প্রায় ৪ হাজার বছরের পুরোনো মসলার গল্প

বাংলাদেশের হাজার কোটি টাকার মসলার বাজার দখলে রীতিমতো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ২০টির বেশি দেশ। তবে বাজার দখলের এ গল্পটা কয়েক হাজার বছরের পুরোনো। নতুন গবেষণা জানাচ্ছে সে তথ্য।

‘হলুদ বাঁটিছে হলুদ বরণী মেয়ে,/ হলুদে লিখিত রঙিন কাহিনী গড়াইছে পাটা বেয়ে।’ কবি জসীমউদ্‌দীনের ‘হলুদ বরণী মেয়ে’ যে হলুদ বাটছে, তার কাহিনি ঠিক কতটা রঙিন, কতটা বিস্তার তার? এ তো এখন সবাই জানে যে আজকের এই ভারতীয় মসলার আদি ব্যবহার মূলত রং ও ওষুধ হিসেবে ছিল। ঔষধি গুণের কারণেই এটি পরে খাবারের অবিচ্ছেদ্য উপাদান হয়ে ওঠে। এ কথাও জানা যে ভারতীয় উপমহাদেশ এবং এশীয় অঞ্চলের মসলার সৌরভের সঙ্গে, রঙের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজারো যুদ্ধের ইতিহাস, যা নিয়ে প্রখ্যাত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক সত্যেন সেনের আস্ত একটা বই-ই আছে ‘মসলার যুদ্ধ’ নামে।

প্রাচীন লেভান্তে অঞ্চলের শহর মেগিদ্দোয় গবেষকেরা ৩ হাজার ৭০০ বছর পুরোনো কিছু তৈজসপত্র খুঁজে পেয়েছেন। সেসব পুরোনো পাত্রে রয়েছে বাটা হলুদের ছাপ
ছবি: কার্ল সোলানো, পেকজেলস ডট কম

অনেকে ভাবতে পারেন, এই মসলার যুদ্ধ এক অতীত গল্প। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই যুদ্ধ কখনো থামেনি, থামার নয়। গোটা বিশ্বের দিকে তাকাতে হবে না। আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালেই এই যুদ্ধের কিছু নমুনা নজরে পড়বে। বাংলাদেশের হাজার কোটি টাকার মসলার বাজার দখলে রীতিমতো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ২০টির বেশি দেশ। এ তালিকায় প্রতিবেশী ভারত, মিয়ানমার যেমন আছে, তেমনি আছে চীন থেকে শুরু করে সুদূর ইথিওপিয়া পর্যন্ত। আর এশীয় অঞ্চলের ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা তো আছেই। আছে মাদাগাস্কার, কমোরোজ দ্বীপ, গুয়াতেমালার মতো অঞ্চলও। আজকের এই মসলার যুদ্ধের সঙ্গে সত্যেন সেন বর্ণিত মসলার যুদ্ধের তফাত এই যে এটি আর আগের মতো রক্তক্ষয়ী নয়; বরং কৌটিল্যের কূটনীতির পথ ধরেই এর বিস্তার ও সংকোচন ঘটছে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় মসলার রং ও সৌরভ এতই চটকদার ছিল যে তা তার দুর্ভাগ্যের কারণ হয়ে উঠেছিল। ‘আপনা মাসে হরিণা বৈরী’ বোধটা তো আর এ অঞ্চলে এমনি এমনি তৈরি হয়নি। বহু তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই একমাত্র এমন বোধ জন্ম নেওয়া সম্ভব। সে যাক, দুর্ভাগ্যের ইতিহাসে আগ্রহীরা না হয় নিজ গরজে অতীত খুঁড়ে দেখবেন। সত্যেন সেনের বইটি তো থাকলই। কিন্তু সেখানে মোটামুটি ১৫ শতকের আশপাশের ইতিহাসটিই উঠে এসেছে, যখন মসলার সুবাস ইউরোপীয়দের ইন্দোনেশিয়া-ভারত পর্যন্ত টেনে এনেছে। কিন্তু তার আগে?

দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় মসলার রং ও সৌরভ এ অঞ্চলের জন্য দুর্ভাগ্যের কারণ হয়ে উঠেছিল
ছবি: প্রথম আলো

এর আগে কি ইউরোপ মসলার সৌরভ পায়নি? এশিয়ার মসলার বিশ্বভ্রমণ তো তবে সেদিনের ঘটনা হয়ে গেল। না, তেমনটি নয়। তারও বহু আগে। ঠিক কত আগে? উত্তর খুঁজতে গেলে অনেকেই হয়তো ভারতের তামিলনাড়ুতে পাওয়া রোমান সাম্রাজ্যের প্রতীকসংবলিত সোনা ও রুপার মুদ্রাগুলোর কথা বলবেন, যা কিনা ৬০ থেকে ১৬০ খ্রিষ্টাব্দের বলে ধারণা করা হয়। অনেকে হয়তো প্রামাণ্য হিসেবে বলবেন সেই বিখ্যাত উক্তির কথা, ‘রোমের ভান্ডার শূন্য করল ভারতের মসলায়’। নিঃসন্দেহে এই উক্তি রোমের মানুষের ভারতীয় মসলায় বিভোর হওয়ার গল্প বলে। একই সঙ্গে এশীয় মসলার বিশ্বভ্রমণের আদি বিন্দুটি সম্পর্কে ধারণা দেয়। কিন্তু সাম্প্রতিক এক গবেষণা জানাচ্ছে, এশীয় মসলার ভূমধ্যসাগর পাড়ির ঘটনা তারও বহু আগে ঘটেছিল।

