বিশ্বজুড়ে প্রচলিত বিচিত্র সব ইফতারি

করোনা অতিমারিতে থমকে গেছে জীবন। কিন্তু থেমে নেই সময়ের বয়ে চলা। এরই মধ্যে ঘুরেফিরে আসছে আনা উপলক্ষ। যেমন এসেছে রোজা। এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ইফতার, যা নিয়ে দেশে দেশে দেখা যায় বিশেষ আয়োজন।

রমজান মাসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ইফতার। ছোট–বড় সবাই সারা দিন রোজার শেষে ইফতারি নিয়ে বেশ একটু শখ করেই থাকে। বাংলাদেশে যেমন ইফতারি নিয়ে নানা জায়গায় বসে বাজার, চলে প্রচুর কেনাবেচা, এমন হরেক রকম ইফতারির রীতি প্রচলিত আছে পৃথিবীজুড়েই।

ছবি: উইকিপিডিয়া

করোনা অতিমারিতে থমকে যাওয়া জীবনে চলুন একটু ঘুরে দেখা যাক স্বাভাবিক সুস্থ পৃথিবীতে কেমন ছিল বিভিন্ন সংস্কৃতির ইফতার আয়োজন।

বাংলাদেশ

ঢাকার ইফতার বাজার
ছবি: উইকিপিডিয়া

বাংলাদেশের চকবাজারের ইফতারি বিক্রির পুরোনো ঐতিহ্য সবারই জানা। জালি কাবাব, সুতি কাবাব থেকে শুরু করে ছোলা, পেঁয়াজু, জিলাপিসহ বাহারি ইফতার পণ্যে সাজানো হয় অলিগলি। এ ছাড়া সব জায়গায়ই ছোট পরিসরে ইফতারের পসরা দেখা যায়।

বাড়িতে ইফতারের থাকে নানা আয়োজন। এ ছাড়া বাংলাদেশি ইফতার আয়োজনের সবচেয়ে সুন্দর দিক হলো পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে ইফতারি ভাগ করে দিয়ে খুশি ছড়িয়ে দেওয়া। মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে অনেকে মসজিদে ও দুস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে ইফতারি বিতরণ করেন।

ভারত

হায়দরাবাদের মুসল্লিরা তাঁদের ইফতার শুরু করেন হালিম দিয়ে
ছবি: আনস্প্ল্যাশ

হিন্দুপ্রধান দেশ হলেও ইফতার আয়োজনে কোনো দিক দিয়ে পিছিয়ে নেই ভারতও। মোগল ঐতিহ্য ও হাজার বছরের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে ভারতেও মহাসমারোহে চলে ইফতার আয়োজন। মসজিদে ইফতারসামগ্রী বিতরণ থেকে শুরু করে হাজারো মুসল্লি একত্র হয়ে ইফতার করা, স্থানীয় ইফতার পসরা—সবই দেখা যায় ভারতে।
হায়দরাবাদের মুসল্লিরা তাঁদের ইফতার শুরু করেন হালিম দিয়ে। এ হালিমের ঐতিহ্য হায়দরাবাদের সীমানা ছাড়িয়ে এখন ছড়িয়ে পড়েছে সব দিকে। এ ছাড়া জিলাপিও ভারতের ঐতিহ্যবাহী ইফতার আয়োজনের অংশ হিসেবে আছে বহু যুগ ধরে।

পাকিস্তান

পাকিস্তানের ইফতারে সমুচা থাকবেই
ছবি: উইকিপিডিয়া

মুসলিমপ্রধান দেশ পাকিস্তানে ইফতারের প্রধান আকর্ষণ হিসেবে থাকে একধরনের সমুচা। কখনো কখনো একে ‘সামবুসা’ও বলা হয়। মূলত একই আকারের খাবারই দেশভেদে পরিচিত হয় ভিন্ন নামে। এ ছাড়া নিয়মিত ইফতারি হিসেবে অন্যান্য দেশের মতো খেজুর তো থাকেই পাকিস্তানিদের পাতে। আরও আছে মাংস ও সবজি দিয়ে তৈরি নানা রকম পাফ পেস্ট্রি ধরনের খাবার।

