বোস কেবিন সরগরম

১৯৮৮ সালে ফুলপট্টি থেকে রেস্তোরাঁটি নারায়ণগঞ্জের ১ ও ২ নম্বর রেলগেটের সনাতন পাল লেনে স্থানান্তরিত হয়, নামও খানিকটা বদলে যায়—দ্য বোস কেবিন হয়ে যায় ‘নিউ বোস কেবিন’

গরিবি হালতের একচিলতে ঘর আর নিতান্ত সাদামাটা পরিবেশনা—দেখে প্রথমে আমাদের ঠিক ‘ভক্তি’ জাগেনি। কিন্তু যে মুহূর্তে কড়া লিকারের দুধ–চা ও লাল চায়ে চুমুক দিলাম, মালুম হলো কেন সেকালে এই চা খেয়ে এত আপ্লুত হয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। ১০০ বছর পেরোনো বোস কেবিনের চায়ের বিশেষত্ব হলো তীব্র কড়া লিকার। স্বাদের মধ্যে কী যেন একটা আছে, চুমুকেই চাঙা হয়ে ওঠে দেহমন! ফলে চায়ের নেশায় দূরদূরান্ত থেকেও ছুটে আসে মানুষজন। আর তখন সুভাষ বসুর চা পানের গল্প শুনতে শুনতে তাঁরাও হয়তো সেদিনের চায়ের আস্বাদ পান।

১৯৩১ সালের ৭ নভেম্বর। কলকাতা থেকে জাহাজে চেপে নারায়ণগঞ্জে এলেন অখণ্ড ভারতবর্ষের প্রবাদপ্রতীম রাজনীতিবিদ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। জাহাজ থেকে নামতেই তাঁকে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ পুলিশ, নারায়ণগঞ্জ থানায় নিয়ে বন্দী করে রাখে আট ঘণ্টা। এ সময় বোস কেবিনের প্রতিষ্ঠাতা নৃপেন্দ্র চন্দ বোস—সবার কাছে যিনি ভুলু বোস নামে পরিচিত বেশি—থানায় গিয়ে এই নেতাকে চা খাইয়ে তৃপ্ত করেছিলেন। তত দিনে বোস কেবিনের বয়স হয়ে গেছে ১০ বছর।

ইতিহাস বলছে, ১৯২১ সালে ‘দ্য বোস কেবিন’ নাম দিয়ে নারায়ণগঞ্জের ১ নম্বর রেলগেটের ফুলপট্টির পশ্চিম পাশে প্রথমে চা–বিস্কুটের ব্যবসা শুরু করেছিলেন ভুলু বোস। তখন তিনি স্বদেশি আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। ব্যবসার আড়ালে স্বদেশি নেতা–কর্মীদের গোপন যোগাযোগ এবং সংবাদ আদান–প্রদানের নিরাপদ স্থান হয়ে ওঠে এ প্রতিষ্ঠান।

চায়ের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে আরও নানা পদ

দিনে দিনে চায়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক পদ যুক্ত হয়ে ‘চায়ের দোকান’ হয়ে ওঠে রেস্তোরাঁ। পরে ১৯৮৮ সালে ফুলপট্টি থেকে রেস্তোরাঁটি নারায়ণগঞ্জের ১ ও ২ নম্বর রেলগেটের সনাতন পাল লেনে স্থানান্তরিত হয়, নামও খানিকটা বদলে যায়—দ্য বোস কেবিন হয়ে যায় ‘নিউ বোস কেবিন’। তত দিনে এটি বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আড্ডার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

‘নিউ’ হওয়ার অনেক আগে থেকেই এখানে পাওয়া যায় তিন বেলার খাবার। সকাল থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সকালের নাশতায় পাওয়া যায় পরোটা, ডিম মামলেট ও পোচ; হালুয়া, মুরগি ও খাসির মাংস এবং চা। বেলা একটা থেকে দুপুরের খাবারে ঝরঝরে পোলাওর সঙ্গে থাকে মুরগি ও খাসির মাংসের কারি। চাইলেও এ সময় চা পাওয়া যাবে না। বিকেল চারটা থেকে আবার শুরু হবে চা, সঙ্গে থাকবে ডিম চপ, ডিম টোস্ট, চিকেন ও মাটন কাটলেট ইত্যাদি।

নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বির ভাষ্য, পাকিস্তান আমলের শুরু থেকে এখানে পোলাও এবং খাসি ও মুরগির মাংস পাওয়া যায়। অনান্য খাবার এর আগে–পরে যুক্ত হয়েছে।

ভুলু বোসের পর বোস কেবিনের হাল ধরেন তাঁর ছেলে রবি বোস। এই ধারায় রবি বোসের ছেলে তারক বোস এখন প্রতিষ্ঠানটির দেখভাল করছেন। বিভিন্ন সময় এখানে সৈয়দ শামসুল হক, সন্তোষ গুপ্ত, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, মোহাম্মদ রফিক, হেলাল হাফিজের মতো কবি–লেখকদের পা পড়েছে।

আষাঢ়ঘোর ছুটির দিনের এক দুপুরে বোস কেবিনে গিয়েছিলাম আমরা। সকালের আড্ডার আসর শেষ হয়ে দুপুরের খাবার দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে সে সময়। আড্ডার সেই ভাঙা হাটে তখনো কিন্তু বসে আছেন নারায়ণগঞ্জ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সহসভাপতি পিন্টু সাহা। ‘মানুষ কি কেবল ঐতিহ্যের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতেই বোস কেবিনে আসেন, নাকি আসলেই এখানকার খাবারে কোনো বিশেষত্ব আছে?’ এক ফাঁকে পিন্টু সাহাকে জিজ্ঞাসা করলাম।

‘চায়ের কথা তো বলারই দরকার নেই। অন্য খাবারগুলোতে তেল–মসলা খুবই কম থাকে, খাসি ও মুরগির মাংসে ঝোল অনেক বেশি থাকে, পোলাও একেবারে ঝরঝরে, কোনো বেরেস্তা থাকে না। তাই সব খাবারই অন্য রকম স্বাদের হয়।’

কথাগুলোর প্রমাণও আমরা পেলাম একেবারে হাতেনাতে, নিজেরা দুপুরের খানা খাওয়ার সময়। আর বোস কেবিনের ‘সিগনেচার’ চায়ে চুমুক না দিলে কী হয়?

বোস কেবিনের ‘সিগনেচার’ চায়ে চুমুক না দিলে হয়?

প্রতিটি চুমুকে ‘আজি হতে শতবর্ষ আগে’র ঐতিহ্য যে আপনাকে ডাক দিয়ে যায়, প্রাণ চাঙা হয়ে ওঠে, এসব কি আর নতুন করে বলতে হবে!