হামাচির সাঁতার

সানন্দ সূচনার পর আসে হলুদ লেজের হামাচি। এটা জাপানিদের বিশেষ প্রিয় মাছ। সবুজ ঝোলে হামাচিগুলোকে যেন ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর তাদের সঙ্গে ভেলা হয়েছে কামরাঙা ও পেপার বেরি। এই বেরি অস্ট্রেলিয়ায় হয়ে থাকে।

ফাইন ডাইনিংয়ে লাউ

তৃতীয় পদ ছিল ইউজু ইনফিউজড করা মেলনের সঙ্গে স্ক্যালপ। লাউ আর ঝলসানো স্ক্যালপের সঙ্গী ছিল মিসো বাটার, জাপানি নোরি এবং এডামামে ও পেঁয়াজকলি।

হাঁসের কলিজা ও গরুর মজ্জার যুগলবন্দী

এরপর ফোয়া গ্রা বা হাঁসের কলিজার সঙ্গে জুটি বেঁধে আসে অসো বিউকো বা গরুর হাড়ের মজ্জা। এদের গাঁটছড়াকে জমাট করতে ছিল অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় জ্যাম।

শেষপাতে কিশোয়ারের এ লাভ লেটার টু ঢাকা

আর সবশেষে ছিল ঢাকাকে লেখা কিশোয়ারের প্রেমপত্র—আ লাভ লেটার টু ঢাকা। তবে সেই চিঠি কিন্তু পাঠের নয়, আস্বাদের। পানের সংগতে আইসক্রিম। এটা মাস্টারশেফে পরিবেশন করে মাত করে দেন তিনি। তখন এর নাম ছিল ‘দ্য আফটার ডিনার মিন্ট’। স্বাদকোরককে উসকে দিতে এই আইসক্রিমের সঙ্গে কিশোয়ার আরও যোগ করেন ভাজা মৌরি ও নারকেল, খেজুর, মিষ্টি মৌরি ও ঝোলাগুড়ের ক্যারামেল।

এই সংক্ষিপ্ত সফরে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন কিশোয়ার। জেনেছেন খাদ্যের অপচয় রোধ নিয়ে তাদের কর্মসূচি সম্পর্কে। এ ছাড়া একটি ফুড ইন্ডাস্ট্রিতে গিয়েছেন। উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের মেয়েদের অংশগ্রহণ চাক্ষুষ করেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন পাঁচ তারকা হোটেল ও রেস্তোরাঁয় নানা ভূমিকায় মেয়েদের সম্পৃক্ততায় তিনি মুগ্ধ ও উজ্জীবিত। অনেক কিছু শেখার সুযোগ হয়েছে মন্তব্য করে কিশোয়ার জানিয়েছেন, এসবই তাঁর বইতে স্থান পাবে। আর সেই বই নিয়ে তিনি ঢাকায় আসতে চান।

আলাপে স্বাভাবিকভাবেই ঘুরে–ফিরে আসে মাস্টারশেফ প্রসঙ্গ। তাঁর সাড়াজাগানো পরিবেশনা খিচুড়ি, পান্তা ইত্যাদি খাঁটি বাঙালি খাবারের আবেদন ও প্রচলন অস্ট্রেলিয়া বা পশ্চিমা সমাজে বেড়েছে কি না, এমন প্রশ্নে কিশোয়ারের কাছ থেকে ইতিবাচক জবাব পাওয়া গেল। তিনি বলেন, কেবল অস্ট্রেলিয়ায় নয়, সারা বিশ্বেই এর কদর বেড়েছে। বিশেষত পরিযায়ী বাঙালিদের মধ্যে। কারণ, আমি এসব কুজিন কেবল কখনো–সখনো খাবার জন্য উপস্থাপন করিনি।

তাঁর কাছে মায়ের হাতের রান্নার কোনো বিকল্প নেই। সেটা মাছের ঝোলই হোক বা মাংস কিংবা অন্য কিছু। তাই মন চাইলে যেটা খেতে ইচ্ছা করে, সেটা আর কিছুই নয়, মায়ের রান্না।

বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের রান্নার আগ্রহের প্রশংসা করে কিশোয়ার বলেন, রান্না বস্তুত মানুষের জীবনের মৌলিক দক্ষতা। সে জন্যই তো কেবল মেয়েরা নয়, বরং ছেলেরাও শিখবে। আর অভিভাবকদেরই উচিত হবে ছেলেমেয়ে–নির্বিশেষে সবাইকেই এটা শেখানো।

ঢাকায় থাকলে কোনটা তিনি মিস করতে চান না, এমন প্রশ্নে কোনো কিছু না ভেবেই উত্তর দেন ফুচকা। বোঝাই যায়, অজি আবহে বড় হওয়া কিশোয়ারের মনে রয়ে গেছে ঢাকাপ্রেম।