বাংলাদেশ ও ভারতের মতোই পাকিস্তানেও আছে ইফতারি বিক্রির ঐতিহ্য। মূলত উপমহাদেশে রাস্তার পাশের খাবারের দোকানের ব্যাপক চাহিদাই এসব ইফতারি বিক্রিকে করেছে জনপ্রিয়।

শ্রীলঙ্কা

শ্রীলঙ্কায় রোজার শেষে ইফতার করার ধরন খুবই আলাদা ও সাদামাটা হলেও তাতে নিশ্চিত হয় সারা দিনের পুষ্টির চাহিদা। ইফতার শুরু হয় টাটকা ফল আর ফলের রসে তৈরি সরবেট দিয়ে। এরপর একে একে হালকা ধরনের খাবার খাওয়ারই রীতি। সাধারণত আদিক রোটি নামের একধরনের রুটি ইফতারের তালিকায় খুবই জনপ্রিয়। এর সঙ্গে থাকে নারকেল দুধ, মরিচ ও পুদিনার সমন্বয়ে তৈরি তরকারি, প্রতিটি খাবারই পুষ্টিগুণে ভরপুর ও খুবই উপকারী।

ইরান

ইরানের ইফতার টেবিল
ছবি: উইকিপিডিয়া

ইরানে ইফতারে মিষ্টি চায়ের সঙ্গে নান সর্বাধিক জনপ্রিয়। এ ছাড়া নানের সঙ্গে সবজি ও ডালের মিশ্রণে তৈরি একধরনের স্যুপ। এ ছাড়া বিভিন্ন মাংসের গ্রিল, ফিরনি ও অন্যান্য মিষ্টি খাবার।

জর্ডান

জর্ডানের ইফতারে অবশ্যই থাকবে ঐতিহ্যবাহী মানসাফ
ছবি: উইকিপিডিয়া

জর্ডানের ইফতার আয়োজনে তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার মানসাফ অবশ্যই থাকে। এই খাবার তাদের জাতীয় খাবারও বটে। এ ছাড়া দই, ফল ও ফলের জুস, গ্রিলড ল্যাম্ব ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে আয়োজন করা হয় বুফে স্টাইল ইফতারির, যাতে থাকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ধরনের খাবার। এ ছাড়া প্যানকেকের সঙ্গে মধু, বাদাম ও ফল খাওয়ার প্রচলনও দেখা যায় জর্ডানে।

লেবানন

লেবানিজ খাবারে আছে আলাদা ধরনের তেল-ঝালের ব্যবহার। বিভিন্ন মাংসজাতীয় খাবার, বিশেষত গ্রিল লেবাননে বিশেষভাবে সমাদৃত। এ ছাড়া বিশেষভাবে তৈরি রুটি ও তার সঙ্গে সবজি–মাংসের মিশ্রণে তৈরি সালাদ, লেবানিজ ইফতারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

মিশর

মিশরীয়দের ইফতারে থাকে অ্যাপ্রিকট জুস
ছবি: উইকিপিডিয়া

মিশরে ইফতার আয়োজন করা হয় চিরাচরিত মিশরীয় সংস্কৃতির আকর্ষণীয় ও রুচিশীল উপায়ে। মিশরের এক পুরোনো ঐতিহ্য হলো রাস্তায় অনেক মুসল্লি একসঙ্গে মিলিত হয়ে ইফতার করা, যা বর্তমানে মহামারির জন্য থমকে আছে যদিও। কিন্তু আমরা আশা করি, আগামী রমজানে আবার সরব হয়ে উঠবে মিশরের রাস্তার ইফতার আয়োজন।
ইফতারের খাদ্যতালিকায় থাকে ফলের রস। মিশরীয়রা মূলত অ্যাপ্রিকট ফল শুকিয়ে তাকে জুস করে ইফতারে পান করেন। এটি যেমন সুস্বাদু, তেমনি দারুণ পুষ্টিকর। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের নান ও রুটি এবং বিনের তরকারি খুবই জনপ্রিয়। মিষ্টি খাবার হিসেবে আরব ধাঁচের ডেজার্টগুলো বেশি সমাদৃত।

লেখক: অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়