বাংলাদেশের ফিলাটেলিতে ইলিশ

ছবি: লেখক

বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ভোজনবিলাসী বাঙালির প্রধান অনুষঙ্গ মাছকে প্রথম থেকেই তাদের প্রকাশনায় গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। ডাকটিকিট (Stamp), উদ্বোধনী খাম (First Day Cover), স্মারক সিল (Cancellation) ইত্যাদি পোস্টাল সামগ্রী প্রকাশের মাধ্যমে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ডাকটিকিট সংগ্রাহকদেরকে যেমন আনন্দের খোরাক জুগিয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের মাছ বিশেষত ইলিশকে বিশ্বদরবারে পরিচিতি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছে।

ছবি: লেখক

বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ ডাকটিকিট (Definitive Stamp) সিরিজে মাছের উপস্থিতি দেখা যায়, তা–ও আবার ইলিশ মাছের। ১৯৭৩ সালের ৩০ এপ্রিল তারিখে প্রকাশিত সিরিজটির নকশায় ছিলেন পি কে মণ্ডল, কে জি মুস্তাফা, গোলাম সারওয়ার ও এমদাদ হোসাইন। সিরিজটিতে মোট ১৪টি ডাকটিকিট প্রকাশ পায় এবং তা যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত ব্রাবুরি উইলকিলসন কোম্পানি থেকে ছাপিয়ে আনা হয়। ফলে ডাকটিকিটগুলোর কাগজ ও ছাপার মান ছিল সে সময়ের সেরা।

ইলিশ মাছের ডাকটিকিটটির আকার ছিল ৩১ দশমিক ৫ বাই ২৪ দশমিক ৫ মিমি এবং ছিদ্রকের (Perforation) দূরত্ব ছিল ১৪ বাই ১৪ দশমিক ৫ মিমি। গোলাপি রঙের টিকিটটির মূল্যমান ছিল মাত্র ৫০ পয়সা। ইলিশ মাছ ছাড়া এই সিরিজে মাছ ধরার দেশি জেলে ডিঙিসহ ভেসালের ছবিসংবলিত পাঁচ টাকার আরেকটি ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়। সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশের ডাকটিকিটে মাছ ও মাছ ধরার ভেসাল জালের এমন উপস্থিতি জানান দেয়, বাংলাদেশ ডাক বিভাগ বাঙালির প্রিয় ইলিশ মাছকে ঠিক কতটা গুরুত্ব দিয়েছে।

ছবি: লেখক

১৯৭৬ সালে তৃতীয় সাধারণ ডাকটিকিট সিরিজেও ইলিশ মাছকে আবারও রাখা হয়, তবে এবার আকার (২৬ বাই ২১ দশমিক ৫ মিমি) ও ছিদ্রকের দূরত্ব (১৩ দশমিক ৫ মিমি) কিছুটা কমিয়ে আনা হয়।

বাংলাদেশ ডাক বিভাগ এরপর কিছুটা বিরতি দিয়ে ১৯৮৩ সালের ৩১ অক্টোবর মাছের ওপর প্রথম স্মারক ডাকটিকিট (Commemorative Stamp) ও একটি স্যুভিনির সিট (Souvenir Sheet) বের করে। গলদা চিংড়ি, রুপচাঁদা, রুই ও কই মাছ নিয়ে ‘বাংলাদেশের মাছ’ নামে প্রকাশিত সিরিজটির নকশা করেন মাহবুব আকন্দ, ওয়াহিদ কামাল ও শহিদুল্লাহ্‌র মতো স্বনামধন্য শিল্পীরা।

ডাকটিকিটগুলোর রঙের বিন্যাস ও অলংকরণ সংগ্রাহকদের সহজেই নজর কাড়ে, বিশেষত স্যুভিনির সিটের Imperf ডাকটিকিটের বাইরের অংশে কাতলা, শিং, চাঁদা, মৃগেল, রুই মাছের চমত্কার কোলাজ। অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত Ueberreuter কোম্পানি থেকে ছাপা হয়। এরপর বাংলাদেশ ডাক বিভাগ একে একে হরিণা চিংড়ি (১৯৯১), বাগদা চিংড়ি (১৯৯১), ঘনিয়া (২০০২), পাবদা (২০০২), কালবাউশ (২০০৩), আইড় (২০০৪), ফলই (২০০৪), মেনি (২০০৫) ইত্যাদি বাংলার দেশি মাছ নিয়ে ডাকটিকিট প্রকাশ করে।

ছবি: লেখক

২০০১ সালে জাতীয় মাছ ইলিশকে নিয়ে নতুন ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়। সে বছরের ২৫ মার্চ ডাক বিভাগ ‘বাংলাদেশের মাছ’ নামে স্বতন্ত্র একটি সিরিজ প্রকাশ করে। এই সিরিজে ইলিশ, টেংরা, পুঁটি ও খলিশা—মোট চারটি দেশি মাছকে স্থান দেওয়া হয়। প্রতিটি টিকিটের মূল্য সমান অর্থাৎ ১০ টাকা। আনোয়ার হোসেন খলিশা মাছের নকশা করেন। বাকি তিনটি মাছের নকশায় ছিলেন মুছলিম মিয়া। বহুরংবিশিষ্ট ডাকটিকিটগুলোর প্রতিটির আকার ছিল ৩২ ˟ ৪২ মিমি এবং ছিদ্রকের দূরত্ব ১২ দশমিক ৫ মিমি।

গাজীপুরের দ্য সিকিউরিটি প্রিটিং করপোরেশন লিমিটেড প্রেস থেকে টিকিটগুলো ছাপানো হয়। এ উপলক্ষে বাংলা-ইংরেজি দ্বিভাষায় রচিত একটি তথ্যনির্দেশিকা ও উদ্বোধনী খাম প্রকাশ করা হয়। উদ্বোধনী খামের বাঁ পাশে মাছ চাষের বিভিন্ন পর্যায় এবং উত্পাদিত মাছের ছবি ব্যবহার করা হয়। প্রথমবারের মতো উদ্বোধনী সিলে মাছের মোটিফও ব্যবহার করা হয়। সংগ্রাহকদের জন্য তা ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা ও চট্টগ্রাম—চারটি জিপিও ছাড়াও দেশের প্রধান প্রধান ডাকঘর থেকে একযোগে উদ্বোধনী খামটি অবমুক্ত করা হয়।

ছবি: লেখক

বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ২০০৩ সালে মৎস্য পক্ষ উপলক্ষে দুই টাকা মূল্যমানের কালবাউশ মাছের একটি টিকিট এবং সুদৃশ্য উদ্বোধনী খাম প্রকাশ করে। এর প্রকাশিত খামে চিংড়ি, গ্রাস কার্প মাছের সঙ্গে ইলিশ মাছের ছবি ব্যবহার করা হয়। ডাকটিকিট, উদ্বোধনী খামসহ ফিলাটেলিক বিভিন্ন জিনিসে জাতীয় মাছ ইলিশের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এ কথাই আমাদের বাংলাদেশ ডাক বিভাগ স্মরণ করিয়ে দেয়, ইলিশ মাছের জনপ্রিয়তা অপ্রতিরোধ্য।