মুরগি দিবসের শুভেচ্ছা

আজ বিশ্ব মুরগি দিবসছবি: পেকজেলস ডট কম

চিকেন ডে তথ্য
• অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার প্রতিবছর চিকেন ডে পালন করা হয়।
• মুরগির মাংসের বিভিন্ন ধরনের রেসিপি শেয়ার এবং রান্না করে খাওয়া হয় এই দিনে।
• কোনো কারণ ছাড়াই দিনটি পালন করা হয় বলে জানা যায়।
• মুরগির নামে বিভিন্ন ধরনের দিবস প্রচলিত আছে পৃথিবীতে।
• আন্তর্জাতিক মুরগি দিবস পালন করা হয় প্রতিবছর মে মাসের ৬ তারিখ।

অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার, আজ বিশ্ব মুরগি দিবস। পৃথিবীতে বহু দিবসের মধ্যে এটি একটি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মুরগা দিবস নাই কেন? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর জানা নেই। কিন্তু আজ মুরগি দিবস, ওয়ার্ল্ড চিকেন ডে।

এটা ঠিক যে অভিজাত মানুষদের দেশি মুরগির মাংস ছাড়া রুচিতে কুলায় না। আমি ব্যক্তিগতভাবে সব সময় অভিজাত হতে চেয়েছি, কিন্তু বউয়ের জন্য পারিনি। তিনি নাকি দেশি মুরগির শক্তপোক্ত মাংস খেতে পছন্দ করেন না। কী আর করা যাবে, বলেন। অভিজাত হবার বাসনা বাদ দিয়েছি।

কিন্তু ছোটবেলায় দেখা রংবেরঙের পালকওয়ালা, লাল ঝুঁটির শক্তপোক্ত গড়নের মুরগার কথা ভুলতে পারি না আজও। কী স্মার্ট মাইরি! মাথা উঁচু করে যখন ভোরবেলা দীর্ঘস্বরে কুক্কুরু কু বলে ঘুম থেকে উঠতে বলত, বিরক্ত হলেও ঘুম থেকে উঠতেই হতো। হেমন্তের বিষণ্ন দুপুরে সেই লাল ঝুঁটি মুরগার দীর্ঘস্বরের ডাকে নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে ভেঙে গেলে মনে হতো, চরাচরে জীবনের স্পন্দন আছে। ধীরে ধীরে আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেল বিষণ্নতা ভোলানো লাল ঝুঁটির দেশি মুরগা। আহা!

ধীরে ধীরে আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেল বিষণ্নতা ভোলানো লাল ঝুঁটির দেশি মুরগা
ছবি: জেমস হুইলার, পেকজেলস ডট কম

যখন বড় হলাম, খুঁজে দেখতে দেখতে পেয়ে গেলাম একদিন। সেই লাল ঝুঁটির স্মার্ট মুরগা আমাদের একেবারে দেশীয় জাতের মুরগা। তার ভালো নাম রেড জঙ্গল ফাউল, সোজা কথায় বনমোরগ। বনে থাকা এই স্বাধীন মুরগা কেন কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগা মানুষের পোষ মেনেছিল, সে ভেবে চোখে জল আসে আমার। ঠিক যেভাবে আমার পোষা এক লাল ঝুঁটি মুরগাকে চোখের সামনে অসুখে ভুগে মরে যেতে দেখে বুক ফেটে কান্না এসেছিল।

এই স্মার্ট মুরগার আরেক জাতভাই আছে। প্রায় একই রকম দেখতে হলেও তার ঝুঁটি কিছুটা ভোঁতা আর ঢ্যাঙা ঠ্যাং দুখানা হলুদ হলুদ। এর নাম আচিল বা আসিল। মানে অজ্জিনিয়াল অর্থাৎ খাঁটি বঙ্গদেশীয়। চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানা আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল থানায় এ জাতের মুরগির জন্ম বলে জানা যায়। এখনো পাওয়া যায়।

এক ছবিতে ৯৯ জাতের মুরগি দেখা যাচ্ছে
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

এই দুই জাতের মুরগি ছাড়াও এক জাতের দেশি মুরগির কথা মনে পড়ে খুব। সে মুরগিকে দেখেই আমরা কোনো কোনো বন্ধুর নাম দিয়েছিলাম ‘গলা ছিলা’। ও মা, পরে দেখি সে মুরগির নামই আসলে ন্যাকেড নেক। পরিষ্কার বাংলা ভাষায় যাকে বলে গলা ছিলা। মাথায় লাল ঝুঁটি থাকলেও এটাকে কেন যেন অতটা ভালো লাগত না। কে জানে, কেন। গলা ছিলা বলেই হয়তো। কিন্তু সেটাও দেশি জাতের মুরগি।

দেশি জাতের মুরগির কথাই যখন বলছি তখন বলে রাখি বেশ স্মার্ট বনমোরগ, কিছুটা স্মার্ট আচিল এবং গলা ছিলা ছাড়াও কয়েক জাতের দেশি মুরগি আছে আমাদের। এগুলো হলো সিলেটের পাহাড়ি এলাকার হিলি, ফ্রিজেল বা উল্টা পালক, কাদাকনাথ বা কালা মাসি। তবে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা জানিয়েছেন, কাদাকনাথ বা কালা মাসি মুরগির উৎপত্তি ভারতের মধ্যপ্রদেশে হলেও এ দেশে এর অস্তিত্ব ছিল অতীতে।