ঠিক কত আগে? বলা হচ্ছে, কমপক্ষে তিন হাজার বছর আগে। জার্মানির লুডভিগ ম্যাক্সিমিলিয়ানস ইউনিভার্সিটির (এলএমইউ) প্রত্নতত্ত্ববিদ ফিলিপ স্টকহ্যামারের নেতৃত্বে পরিচালিত এই গবেষণা সুনির্দিষ্টভাবে বলছে, এশীয় অঞ্চলের মসলা ভূমধ্যসাগর আজ থেকে ৩ হাজার ৭০০ বছর আগে পাড়ি দিয়েছিল। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল এই অঞ্চলের কিছু ফলমূলও। নিয়ে গেছে তিলের মতো শস্যদানাসহ বহু কিছু। বাণিজ্যসূত্রেই এটি হয়েছে।

এশীয় অঞ্চলের মসলা আজ থেকে ৩ হাজার ৭০০ বছর আগে পাড়ি দিয়েছিল ভূমধ্যসাগর
ছবি: প্রথম আলো

গবেষণা–সম্পর্কিত পত্রিকা সায়েন্সডেইলির প্রতিবেদনে বলা হয়, ফিলিপ স্টকহ্যামার পরিচালিত গবেষণায় চমকপ্রদ কিছু তথ্য উঠে এসেছে। বিভিন্ন দেশের সমন্বয়ে গঠিত এই গবেষক দল লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিন ও জর্ডান নিয়ে গঠিত লেভান্তে অঞ্চলের পুরোনো শহর মেগিদ্দোর এমন কিছু তৈজসপত্র খুঁজে পেয়েছে, যা ৩ হাজার ৭০০ বছর পুরোনো। আর এসব পুরোনো পাত্রে রয়েছে সেই হলুদ বরণ মেয়ের বাটা হলুদের ছাপ—এখনো। ফলে, এটা নিশ্চিত যে সেই প্রাচীন বাজারে শুধু আশপাশের অঞ্চলে উৎপাদিত গম, খেজুরই বিক্রি হতো না, বিকিকিনি হতো হলুদও। এ কারণে ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলের ওই বাজারে ব্রোঞ্জযুগেই এশীয় মসলা পৌঁছে গিয়েছিল নিশ্চিতভাবে।

কিন্তু এই হলুদ দিয়ে তারা করত কী? কাপড় রং করত, যেমনটা করত বৌদ্ধ ভিক্ষুরা? নাকি খেত? দ্বিতীয়টির প্রমাণ এরই মধ্যে হাতে এসেছে ফিলিপ এবং তাঁর দলের। সেখানে পাওয়া সেকালের কিছু কঙ্কালের দাঁত পরীক্ষা করে হলুদের অবশেষ পাওয়া গেছে। ফলে রঞ্জকের কাজ করুক আর না-ই করুক, মসলা হিসেবে বা ওষুধ হিসেবে যে হলুদের ব্যবহার বেশ জমে উঠেছিল, তা একরকম নিশ্চিত। যখন এপারের এই অবস্থা, তখন ধারণা করাই যায় যে কাছাকাছি সময়েই সাগর পাড়ি দিয়ে বা না দিয়েই তুরস্ক হয়ে তা পৌঁছে গিয়েছিল তখনকার রোমান সাম্রাজ্যে। আজকের ইতালি, ফ্রান্স কিংবা স্পেন তাই মসলার স্বাদ পাওয়ার জন্য খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অপেক্ষা করেনি। খ্রিষ্টপূর্ব সময়েই তারা এর সুবাস ও রঙে রেঙেছিল।

মিসর হয়ে মসলা পাড়ি জমিয়েছিল ইউরোপ
ছবি: রোমান ওদিনসভ, পেকজেলস ডট কম

এই সংযোগ ঠিক কীভাবে ঘটল? গবেষকেরা বলছেন, সংযোগটি হয়েছে প্রাচীন মেসোপটেমিয়া ও মিশারের মধ্যস্থতায়। মেসোপটেমিয়া ও প্রাচীন মিশর হয়েই এই মসলা এতটা পথ পাড়ি দিয়েছিল। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল কলা, সয়াবিন, তিলসহ আরও বহু কিছু। ফলে, ভিন্ন সংস্কৃতির খাবারের প্রতি মানুষের আগ্রহটি আদতে আজকের বিষয় নয়। বহু আগে থেকেই মানুষ অন্য সংস্কৃতির দিকে ঔৎসুক্য নিয়ে তাকিয়ে আছে। সুযোগ পেলেই সে তার এই আগ্রহ মেটানোর চেষ্টা করেছে। তাকে এই সুযোগ এনে দিতেই জন্ম হয়েছিল প্রাচীন সিল্করুটের মতো বাণিজ্যপথ।