একসময় গ্রামবাংলায় মুরগির মাংস বলা হতো না। বলা হতো, মুরগা খাইছি। মুরগি কম খাওয়ার কারণ ছিল সম্ভবত, তা থেকে ডিম ও বাচ্চা উৎপাদন করা। গত শতকের আশি বা নব্বইয়ের দশকে যারা গ্রামে বড় হয়েছে, তারা জানেন, মুরগি ছিল গ্রামীণ অর্থনীতির একটা অংশ। বাড়িতে প্রাকৃতিক পরিবেশে মুরগি পালন করার চল ছিল গ্রামে। সে মুরগি এবং তার ডিম বিক্রি করে আয় করত গ্রামের মানুষ। কিন্তু পোলট্রিশিল্পের অগ্রগতির হাত ধরে ধীরে ধীরে সে অবস্থা হারিয়ে গেছে।

মুরগি ছিল গ্রামীণ অর্থনীতির একটা অংশ
ছবি: ম্যাথিস ভোলকারডসেন, পেকজেলস ডট কম

যা–ই হোক, পৃথিবীতে কয়েক শ প্রজাতির মুরগি আছে। তবে ধারণা করা হয়, গৃহপালিত মুরগির পূর্বপুরুষ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উদ্ভূত লাল বুনো মুরগি। খাদ্যের জন্য শতাব্দীর পর শতাব্দী বন্য বুনো মুরগি শিকারের পর মানুষ সম্ভবত চার হাজার বছরের অনেক আগে মুরগিকে গৃহপালিত করে। সম্ভবত তখন পূর্ব-এশিয়ার মধ্য দিয়ে মুরগি বিস্তার লাভ করে এবং খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় এক হাজার বছর আগে পারস্যে পৌঁছায় (বাংলাপিডিয়া)।

মুরগি নিয়ে কথার কোনো শেষ নাই, মুরগির কথা বলা বৃথা তাই। এখন এই আধুনিক যুগে আমাদের জীবন ফার্মের মুরগিময়। কোনো দিন যদি বিকেলবেলা মুরগি ছাড়া অন্য কোনো মুখরোচক খাবারের খোঁজে বাইরে বের হন, তাহলে হতাশ হতে হবে। পাড়ার গলি থেকে শুরু করে বড় রাস্তার মোড় কিংবা ঝাঁ–চকচকে শপিং মল অথবা বাহারি নামের রেস্তোরাঁ—সবখানেই মুরগি আর মুরগি। রাস্তায় বের হলেই পোড়া মুরগির সুগন্ধ নাকে লাগে। এখন সম্ভবত বাঙালির জাতীয় খাবারই হয়ে গেছে, গ্রিল মুরগির ওপর সস্তার মেয়নেজ দিয়ে তন্দুর রুটি।

যাক গে সেসব কথা। আপনাদের রাজশাহী অঞ্চলের একটি মুরগির মাংসের রেসিপি দিয়ে রাখি। বাড়িতে রান্না করতে পারেন। রেসিপিটি দিয়েছেন নাজমা হুদা এবং এ রান্নার নাম মুরগি–নারকেলের নাড়ু।

উপকরণ

মুরগি–নারকেলের নাড়ু
ছবি: খালেদ সরকার

দেশি মুরগি ১টি, নারকেল কোরানো ১টি, ময়দা ২ টেবিল চামচ, পেঁয়াজকুচি পৌনে এক কাপ, লবণ স্বাদমতো, এলাচি ২-৩টি, দারুচিনি ২ টুকরা, আদাবাটা ১ টেবিল চামচ, রসুনবাটা ১ টেবিল চামচ, জিরাবাটা ১ চা-চামচ, ধনেবাটা আধা চা-চামচ, মরিচবাটা ১ টেবিল চামচ, হলুদগুঁড়া ১ চা-চামচ, তেজপাতা ২টি, নাড়ু ভাজার জন্য তেল ২ কাপ।

প্রণালি

মুরগি–নারকেলের নাড়ু
ছবি: খালেদ সরকার

নারকেল কুরে মিহি করে বেটে নিতে হবে। এবার এতে ময়দা, লবণ ও সামান্য এলাচির গুঁড়া দিয়ে মাখিয়ে চেপে চেপে গোল করে নাড়ু বানাতে হবে। তেল গরম হলে নাড়ু ছেড়ে হালকা বাদামি করে ভেজে নিতে হবে। এবার প্যানে তেল দিয়ে পেঁয়াজ ভেজে সব মসলা দিয়ে ভালোমতো কষাতে হবে। এরপর মুরগি দিয়ে কষাতে হবে, এবার এক কাপ পানি দিয়ে অল্প আঁচে সেদ্ধ করতে হবে। পানি শুকালে আবার ভালো করে কষাতে হবে। আবার ১ কাপ পানি দিয়ে মাঝারি আঁচে রান্না করে পানি কমে এলে নাড়ুগুলো ওপর দিয়ে বিছিয়ে দিতে হবে। এরপর ১০ মিনিট দমে রেখে দিতে হবে। তেল ওপরে উঠে এলে এবং অল্প ঝোল থাকতে নামিয়ে নিতে হবে।

শেষ করার আগে, শেষ করার আগে বলে রাখি। যা–ই করুন না কেন, কাউকে মুরগি বানাবেন না। তাতে মুরগির অপমান হয়। তিনি কষ্ট পান।